পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
১৯০৬ সালে নওয়াব সলিমুল্লাহর উদ্যোগে ঢাকায় অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম শিক্ষা সম্মেলনের যে বর্ধিত অধিবেশনে ভারতের মুসলমানদের জন্য একটি স্বতন্ত্র মুসলিম সংগঠন (নিখিল ভারত মুসলিম লীগ) প্রতিষ্ঠিত হয় সেখানে তৎকালীন ভারতবর্ষের অন্যতম মুসলিম নেতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহও আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। কিন্তুু তিনি যে আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে ছিলেন। তাঁর যুক্তি ছিল, এর ফলে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে পরিচালিত বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে অনৈক্য সৃষ্টির কারণে স্বাধীনতা সংগ্রাম দূর্বল হয়ে পড়বে। এ ধরনের মনোভাবের কারণেই তিনি “হিন্দু-মুসলিম মিলনের অগ্রদূত” আখ্যা লাভ করেন। পরবর্তীতে ‘হিন্দু-মুসলিম মিলনের অগ্রদূত’ এই মুহম্মদ আলী জিন্নাই ১৯১৩ সালে মুসলিম লীগে যোগ দিলেও সকলকে সর্তক করে দেন, যেন অকারণে কংগ্রেসের সাথে মুসলিম লীগ বিতÐায় জড়িত না হয়ে পড়ে।
কিন্তুু বাস্তবতা বড় কঠিন। বাহ্যত কংগ্রেস হিন্দু মুসলিম সকল সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক সংগঠন হিসাবে পরিচিতি লাভ করলেও বাস্তবে ভারতের সংখ্যাগুরু হিন্দু সম্প্রদায়ের অতিরিক্ত প্রভাব থেকে কখনও কংগ্রেস মুক্ত হতে সমর্থ হয়নি। ফলে এককালের ‘হিন্দু-মুসলিম মিলনের অগ্রদূত’ মুহম্মদ আলী জিন্নাহই পরবর্তী কালে তাঁর দ্বিজাতিতত্বের আলোকে অবিভক্ত ভারতবর্ষকে হিন্দু-মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় বিভক্ত করে সেসব একাধিক স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের দাবীতে ১৯৪০ সালে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব পাশ করে পাকিস্তান সৃষ্টির দাবীতে আন্দোলন শুরু করতে বাধ্য হন। সেই আন্দোলনের ফলশ্রæতিতে ১৯৪৭ সালে প্রথমে ভারত বিভাগ এবং পরে ১৯৭১ সালে লাহোর প্রস্তাবের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হিসাবে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়। এভাবে সে দিনের বৃটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষ বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান নামের যে তিনটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্রের পরিচিতি লাভ করেছে জাতিসংঘে, তাতেই ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের বাস্তবতা প্রমাণিত হয়েছে সারা বিশ্বে।
১৭৫৭ সালে যে পলাশী বিপর্যয়ের মাধ্যমে তদানীন্তন ভারতবর্ষে সা¤্রাজ্যবাদী বৃটেনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় সেই বিপর্যয়ের মূলে ছিল বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদ্দৌলার দরবারের এক শ্রেণীর অমাত্যের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প উসকে দেয়ার লক্ষ্যে বেছে নেয়া নবাব দরবারের এক শ্রেণীর অমুসলিম অমাত্য, যাদের মধ্যে ছিলেন জগৎ শেঠ, রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ, উমিচাঁদ প্রমুখ। এভাবে নবাব দরবারের অমুসলিম অমাত্যদের সঙ্গে ইংরেজদের চক্রান্ত চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছার পর নবাবের সিপাহ সালার মীর জাফর আলী খাঁকে সিংহাসনের লোভ দেখিয়ে এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করা হয়। মীর জাফর আলী খানের মধ্যেও নবাব হওয়ার একটা সুপ্ত বাসনা কাজ করছিল। ফলে সহজেই তিনি এ লোভনীয় প্রস্তাবে রাজী হয়ে যান। কিন্তু এভাবে সিরাজুদ্দৌলার পরাজয় বরণ ও নিহত হবার পর মীর জাফর আলী খান বাংলার সিংহাসনে সমাসীন হবার অল্প দিনেই বুঝতে পারলেন, তাঁকে নামকে ওয়াস্তে নবাব করা হলেও আসল ক্ষমতা চলে গেছে ইংরেজদের এবং তাদের অমুসলিম সহযোগীদের হাতে।
