পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
মোহাম্মদ আবদুল গফুর
খুব ছোট্ট একটি সংবাদ। বেরিয়েছে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি সোমবার। দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় দ্বিতীয় সংস্করণে প্রকাশিত এ সংবাদটি এমনিতে খুব ছোট মনে হলেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। প্রথমত, বিষয়বস্তুর কারণে এবং তারপর যেসব সূত্রের মাধ্যমে এটা সংবাদপত্র পাঠকরা জানতে পেরেছেন যেসব মিলিয়ে প্রকাশিত এ সংবাদের গুরুত্ব বেড়ে গেছে হাজারো গুণে।
গত ২৬ ফেব্রæয়ারি সোমবার প্রকাশিত ক্ষুদ্র অথচ গুরুত্বপূর্ণ এ সংবাদটি প্রকাশিত হওয়ার সৌভাগ্য হয়। প্রতিদিন যে পত্রিকাটির একটি বৈশিষ্ট্যের পরিচয় দেয়া হয় সে শব্দ ক’টির মধ্যে স্থান পায় : ‘সত্যের সন্ধানে নির্ভীক’। সুতরাং সম্মানিত পাঠকবৃন্দ প্রকাশিত সংবাদটি সম্বন্ধে যাবতীয় সত্য জানতে সক্ষম হবেন, এমনটা আশা করা অযৌক্তিক নয়।
গত সোমবার দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার প্রথম কলামে প্রকাশিত এ সংবাদটির শিরোনাম ছিল, ‘ঘুষ দিয়ে পদোন্নতি পাওয়া সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে’। আমাদের দেশে বহুদিন ধরেই দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে বলে অনেকের ধারণা। কিন্তু কোনো কিছু যখন সাধারণ মানুষের ধারণার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তার সঙ্গে কোনো তুলনাই হয় না তা যখন উচ্চপদস্থ কোনো সরকারি কর্মকর্তার বক্তব্যের অংশ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তারা এক্ষেত্রে যা বলেন, তার মধ্যে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থাকাটা খুব স্বাভাবিক। সুতরাং তাদের বক্তব্যের গুরুত্ব যে অপরিসীম, তা অস্বীকার করা খুব কঠিন।
এবার সংশ্লিষ্ট সংবাদটি পাঠকবর্গের বোঝার সুবিধার্থে নিচে হুবহু প্রকাশ করা গেল। প্রকাশিত সংবাদটির শিরোনাম ছিল : ‘ঘুষ দিয়ে পদোন্নতি পাওয়া সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে’। ‘যার বরাত দিয়ে সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে তিনি মন্ত্রিপরিষদ সচিব। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেছেন, ‘কিছু জায়গায় ঘুষ দিয়ে পদোন্নতি পাওয়াটা একটা সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে’। কেউ যদি বলেন, আমি ঘুষ দেবো না, আমি ঈমানদারীর সাথে কাজ করি, আমানতদারীর সাথে কাজ করি, সততার সাথে কাজ করি, আমি কেন ঘুষ দেবো? ওই সিস্টেমে যদি উনি সাস্টেইন করতে চান, তাহলে তিনি পারবেন না। তা হলে তিনি সাইড অ্যাফেক্টের শিকার হবেন।
রোববার রাজধানীর এমইসি সম্মেলন কক্ষে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সেমিনারে এ মন্তব্য করেন শফিউল আলম। তিনি বলেন, রাজনৈতিক মহলের প্রভাবে অনেক সময় সরকারি চাকরিজীবীরা চাইলেও অনেক সময় সৎ থাকতে পারেন না। নিতে পারেন না কঠিন কোনো সিদ্ধান্ত।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, মেম্বার অব পার্লামেন্টদের নিয়ে কয়েকটি সেশন করেছিলাম। ওনারা দরজার ভেতরে সব ভালো ভালো কথা বলেন। বের হয়ে গেলে সেটা আর মনে থাকে না। সেটা অনুসরণ করেন না। এলাকায় গিয়ে সব ভুলে যান। সেমিনারে অন্যরা বলেন, সুশাসন নিশ্চিতে প্রয়োজন নৈতিকতার মানোন্নয়ন। তবে নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও দেশে দিন দিন এ মান কমছে। বাড়ছে দিন দিন দ্রæত সম্পদ সংগ্রহের প্রবণতা। সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়মিত সম্পদের বিবরণী দেয়ার বিষয়ও গুরুত্ব দেন অনেকে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কিছু বক্তব্য নিয়ে আজকের যে লেখা শুরু করেছিলাম তা কিন্তু শুধু তাদের সমস্যার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। এর মধ্যে উঠে এসেছে সমাজের সকল প্রভাবশালী লোকদের কথাই। এদের মোটামুটি দু’ভাগে ভাগ করা যায়। এক. যারা উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা হবার কারণে সমাজে যথেষ্ট প্রভাবশালী। অন্য প্রভাবশালীদের মধ্যে রয়েছেন যারা রাজনীতির বিশেষ করে সরকারি দলের সাথে জড়িত। একটা ব্যাপারে উভয়ের মধ্যে প্রচুর মিল লক্ষ করা যায়। উভয় শ্রেণীই নিজ নিজ ক্ষেত্রে নিজেদের প্রভাব বিস্তারে সম্ভাব্য সকল ন্যায়-অন্যায় পথে অগ্রসর হবার পক্ষপাতী। এবং এ ধরনের ন্যায়-অন্যায় পথ নির্বিশেষে তাদের সম্পদ বৃদ্ধির চেষ্টাতেও কখনও ক্লান্তি নেই। এর ফল দাঁড়িয়েছে এই যে, সমাজের এই দু’[টি বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণী দ্রæত ধনী ও প্রভাবশালী হয়ে উঠলেও তার সুপ্রভাব সমাজের সকল অংশের মধ্যে পড়ছে না। ফলে সমাজের কিছু অংশ দ্রæত এগিয়ে গেলেও অন্যরা যেখানে ছিল, সেখানেই পড়ে থাকে। এটা সর্বত্র দেশ ও জাতির জন্য আনন্দের কথা নয়।
