হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
যেসব দেশে গণতন্ত্র সীমিত ও পরিপূর্ণভাবে বিকশিত নয়, সেসব দেশে সরকার বিরোধী দলকে সহজে মেনে নেয় না। সরকারের আচরণ এমন থাকে যেন বিরোধী দল না থাকলেই ভালো। যদি না থাকত, তবে তার চেয়ে সুখী পৃথিবীতে আর কেউ হতো না। নিজেদের ইচ্ছা মতো, যেমন খুশি তেমন দেশ শাসন করা যেত। কারো কিছু বলার থাকত না। শাসন এবং শোষণ দুটোই সমানতালে চালানো যেত। সরকারবিরোধী কোনো দল থাকুক, তা আমাদের দেশেও ক্ষমতায় যারা থাকে, তারা যেন চায় না। তার মনোভাব এমন থাকে, যদি নিতান্তই থাকতে হয়, তবে যেন চুপ করে থাকে। চুপ না থাকলে দমন করে চুপ করিয়ে রাখা হবে। আবার দেশে গণতন্ত্র আছে, এ বিষয়টি বিশ্ব দরবারে দেখানোর জন্য নানা ফন্দিফিকিরও করা হয়। সংসদে অনুগত বা নামকাওয়াস্তে বিরোধী দল থাকারও ব্যবস্থা করা হয়, যে কিনা সরকারেও থাকবে আবার সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসে সরকারের গুণগান গাইবে। আমরা এখন তেমনই এক ব্যবস্থার মধ্যে বসবাস করছি। এতে সমস্যায় পড়েছে জনগণ। সাধারণত কার্যকর বিরোধীদলের কাজ হচ্ছে, শাসনব্যবস্থায় একটি চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স বা ভারসাম্য সৃষ্টি করা। সরকার অনেক সময় ভুল-ভ্রান্তি করে এবং কোটারি স্বার্থ রক্ষার্থে ভুল সিদ্ধান্ত নেয়। এই ভুল শোধরানোর কাজটি করে শক্তিশালী বিরোধীদল। সে সংসদে গঠনমূলক প্রতিবাদ করে, ওয়াক আউট করে, প্রয়োজনে মাঠে প্রতিরোধমূলক আন্দোলন গড়ে তুলে। আবার বিরোধীদল যদি ভুল বা অযৌক্তিক বিরোধিতা করে, তবে জনগণও তা সমর্থন দেয় না। সরকার ও বিরোধীদলের এই ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানের মাধ্যমেই দেশের গণতন্ত্র সুদৃঢ় হয় এবং জনগণ তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়। দেশ পরিচালক হিসেবে সরকারকে জনগণের মতামতের মূল্য দিয়ে চলতে হয়। বর্তমান সংসদে আমরা এর কোনো কিছুই দেখছি না। একটি নিষ্প্রাণ, নিস্তরঙ্গ সংসদ-যার ব্যাপারে সাধারণ মানুষের আগ্রহ খুবই কম। সংসদ কখন বসে, কখন শেষ হয় এবং কী আলোচনা হয়, এ বিষয়ে জনগণের খুব একটা আগ্রহ দেখা যায় না। এ নিয়ে অবশ্য সরকারের মাথাব্যাথা আছে বলে প্রতীয়মাণ হয় না। বরং সরকার এতেই খুব খুশি। সরকারের আচরণ এমন যে, জনগণ কী ভাবল বা কী চাইল, তাতে গুরুত্ব দেয়ার কিছু নেই। তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত এবং জনগণকে এ সিদ্ধান্তই মেনে নিতে হবে। তবে সরকারের জন্য মুশকিল হচ্ছে, দেশে সরকারবিরোধী বড় একটি দল রয়েছে, যে একাধিকবার ক্ষমতায় ছিল এবং বিরোধীদলেও ছিল। এ দলটিকে নিয়ে সরকার খুবই ডিস্টার্বড ফিল করছে। দলটিকে না নির্মূল করা যাচ্ছে, না তার বিরোধিতা সহ্য করা যাচ্ছে। দলটি যেন তার পথের কাঁটা হয়ে রয়েছে। এ দলটি যদি না থাকত, তবে সরকারের জন্য কতই না সুখের হতো! ‘গণতন্ত্র’ নামক অসহ্য শব্দটিও বারবার শুনতে হতো না।
দুই.