পলাশীতে যুদ্ধ’যুদ্ধ প্রহসনের মাধ্যমে নবাব পক্ষের যোদ্ধারা স্বাধীনতা রক্ষার লক্ষ্যে কোন কার্যকর ভূমিকা পালন করতে না পারলেও এর পর একশ বছর ধরে স্বাধীনতা ফিরে পাওয়ার লক্ষ্যে মুসলমানরা নানা ভাবে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যান। এসব সংগ্রামের মধ্যে ছিল উত্তর বঙ্গের ফকীর আন্দোলন, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার সংগ্রাম, ফারায়েজী বিদ্রোহ, রংপুর, নোয়াখালী, ত্রিপুরা প্রভৃতি অঞ্চলের মুসলিম কৃষকদের বিদ্রোহ। পলাশী বিপর্যয়ের অল্প দিনের মধ্যে পূর্বতন ভূমি ব্যবস্থা পরিবর্তন করে ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নামে যে নতুন ভূমি ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয় তার মাধ্যমে দেশে ইংরেজ ভক্ত এমন এক নব্য জমিদার গোষ্ঠী গড়ে তোলা হয় যার সিংহভাগই ছিল হিন্দু।
পলাশী বিপর্যয়ের পর দীর্ঘ একশ বছর এসব সশস্ত্র সংগ্রামে মুসলমানরা অংশগ্রহণ করলেও তারা বৃহত্তর প্রতিবেশী হিন্দু সম্প্রদায়ের অসহযোগিতা এবং ইংরেজদের পক্ষ অবলম্বন করায় এককালের স্বচ্ছল মুসলমান সমাজ ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে উপনীত হওয়ায় মুসলমানদের সম্পূর্ণ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার লক্ষ্যে অস্থায়ীভাবে হলেও উত্তর ভারতের স্যার সৈয়দ আহামদ খাঁ, বাংলার নবাব আবদুল লতিফ প্রমুখ মুসলিম নেতৃবৃন্দ ইংরেজদের সঙ্গে সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করে মুসলমানদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ও উন্নত করে তোলার প্রয়াস পান।
এই সহযোগিতা যুগের এক পর্যায়ে প্রধানত প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে ১৯০৫ সালে সেকালের বাংলা বিহার উড়িষ্যা নিয়ে গঠিত বিশাল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিকে বিভক্ত করে ঢাকায় রাজধানীসহ ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’ নামের একটি নতুন প্রদেশ সৃষ্টি করা হয়। এতে দীর্ঘ অবহেলিত পূর্ব বঙ্গের জনগণের উন্নয়নের কিছুটা সুযোগ হওয়ায় নবাব সলিমুল্লাহ এর প্রতি সমর্থন দান করেন। কিন্তু কলিকাতা-প্রবাসী হিন্দু জমিদাররা পূর্ববঙ্গে অবস্থিত তাদের জমিদারীতে তাদের প্রভাব হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কায় বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন সৃষ্টি করে বসেন। যে হিন্দু নেতৃবৃন্দ পলাশীর পর থেকে সব সময় ইংরেজদের প্রতি একটানা সমর্থন দিয়ে আসছেন, তাদের এ ধরনের অভাবিত বৈরী আচরণে ইংরেজ শাসকরা খুবই ভীত হয়ে পড়েন এবং মাত্র কয়েক বছরের মাথায় তারা বঙ্গভঙ্গ বাতিল ঘোষণা করে তাদের পুরাতন মিত্রদের সন্তুষ্টি সাধনের প্রয়াস পান। বঙ্গ ভঙ্গ রদ হওয়ায় পূর্ববঙ্গের জনগণের উন্নতির সম্ভাবনা তিরোহিত হয়ে যাবার ফলে সহযোগিতা যুুগের অন্যতম নেতা নবাব সলিমুল্লাহ ইংরেজদের প্রতি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন। তাঁর ক্ষোভ প্রশমনের লক্ষ্যে ইংরেজ শাসকরা ১৯১১ সালে তাঁর অন্যতম দাবী ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রæতি ঘোষণা করেন।
এতেও গুরুতর আপত্তি কলিকাতা প্রবাসী হিন্দু জমিদারদের। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে তাদের যুক্তি (কুযুক্তি!) ছিল এর দ্বারা নাকি বঙ্গ মাতার অঙ্গচ্ছেদের মত পাপ হবে। এবার তাদের বক্তব্য হলো, ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে তার দ্বারা নাকি বঙ্গ-সংস্কৃতি বিভাজনের মত অন্যায় সাধিত হবে। তবে তাদের আরেকটি বক্তব্যের মধ্যদিয়ে তাদের মনের আসল কথাটা ফাঁস হয়ে পড়ল। তাদের এ বক্তব্য ছিল : পূর্ব বঙ্গের অধিকাংশ মানুষ অশিক্ষিত মুসলমান চাষাভূষা, তাই তাদের উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকায় কোন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ পূর্ববঙ্গের অধিকাংশ মানুষ অশিক্ষিত চাষাভূষা, তারা তাই থাক, তাদের শিক্ষা বা উচ্চশিক্ষার জন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন নেই ঢাকায়। এভাবে এক বাধার পর আর এক বাধা উঠতে থাকার কারণে সরকার কর্তৃক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণার এক দশক পর ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার যাত্রা শুরু করতে সক্ষম হয়। তাও আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে। পূর্ববঙ্গের অন্যান্য এলাকা আগের মতই কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন থাকে। এই সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাবার লক্ষ্যে পূর্ববঙ্গকে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।