কোনো দেশ বা সমাজের এগিয়ে যাওয়ার জন্য শুধু তার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিই যথেষ্ট নয়। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি সমাজের নৈতিক মনোন্নয়ন নিশ্চিত হওয়াও জরুরি। কারণ সমাজের নৈতিক মানোন্নয়ন সমতালে এগিয়ে না গেলে অর্জিত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সম্পদের নানারূপ অপব্যবহারের কবলে পড়ে সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। এ কারণেই কোনো সমাজের টেকসই উন্নতির জন্য তার সার্বিক উন্নতির পথে অগ্রসর হওয়ার কোনো বিকল্প নেই, থাকতে পারে না।
আসলে মানুষ নিয়েই সমাজ গঠিত হয়। আর মানুষের জীবনের নানা দিক থাকে। জীবনে কোনো দিককে অধিক গুরুত্ব দেয়ার ফলে মানুষের জীবনের কোনো দিক যদি অবহেলা বা অবমূল্যায়নের শিকার হয়, তাহলে সে সমাজ সর্র্বাঙ্গসুন্দর হয়ে উঠতে পারে না। কোনো দিকে এগিয়ে গেলেও অন্যান্য দিকে পিছিয়ে পড়ার ফলে তার উন্নতি ও সমৃদ্ধি একপেশে হয়ে পড়ে এবং তার শেষ পরিণতি ইতিবাচক হয় না।
মনে রাখতে হবে মানুষের জীবনের একটা অবিভাজ্য রূপ আছে। জীবনের কোনো একটা দিকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে অন্যান্য দিকে যথাযথ গুরুত্ব না দেয়ার পরিণতি কখনও শুভ হয় না। এটা তো আমরা বহু ক্ষেত্রে দেখে থাকি কোনো পরিবার যথেষ্ট অর্থনৈতিক প্রাচুর্যের মধ্যে বেড়ে উঠলেও নৈতিকতার দিক দিয়ে উন্নতি বজায় রাখতে পারলে তাদের অর্থনৈতিক প্রাচুর্যই তাদের জন্য অতিরিক্ত ভোগ-বিলাসের দিকে ঝুঁকে পড়ার ফলে এক পর্যায়ে তাদের অর্থনৈতিক ধ্বংস ডেকে আনে।
কোনো সমাজকে সর্বাঙ্গ সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে হলে তার সব দিকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়ার কোনো বিকল্প নেই। প্রথমত, মানুষের জীবনের বিভিন্ন দিকের কোনোটাকেই অবহেলা করা চলবে না। তবে শুধু এটুকু বললেও যথেষ্ট নয়। জীবনের চলার পথ শুরুর সময় থেকেই জীবনের জন্য সুন্দর একটি আদর্শ বেছে নিতে হবে। জীবনে ভোগের পাশাপাশি ত্যাগের শিক্ষা ছোট বয়স থেকেই গ্রহণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে মানুষ মনুষ্য আকারে জন্মগ্রহণ করলেও তাকে মানুষ হওয়ার জন্য সারা জীবন সাধনা চালিয়ে যেতে হয়।
পরিশেষে যার কথা নিয়ে আলোচনা শুরু করেছিলাম সেই মন্ত্রিপরিষদ সচিবের বক্তব্য পুনরুল্লেখ করেই আজকের এ আলোচনার উপসংহার টানতে চাই। মন্ত্রিপরিষদ সচিবের বক্তব্য থেকে আমরা জানতে পেরেছি ঘুষ দিয়ে পদোন্নতি পাওয়া সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। যে দেশে ঘুষ দিয়ে পদোন্নতি পাওয়া সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়ায় তার নৈতিক মানের যে ভয়াবহ অবনতি হয়েছে সে কথা বলাই বাহুল্য। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। সেই দেশের জনগণের একটি শিক্ষিত অংশের মধ্যে (শিক্ষিতরা ব্যতীত অন্যদের ঘুষ দিয়ে পদোন্নতি পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না) দুর্নীতি যে দ্রুত ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে সে সম্পর্কে তথ্য দিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব। এটা আমাদের জন্য চরম লজ্জা ও কলঙ্কের কথা।
তবে এ জন্য লজ্জা অধিক পাওয়ার কথা যারা সমাজে অধিক প্রভাবশালী। সমাজের এই প্রভাবশালীরা প্রধানত দুই ভাগে বিভক্ত। যারা অধিক ধন-সম্পদের কারণে অধিক প্রভাবশালী। দ্বিতীয়ত, যারা বিশেষত সরকারি পর্যায়ে রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট হিসেবে প্রভাবশালী। সমাজের এই অতিরিক্ত প্রভাবশালী অংশ কি সমাজে তাদের এই অনাকাক্সিক্ষত প্রভাবের কারণ সম্পর্কে অবহিত সে লজ্জা থেকে নিজেদের মুক্ত করার আন্তরিক প্রয়াস চালাতে রাজি আছেন?
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।