পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বহুকাল ধরেই দূষণের নগরী হিসেবে রাজধানী চিহ্নিত হয়ে আছে। এ থেকে উত্তরণের কোনো উপায় ও উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। রাজধানীর সংশ্লিষ্ট সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলো যেন নির্বিকার হয়ে রয়েছে। এর ফলে দূষণের মাত্রা এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, এখানে সুস্থ্যভাবে বসবাস করা কল্পনাতীত হয়ে পড়েছে। তারপরও বাধ্য হয়ে নাগরিকদের নানা রোগ-বালাইয়ে আক্রান্ত হয়ে জীবনযাপন করতে হচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ ও পানি দূষণসহ অপরিচ্ছন্ন পরিবেশের কারণে পুরো রাজধানী যেন বিশাল এক মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উদ্যোগ নেয়া দূরে থাক, সহনীয় পর্যায়ে রাখারও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই। পরিবেশবিদ ও নগরবিদরা প্রতিনিয়ত রাজধানীকে দূষণমুক্ত করার বিভিন্ন কারণ ও উপায় বাৎলে দিলেও, তাতে সংশ্লিষ্ট সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো রা করছে না। নিশ্চল ও বিকারহীন হয়ে রয়েছে। তাদের আচরণ এমন হয়ে পড়েছে, যেভাবে চলছে চলুক। রাজধানী নিয়ে এমন উদাসীনতা বিশ্বের আর কোথাও আছে কিনা জানা নেই। অথচ রাজধানীকে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন ও দূষণমুক্ত রাখার সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের অভাব নেই। অভাব শুধু প্রতিষ্ঠানগুলোর সদিচ্ছা এবং কার্যকর উদ্যোগের। বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, রাজধানীতে যারা বসবাস করছে, এই অসহনীয় পরিস্থিতির মধ্যেই যেন তাদের বাস করতে হবে।
ঢাকা অনেক আগেই বসবাসের যোগ্যতা হারিয়েছে। যুক্তরাজ্যের ইকোনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ই আই ইউ)-এর বিশ্বব্যাপী জরিপে ঢাকা বেশ কয়েকবার বসবাসের অযোগ্য নগরীর শীর্ষে ঠাঁই পায়। এমনকি ঢাকাকে অসভ্য নগরী হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়। তারপরও রাজধানীর কর্তৃপক্ষের কোনো হুশ হয় নাই। বরং দিন দিন ঢাকার সার্বিক পরিস্থিতি খারাপ থেকে খারাপের দিকে যাচ্ছে। শব্দ ও বায়ু দূষণ এমন মাত্রায় পৌঁছেছে যে সুস্থ্য মানুষও অসুস্থ্য হয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি বিপদে রয়েছে বয়স্ক ও শিশুরা। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ু দূষণের কারণে ব্রংকাইটিস, অ্যাজমা ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মধ্যে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে ৬ মাস বয়সী শিশু, বৃদ্ধ এবং চল্লিশোর্ধ মানুষ। এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই রাজধানী একটি অসুস্থ্য মানুষের নগরীতে পরিণত হবে। বায়ু দূষণের মূল কারণের মধ্যে রয়েছে, অপরিকল্পিতভাবে সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি, গাড়ির কালো ধোঁয়া, সিটি করপোরেশনের বর্জ্য এবং বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ। উন্নয়নমূলক কাজ করতে গিয়ে কোনো ধরনের নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না। ফলে এ থেকে উৎপন্ন ধুলায় বাতাস ধুসর হয়ে পড়ছে এবং এর ঘনত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে শ্বাস নিতে মানুষের কষ্ট হচ্ছে। এই ধুলার সাথে মিশ্রিত হচ্ছে গাড়ির ও বিভিন্ন কলকারখানা থেকে নিঃসরিত কালো ধোঁয়া। এই ধোঁয়ার বিষাক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনো অক্সাইড