গণতন্ত্রে বিরোধী রাজনীতি অনস্বীকার্য। এমনকি কোনঠাসা হয়ে থাকলেও বিরোধীদলের উপস্থিতি থাকতে হয়। তা না থাকলে গণতন্ত্র বলে কিছু থাকে না। দেশে স্বৈরতন্ত্র বা একনায়কতন্ত্র কায়েম হয়। আবার বিরোধী দল ছাড়াও যে শাসন ব্যবস্থা নেই, তা নয়। এ ব্যবস্থাকে বলা হয় রাজতন্ত্র বা এক ব্যক্তির শাসন। কমিউনিস্ট দেশগুলোতেও বিরোধীদল থাকে না। পৃথিবীতে এ যুগে এমন শাসন ব্যবস্থা বিরল নয় এবং সেসব দেশের জনগণ তা মেনে নিয়েছে। তবে গণতন্ত্র এবং এর বিকাশ ও উন্মেষে বিরোধী রাজনৈতিক দলের বিকল্প নেই। বিরোধী রাজনৈতিক দল হয়ে উঠে ‘ভয়েস অব পিপল’ বা জনতার কণ্ঠ। তাদের মাধ্যমে সরকারের ভুল-ভ্রান্তি এবং গণবিরোধী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ প্রতিফলিত হয়। যুক্তিযুক্ত হলে জনগণও তাতে সায় দেয়। আমাদের দেশে ক্ষমতাসীনরা যেন কোনোভাবেই বিরোধীদলকে সহ্য করতে পারে না বা পারছে না। এ ধরনের আচরণের মাধ্যমে এটাই প্রকাশিত হয় যে, সে জনগণের কথা শুনতে অনিচ্ছুক। বিগত প্রায় পাঁচ বছর ধরে আমাদের দেশে সংসদের বিরোধী দলের অস্তিত্ব বা কার্যক্রম টের পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে মাঠে যে বিরোধীদল রয়েছে, তা সরকার কর্তৃক দমিত হয়ে আছে। অর্থাৎ সরকার চায় না তার বিরোধী কোনো শক্তি বা দল থাকুক। বরং বিরোধীদলকে কীভাবে নিঃশেষ করা যায়, এ প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হচ্ছে। এখন মাঠের বৃহৎ বিরোধীদল বিএনপিকে উদ্দেশ করে বলা হচ্ছে, আগামী নির্বাচনে না এলে তার অস্তিত্ব বলে কিছু থাকবে না। এর অর্থ হচ্ছে, সরকার প্রচ্ছন্নভাবে চায় বিএনপি নির্বাচনে না আসুক এবং তার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাক। তা নাহলে অস্তিত্বহীনতার কথা কেন বলবে? যদি বিএনপি নির্বাচনে না গিয়ে অস্তিত্বহারা হয়ে পড়ে, তবে তো সরকারের জন্যই ভালো। এ নিয়ে তার এতো মাথা ঘামানোর কী আছে! সরকারের এই মাথা ঘামানোর কারণ হচ্ছে, সরকারের পক্ষে বিএনপিকে বিলীন বা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে সরকার বিভিন্নভাবে বিএনপির অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ার কথা বলছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার কি আগামী নির্বাচন বিএনপিকে বাদ দিয়ে করবে বা করতে পারবে? আরেকটি ৫ জানুয়ারির মতো বিতর্কিত নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি ঘটাবে? যদিও ক্ষমতাসীন দল বলে দিয়েছে, আগামী নির্বাচনে বিএনপি আসবে কি আসবে না, এটা তার ব্যাপার। অর্থাৎ বিএনপিকে নিয়ে সরকারের মধ্যে এক ধরনের দ্বিমুখী কথাবার্তা চলছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ক্ষমতাসীন দল ভেতরে ভেতরে চাইছে বিএনপি যাতে নির্বাচনে না আসে। তাহলে সে বলতে পারবে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হয়েছে এবং এতে বিএনপি অংশ না নিলে তার কী করার থাকতে পারে! সরকারের এ ধরনের অজুহাতের অভাব নেই। ধরে নেয়া যাক, শেষ পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচনে গেল না এবং সরকার আরেকটি ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন করে ফেললো। বিএনপিও তা প্রতিহত করতে পারল না। তাহলে ক্ষমতাসীন দলের কথা মতো বিএনপি কীভাবে অস্তিত্বহীন হবে, এর একটি চিত্র কল্পনা করা কঠিন নয়। প্রথমত, ক্ষমতাসীন দল চাইবে, বিএনপি ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকানোর মতো আন্দোলন করুক এবং তাতে স্যাবোটাজের সুযোগ সৃষ্টি হোক। এর মাধ্যমে বিএনপিকে পুনরায় জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনের অপবাদ দিয়ে সন্ত্রাসী দল হিসেবে আখ্যায়িত করে দমন-পীড়ন ও নির্যাতনের মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। দ্বিতীয়ত, সরকার আরও কঠিন হয়ে মামলা-মোকদ্দমা দিয়ে বিএনপির শীর্ষ সারির নেতাদের জেল দিয়ে দেবে। এতে দল নেতৃত্ব শূন্য হবে এবং কর্মীরা দিশেহারা হয়ে পড়বে। দলটি অগোছালো ও বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়বে। ৫ জানুয়ারির পর দ্বিতীয়বারের মতো বিএনপির নেতা-কর্মীদেরকে ক্ষমতাসীন দলের নিশ্চিহ্নকরণের মুখে পড়তে হবে। পাশাপাশি সরকার বিএনপিকে উপেক্ষা করতে না পেরে কৌশলে দলটির সুবিধাবাদী নেতাদের দিয়ে নতুন আরেকটি বিএনপি সৃষ্টি করতে পারে। এভাবে বিএনপিকে খন্ডিত করে সরকারের কথা মতো বিএনপিকে মুসলিম লীগের মতো অস্তিত্বহীন দেখাতে পারবে। অন্যদিকে বিএনপি যদি ক্ষমতাসীন দলের অধীনে নির্বাচনে যায়, তাহলেও অস্তিত্বহীনতার ঝুঁকির মধ্যে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সংসদ না ভেঙ্গে নির্বাচন হলে তার প্রার্থীরা ক্ষমতাসীন দলের এমপিদের দাপটে এলাকা ছাড়া হয়ে পড়তে পারে। এতে বিএনপিকে ২০০৮ সালে পাওয়া ৩২ সিটের চেয়েও কম আসনে জিতিয়ে দেখানো হবে-জনগণ বিএনপির সাথে নেই, দলটি অস্তিত্বহারা হয়ে পড়ছে। দেখা যাচ্ছে, বিএনপি নির্বাচনে না গিয়ে প্রতিহত করতে ব্যর্থ হলে একদিকে সরকারের নিশ্চিহ্নকরণ প্রক্রিয়ায় পড়তে পারে, অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের অধীনে নির্বাচনে গেলেও ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বা দাপটের মধ্যে পড়ে শোচনীয় পরাজয়ের শিকার হতে পারে। অর্থাৎ ক্ষমতাসীন দল বিএনপিকে দুইভাবেই অস্তিত্বহীন করার সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। আবার নিজেকে অস্তিত্ববান করার জন্য যদি বিএনপি নিরপেক্ষ বা সহায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন আদায় করতে পারে বা আন্দোলনে সফল হয়, তবে উল্টো ক্ষমতাসীন দল বিপদে পড়ে যাবে। বলা যায়, আগামী নির্বাচন ক্ষমতাসীন দল এবং বিএনপি উভয়ের জন্যই অস্তিত্ব রক্ষার নির্বাচন। এদিক থেকে ক্ষমতাসীন দল এগিয়ে তার প্রশাসন শক্তির মাধ্যমে। যুক্তি হিসেবে রয়েছে, সংবিধান মোতাবেক নির্বাচন করা। অন্যদিকে বিএনপির ভরসা শুধু তার নেতা-কর্মীদের অস্তিত্ব রক্ষার কঠোর মনোভাব এবং ত্যাগ-তিথিক্ষা। পাশাপাশি সহায়ক সরকারের দাবী বাস্তবায়নে সরকারকে বাধ্য করা। এ কাজটি যে দলটির জন্য কঠিন থেকে কঠিনতর হবে, তাতে সন্দোহ নেই।
তিন.
আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপিকে অনেক বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হবে। একদিকে তার দাবী মোতাবেক সহায়ক সরকারের জন্য আন্দোলন করতে হবে, অন্যদিকে নির্বাচনেরও প্রস্তুতি নিতে হবে। নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে আন্দোলনের পাশাপাশি ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। কেন, কী কারণে দলটি প্রায় এক যুগ ক্ষমতার বাইরে, এ ব্যাখ্যা দেয়ার পাশাপাশি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় গেলে কী করবে, তাও জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে। একসঙ্গে দুটি কাজ করা কঠিন হলেও, তা করতে হবে এবং তা এখন থেকেই। এর মাধ্যমে দলটির সাংগঠনিক সক্ষমতা প্রমাণ করতে হবে। আমরা দেখছি, দলটির রাজনীতি শুধু প্রেস কনফারেন্স ও সভা-সেমিনারের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে রয়েছে। সরকারের ভুল-ত্রুটি এবং জনবিরোধী সিদ্ধান্ত সর্বোপরি সার্বিক ব্যর্থতার দিকগুলো জোরালোভাবে তুলে ধরতে পারছে না। এমনকি প্রেস কনফারেন্স ও সভা-সেমিনারের বক্তব্যেও তা উঠে আসছে না। পদ্মাসেতু নিয়ে দলটির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার এক বক্তব্যে সরকারকে অনেকটা দিশাহারা হয়ে পড়তে দেখা গেছে। এর ব্যাখ্যা দিতে সরকারকে অনেক কথা বলতে হয়েছে। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, যদি বিএনপির নেতারা সরকারের একটানা ৯ বছরের বিভিন্ন ব্যর্থতার কথা ক্রমাগত তুলে ধরে, তবে সরকারের জন্য তা অত্যন্ত মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে এবং জবাব দিতে ব্যতিব্যস্ত থাকতে হবে। এসব ব্যর্থতা তুলে ধরলে জনগণও তাতে সায় দেবে এবং তার সমর্থনে এগিয়েও আসবে। ব্যর্থতাগুলোর মধ্যে রয়েছে, সরকারের দাবী মোতাবেক খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশে খাদ্যসংকট দেখা দেয়া, লাখ লাখ টন খাদ্য আমদানি করা, সরকার প্রতিশ্রুত দশ টাকা কেজিতে চাল খাওয়ানোর বদলে চালের কেজি ৫০ টাকা হওয়া, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, ব্যাংকিং খাতে এন্তার দুর্নীতি, অর্থ লোপাট এবং লাখ লাখ কোটি টাকা পাচার হওয়া, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির দাম কয়েক গুণ বৃদ্ধি করা, শিক্ষাখাতে বেশুমার প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং শিক্ষামানের অবনতি হওয়া, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আয় কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেলেও সাধারণ মানুষের আয় কমে যাওয়া, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেপরোয়া হয়ে উঠা, খুন, গুম, অপহরণ বৃদ্ধি পাওয়া, মাদক চোরাচালানের সাথে সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতাদের জড়িয়ে পড়া, কর্মসংস্থান না হওয়া এবং কোটি কোটি মানুষের বেকার থাকাসহ অন্যান্য ব্যর্থতার বিষয়গুলো যদি তথ্য-উপাত্তসহ তুলে ধরা হয়, তবে বিএনপির রাজনীতি আরও গণসম্পৃক্ত হবে এবং সরকারও এসব ব্যর্থতার জবাব দিতে গিয়ে বেকায়দায় পড়বে। সরকার যেমন বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা দিয়ে তাদের আদালতে ব্যস্ত রেখেছে, তেমনি তার কাউন্টার হিসেবে বিএনপিও সরকারের খাতওয়ারি ব্যর্থতার তথ্য-উপাত্ত জনগণের সামনে তুলে ধরে সরকারকে ব্যতিব্যস্ত রাখতে পারে। বিএনপির নেতাদের এ কাজটি করতে দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে সরকার তার উন্নয়নের ফানুস ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে ঠিকই উড়িয়ে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষ এসব উন্নয়নের ফাঁকফোকড় ধরতে পারলেও তারা কিছু বলতে পারছে না। কারণ তাদের বলার প্ল্যাটফর্ম নেই। রাজধানীর লোকাল বাসগুলোতে উঠলে তাদের এ ক্ষোভের কথা কিছুটা শোনা যায়। অথচ জনগণের এসব ক্ষোভের কথা প্রকাশের সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফর্ম হওয়া উচিত বিএনপির। জনগণের এ ক্ষোভের সাথে সরকারের ব্যর্থতাগুলো যদি বিএনপি ধারাবাহিকভাবে বলে যেত, তবে সরকারের মধ্যে এক ধরনের মানসিক পীড়ন সৃষ্টি হতো। দলটি সরকারের ব্যর্থতার কথাগুলো যদি সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারে, তবে তার যেমন জনমত বৃদ্ধি পাবে, তেমনি সহায়ক সরকারের দাবীর প্রতিও জনসমর্থন বৃদ্ধির পথ সহজ হবে। এ কথা সর্বস্বীকৃত, যত কঠিন বস্তুই হোক, তার কোনো না কোনো দুর্বল জায়গা থাকে। তা চিহ্নিত করে যথাযথভাবে আঘাত করতে পারলে ভাঙ্গা সহজ হয়ে যায়। আর সরকারের তো অসংখ্য দুর্বল জায়গা থাকে। এসব জায়গা চিহ্নিত করে জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারলে সরকার যত কঠিন হোক না কেন, সে দুর্বল হতে বাধ্য। বিএনপিকে বুঝতে হবে, সরকার কৌশলে তাকে নির্বাচনকেন্দ্রিক বিষয় নিয়ে ব্যস্ত রাখছে, যাতে জনসম্পৃক্ত বিষয় এবং তার ব্যর্থতার বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে না পারে। এজন্য বারবার নির্বাচনের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসছে এবং ভয় দেখিয়ে বলছে, আগামী নির্বাচনে না এলে বিএনপি অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে। এ কথা বলা হচ্ছে, যাতে বিএনপির নেতারা পুরোপুরি নির্বাচনী ভাবনা নিয়ে ব্যস্ত থাকে এবং সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে কথা বলার সুযোগ না পায়।
চার.
পৃথিবীর যত বড় শক্তিই হোক না কেন, সে যদি অনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান হয় এবং নিজের সুরক্ষার জন্য নিñিদ্র বুহ্য তৈরি করে, তারপরও তার ভেতর একটা ভয় ও আতঙ্ক সবসময়ই কাজ করে। সর্বশক্তি দিয়ে নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টি করেও নিরাপদ বোধ করে না। ভয় থেকেই তার জন্য বিপজ্জনক শক্তিকে সে নিপীড়নের মাধ্যমে দমন করার প্রক্রিয়া অবলম্বন করে। নিপীড়িতরা যদি তা বুঝে দমন প্রক্রিয়া সহ্য করে ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি ও সাহস সঞ্চয় করে, তবে নৈতিকভাবে দুর্বল মহাশক্তির মধ্যেও কম্পন সৃষ্টি হয়। নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যে পুনরায় ক্ষমতাসীন হতে পারবে, এ নিয়ে তার মধ্যে সংশয় রয়েছে বলেই সে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে অনীহা প্রকাশ করছে। এই বাস্তবতা আওয়ামী লীগও জানে, সচেতন মানুষও জানে। বিএনপি যে জানে না, তা মনে করার কারণ নেই। ফলে আগামী নির্বাচনটি ক্ষমতাসীন দলের জন্য যেমন অস্তিত্ব রক্ষার, তেমনি বিএনপির জন্যও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার। বিএনপিকে বুঝতে হবে, এক যুগ ক্ষমতার বাইরে থেকে সে অনেক কিছুই হারিয়েছে, তার হারাবার কিছু নেই। তাই সে যদি জনস্পৃক্ত বিষয়গুলো ধারণ করে সাংগঠনিক শক্তির মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে দাবী আদায়ে সোচ্ছার হয়, তবে তার সাফল্য অবশ্যম্ভাবী।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।