পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আবুল কাসেম হায়দার : আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। দেশে নতুন শিক্ষানীতি কার্যকর হয়েছে। নতুন শিক্ষানীতির আলোকে সরকার শিক্ষা খাতের উন্নতির জন্য নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বর্তমান সরকার শিক্ষার উন্নতির জন্য নতুন বছর শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে কোটি কোটি নতুন বই তুলে দিচ্ছে। প্রতি বছর শুরুতে বই উৎসব হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রীসহ শিক্ষাখাতের সকল ব্যক্তিত্ব শিক্ষার উন্নয়নের জন্য নিয়মিত কাজ করে চলেছেন। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে চূড়ান্ত পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রী এসএসসি, এইচএসসি ও সমমানের অন্যান্য পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পাচ্ছে। নতুন নতুন সরকারি ও বেসরকারি বহু বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে। বেসরকারিখাতে এ পর্যন্ত প্রায় ৯৭টি বিশ্ববিদ্যালয় চালু করা হয়েছে। এই সকল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় ৪ লক্ষ ছাত্রছাত্রী পড়া লেখা করছে। সরকারিভাবে বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ৩৪টি। এই সকল সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ২ লক্ষের অধিক।
কয়েক দিন পূর্বে বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদরাসাকে এমপিওভুক্তির জন্য অনশন আন্দোলন পর্যন্ত হয়েছে। আন্দোলনের এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলনকারী শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ অনশনসহ সকল আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেয়। এখনও ৬ হাজারের অধিক স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা এমপিওভুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে। ২০১০ সালে সরকার মাত্র ১৬শ’ বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদরাসাকে এমপিওভুক্ত করে। হয়তো আগামী বাজেটে এই সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করা হবে। সরকারের উচিত পাঠ অনুমোদন প্রাপ্ত সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করা।
যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করা হবে না, সেই সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে পাঠদানের অনুমতিও দেয়া উচিত নয়। পাঠদানের অনুমতি দিলে অবশ্যই এমপিওভুক্ত করা উচিত। এমন অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যা ১৪/১৫ বছর ধরে এমপিওভুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে। কঠিন সমস্যার মধ্যে এই সকল স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা পরিচালিত হচ্ছে। শিক্ষক, কর্মচারীগণ দারুণ আর্থিক কষ্টে জীবন যাপন করছে। অন্যদিকে শিক্ষার মান ও দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের যা শেখানো হয়, তা তাদের জন্য কর্মবাজারে প্রবেশের উপযোগী নয়। এ কারণে দেশের শিক্ষিত তরুণদের বড় অংশই বেকার। কিন্তু দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প-কারখানায় বিপুল সংখ্যক বিদেশি নাগরিক কাজ করছেন। এতে শুধু ভারতেই বৈধ পথে বছরে ৩২ হাজার কোটি টাকা চলে যাচ্ছে। আর অবৈধ পথে যাচ্ছে এর দ্বিগুণ অর্থ।
স¤প্রতি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা- পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের এক গোল টেবিল বৈঠকে দেশের অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও আমলাদের আলোচনায় উল্লিখিত বিষয় আলোচিত হয়। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে সাবেক বাণিজ্য সচিব সোহেল আহমদ চৌধুরী বলেন, দেশের শিক্ষাখাত ঠিক না হলে ঘোড়ার ডিম কিছুই হবে না। তিনি আরও উল্লেখ করেন, দেশের রাজনীতি এত মুখোমুখী হলে উন্নয়ন ঘটিয়ে দেশকে উন্নত দেশে পরিণত করা বড়ই কঠিন হবে।
অর্থনৈতিক উন্নতির পরবর্তী পর্যায় হচ্ছে শিক্ষার মান ঠিক করা, শ্রমিক ও ব্যবস্থাপকদের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং আমলাতন্ত্রের সক্ষমতা বাড়ানো। বিশ্বব্যাংকের ডুয়িং বিজনেস ইনডেক্স বা সহজে ব্যবসা করার সূচকে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ১৮৯টি দেশের মধ্যে ১৭৭তম অবস্থানে রয়েছে। এ কারণে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো দেখালেও বিদেশি বিনিয়োগ ততটা আসছে না। বিদেশি বিনিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে রযেছে। ব্যাংকিং খাত আজ এক বড় বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে। সুশাসন বলতে আর্থিক খাতে এখন কিছুই নেই। ব্যাংকিং খাতের সমস্যার সমাধান না হলে দেশের সার্বিক আর্থিক খাতের কোন উন্নতি ঘটবে না। সুশাসন এই ক্ষেত্রে অতি জরুরি।