ভারতের এক শ্রেণীর হিন্দু নেতার মধ্যে যাত্রাতিরিক্ত হিন্দুত্ববাদী মনোভাব এককালে বৃটিশ-শাসিত ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে ঐক্য সৃষ্টির পথে কারণে অকারণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতো বলে তার কুপ্রভাব এতো দিন পরও যে ভারতের অনেক রাজনৈতিক নেতার মধ্যে ব্যাপকভাবে রয়ে গেছে, তার এক বড় প্রমাণ ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এখন সেই ভারতের কট্টর হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপির নেতৃত্বেই পরিচালিত হচ্ছে।
এখানেই শেষ নয়। ভারতের প্রাচীনতম যে রাজনৈতিক দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, যার নেতৃত্বে বৃটিশ শাসনের হাত থেকে ভারত একটানা দীর্ঘদিন সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভের গৌরব অর্জন করে, সে দলটি তাদের হারানো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ফিরে পাবার আশায় তার দীর্ঘদিনের লালিত আদর্শ ধর্মনিরপেক্ষতা বর্জন করে কট্টর সাম্প্রদায়িক শাসক দলটির সঙ্গে হিন্দুত্ববাদী আদর্শের প্রতি আনুগত্যের প্রশ্নে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছে। কলিকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে আমরা এ তথ্য জানতে পেরেছি। আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত ঐ প্রতিবেদনটি গত রবিবার ২৪ ডিসেম্বর ঢাকার দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় পুন:প্রকাশিত হয়। নীচে সেটি হুবহু তুলে ধরা হল :
‘‘মন্দিরে পূজা দিয়েই গুজরাটে নির্বাচনী প্রচার শুরু করেছিলেন রাহুল গান্ধী। আর ফল বেরোনোর ঠিক পাঁচ দিনের মাথায় শনিবার ফের মন্দিরে পূজা দিলেন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী। এবার তিনি গেলেন সোমনাথ মন্দিরে। খবর আনন্দবাজার পত্রিকার।
‘‘তিন দিনের এ সফরে ১ দিন আহমেদাবাদ গিয়েছেন রাহুল। সেখানে তিনি নবনির্বাচিত বিধায়কদের পাশাপাশি দলীয় কর্মীদের মধ্যে নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে বৈঠকে বসবেন। দলীয় সূত্রে খবর, গুজরাটে বিজেপির সঙ্গে এত ভাল লড়াইয়ের পরও কেন শেষটা সেই অর্থে ভাল হলো না, সেটা পর্যালোচনা করতেই এই সফর। পাশাপাশি দলের আগামী দিনের নীতি কি হবে সেটাও ঠিক হওয়ার কথা ওই বৈঠকে।
‘‘এবারের গুজরাট নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে ছিল গোটা দেশ। প্রধানমন্ত্রীর রাজ্যে তার দলকে ধরাশায়ী করতে গুজরাটের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটে বেরিয়েছিলেন রাহুল। রাজ্যের যেখানে নির্বাচনী প্রচারে গেছেন, সেখানেই মন্দিরে পূজা দিয়েছেন। পূজা দেয়া নিয়েও তৈরি হয়েছিল বিতর্ক। রাহুল হিন্দু কি না তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল বিজেপি। যদিও নিজেকে শিবভক্ত বলে দাবি করে পাল্টা জবাব দিয়েছিলেন তিনি।
‘‘গুজরাটে ৯৯টি আসন পেয়ে বিজেপি জিতেছে। কংগ্রেস পেয়েছে ৮০টি। প্রথম থেকেই বিজেপি দাবী করে আসছিল ১৫০টি আসন পাবে। কিন্তু ফল বেরোনোর পর ছবিটাই বদলে যায়। ১০০টার গÐিও টপকাতে পারেনি তারা। পরে যদিও এক নির্দল প্রার্থী সমর্থন করায় সংখ্যায় ১০০তে দাঁড়ায়।
‘‘তবে এবার যেভাবে ৮০টি আসন নিয়ে উঠে এসেছে, তাতে বিশ্লেষকরা বলছেন কংগ্রেস বিজেপির আত্মবিশ্বাসে কিছুটা হলেও চিড় ধরাতে সক্ষম হয়েছে। এই রণনীতিকেই হাতিয়ার করে ২০১৯ এর লক্ষ্যে এগোতে চাইছেন রাহুল। তাই কংগ্রেস নেতারা বলছেন, কংগ্রেস সভাপতির এই সফর যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।”
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।