বাতাসে মিশে ভয়াবহ দূষণ সৃষ্টি করছে। বলা যায়, ঢাকাকে গ্যাস চেম্বারে পরিণত করছে। বায়ু দূষণের পাশাপাশি শব্দ দূষণ অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। গাড়ির হাইড্রলিক হর্ণ, উচ্চশব্দে মাইকের ব্যবহার, কলকারখানার শব্দসহ উন্নয়নমূলক কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির শব্দ অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। সাধারণত আবাসিক এলাকা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালের সামনে শব্দের মাত্রা নির্ধারণ করা থাকলেও তা কেউই মানছে না। এসব এলাকায় শব্দের মাত্রা ৩৫ ডেসিবলে সীমাবদ্ধ থাকার কথা বলা হলেও তা ৬০ ডেসিবলে পৌঁছেছে। রাজধানীর আভ্যন্তরীণ দূষণ যেমন সীমাছাড়া হয়ে পড়েছে, তেমনি এর চার পাশ দিয়ে বহমান নদ-নদীর দূষণও চলছে বছরের পর বছর ধরে। রাজধানীর প্রায় সব স্যুয়ারেজ লাইন এসব নদ-নদীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এর সঙ্গে কলকারখানার বিষাক্ত কেমিক্যাল, সিটি করপোরেশনের বর্জ্যও ফেলা হচ্ছে। যে বুড়িগঙ্গাকে কিছুটা দূষণমুক্ত করার জন্য হাজারিবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প সাভারে সরিয়ে নেয়া হয়েছে, সেই ট্যানারি শিল্পই আবার ধলেশ্বরি নদী দূষণ শুরু করেছে। বলা হয়, বুড়িগঙ্গায় কোনো মাছ পাওয়া যায় না। এর কারণ পানিতে যে মাত্রায় অক্সিজেন থাকার কথা, তা এ নদীর পানিতে নেই। অন্যদিকে সাভারের ট্যানারি শিল্পের কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার সঠিকভাবে চালু না করায় বিষাক্ত বর্জ্য ধলেশ্বরিতে পড়ে সেখানের পরিবেশ-প্রতিবেশ ইতোমধ্যে ধ্বংস করতে শুরু করেছে। এছাড়া ফুটপাত দখল, যত্রতত্র গাড়িপার্কিং, নিত্যদিনের যানজট, রাজধানীমুখী জনসংখ্যার স্রোত, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ঢাকাকে ভারাক্রান্ত এবং বসবাস অনুপযোগী করে ফেলা হয়েছে।
রাজধানীর বহুমাত্রিক দূষণ রাতারাতি প্রতিকার করা সম্ভব নয়। তবে তা প্রতিরোধের উদ্যোগ নেয়া যায়। দুঃখের বিষয়, সিটি করপোরেশনসহ অন্যান্য সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর এ ব্যাপারে তেমন কোনো উদ্যোগই নেই। কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার পরিবর্তে তারা একের দায় অন্যের ওপর চাপানোর মধ্যে রয়েছে। দায় চাপানোর এ অপসংস্কৃতি যদি চলতেই থাকে, তবে সমস্যার সমাধান কোনোভাবেই হবে না। আমাদের কথা হচ্ছে, রাজধানীর ভয়াবহ সমস্যা থেকে উত্তরণে সেবাদানকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্মিলিত উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। পারস্পরিক দোষারোপের মধ্যে থাকলে সমস্যার সমাধানের পরিবর্তে তা বাড়তেই থাকবে। শব্দদূষণ প্রতিরোধে ইতোমধ্যে আদালত নির্দেশ দিয়েছে। এ নির্দেশ বাস্তবায়ন করা জরুরি। বায়ু দূষণের যেসব চিহ্নিত কারণ রয়েছে, সেগুলো সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে পরিকল্পনা নিতে হবে। রাজধানীকে বাসযোগ্য করে তুলতে জনগণকে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নেয়া অপরিহার্য। আমরা নি¤œ মধ্য আয়ের দেশ থেকে মধ্য আয়ের দেশে এবং আগামী মার্চে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উপনীত হবো বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হচ্ছে, অথচ রাজধানীকে বেহাল দশা থেকে মুক্ত করার কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই। এ ধরনের বৈপরিত্য কোনোভাবেই উন্নয়নের সূচক বহন করে না।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।