আমাদের দেশের উচ্চ শিক্ষা কার্যক্রম অনেক ক্ষেত্রে কর্মবাজারমুখী নয়। উচ্চ শিক্ষা লাভ করে বেকার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। দেশকে উন্নত করতে হলে ব্যবসা-বাণিেিজ্যর বিকল্প কিছুই নেই। শিল্পখাতের উন্নতির উপর দেশের উন্নতি নির্ভর করে। এক সময় উন্নত সমৃদ্ধ দেশ জাপান এক মাত্র পোশাক খাতের উপর নির্ভর করে এগিয়েছে। পরবর্তীতে তারা দেশ সমৃদ্ধ করার জন্য পোশাক খাত থেকে সরিয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে শিক্ষা লাভের উপর। শিক্ষা, অবকাঠামো ও শিক্ষা গবেষণায় জাপান প্রচুর বিনিয়োগ করে যার ফলে ধীরে ধীরে জাপান উন্নতির মহাসড়কে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়। আমরা একমাত্র তৈরি পোশাক শিল্প খাতে আজ ৩০ বছর প্রতিযোগিতায় টিকে রয়েছি।
আজ দেশের উচ্চ শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে প্রায় ৪৭ শতাংশ বেকার। অথচ আমাদের দেশে বিদেশ থেকে হাজার হাজার উচ্চ শিক্ষিত কর্মী এসে কর্মবাজার দখল করে রেখেছে। খোদ ভারত আমাদের উচ্চ শিক্ষিত যুবকদের বাজার দখল করে বৈধ পথে প্রতি বছর ৩২ হাজার কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশের যুবকরা বেকার। এর কারণ কী? এর মূল কারণ আমাদের শিক্ষার সঙ্গে কর্মবাজারের কোন মিল নেই। শিক্ষাকে আমরা এখনও কর্মোপযোগী করতে পারিনি।
আমাদের আর্থিক খাতের আমূল সংস্কারের প্রয়োজন। এত দিন সরকার নিয়ন্ত্রণমূলক সংস্কার করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু দেশে আর্থিক খাতের উন্নতি তেমন একটা লক্ষ করা যাচ্ছে না। এখন জরুরিভাবে আর্থিক খাতের সংস্কার শুরু করা প্রয়োজন। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতকে আমরা অনেক ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে সামনে নিয়ে আসি। তবে কেন আর্থিক খাতের সংস্কারের ক্ষেত্রে ভারতের অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা করব না। ভারতের উদ্যোগগুলোকে পর্যালোচনা করে আমরা কী কী পদক্ষেপ নিতে পারি তা আমাদের গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশে ব্যবসায়ী পরিবেশ উন্নত করার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা আমাদের প্রথমে প্রয়োজন। সকল দলের দেশকে উন্নত করার ক্ষেত্রে সদিচ্ছা রয়েছে। এই ক্ষেত্রে প্রয়োজন দক্ষতার। আমাদের উন্নতির জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক অংশীদারত্বি, নেতৃত্ব ও নিয়মিত পর্যালোচনা।
দেশে সকল ধরনের আইন বিদ্যমান রয়েছে। কিছু আইনের সঠিক প্রয়োগে সমস্যা রয়েছে। সুবিচারের সমস্যা রয়েছে। আইনকে তার নিজের গতিতে চলার সুযোগ দিতে হবে। আইনকে তার পথে চলতে না দিলে কখনও আইন থেকে সুফল আমরা পাবো না। সবার জন্য আইন সমানÑ এই নীতি সরকারকে গ্রহণ করতে হবে। দলের ঊর্ধ্বে দেশকে ভালবাসতে হবে। দেশের উন্নতির চিন্তা করলে কখনও সংকীর্ণ দলীয় চিন্তা- মাথায় আনা যাবে না। দলীয় চিন্তা মানুষকে ক্ষুদ্র করে। দলীয় চিন্তা মানুষের ভালো মূল্যবোধগুলোকে নষ্ট করে দেয়। মূল্যবোধের বিকাশের স্বার্থে দলের পরিবর্তে দেশকে সামনে আনতে হবে।
একটি বিষয় আমাদের জরিপের প্রয়োজন, তা হলো, ২০৪১ সালে আমরা উন্নত সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হতে হলে আমাদের জনশক্তির কোন খাতে কতজন উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে তার তথ্যভিত্তিক সংখ্যা। সেই অনুযায়ী সরকারকে একটি ব্যাপক ভিত্তিক স্কিম তৈরি করতে হবে। বাজেটে বরাদ্দ রাখতে হবে। হয়তো এই অবস্থার জন্য আমাদের প্রচুর সংখ্যক ডাক্তার, প্রকৌশলী, আমলাকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। আকর্ষণীয় বেতন কাঠামোও প্রণয়ন করতে হবে। দেশের প্রাইমারি শিক্ষা, মাধ্যমিক শিক্ষা ও কলেজ শিক্ষাকে সেই অনুযায়ী উন্নত করার জন্য ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করতে হবে। সেই কর্মপরিকল্পনা এখনই গ্রহণ করতে হবে। শুধু বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে আমরা ২০৪১ সালে উন্নত সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হতে পারব না।
লেখক: সাবেক সহসভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমএ, বিজেএমইএ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।