Inqilab Logo

শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

এখন ভারতের দর্শকও আমাদের নাটক দেখে -কায়সার আহমেদ

রিয়েল তন্ময় | প্রকাশের সময় : ২৭ অক্টোবর, ২০২২, ১২:০০ এএম

নাট্যনির্মাতা কায়সায় আহমেদের পরিচালনায় তিনটি ধারাবাহিক নাটক প্রচারিত হচ্ছে তিন টেলিভিশন চ্যানেলে। দীপ্ত টিভিতে বকুলপুর, আরটিভিতে গোলমাল ও এটিএন বাংলায় স্বপ্নের রানী। একই সঙ্গে একই পরিচালকের তিনটি ধারাবাহিক নাটক প্রচার হওয়া বিশ্বে বিরল ঘটনা। তিন ধারাবাহিকের গল্পের ধারাবাহিকতা, নির্মাণ প্রক্রিয়া ও শিল্পীদের শিডিউল সমন্বয় করা অত্যন্ত কঠিন একটি কাজ। এ কাজটি সুষমভাবে করছেন কায়সার আহমেদ। এ কাজ কিভাবে সমন্বয় করছেন এবং সমসাময়িক অন্যান্য প্রসঙ্গ নিয়ে তার সাথে কথা হয়।
একসঙ্গে আপনার তিনটি ধারাবাহিক প্রচার হচ্ছে। কাজের সমন্বয় করছেন কিভাবে?
এটা আমার জন্য নতুন কিছু নয়। অতীতেও আমার তিন-চারটি ধারাবাহিক একসঙ্গে প্রচার হয়েছে। আমি শিডিউল এমনভাবে করি যাতে, একটির সাথে আরেকটির সমন্বয় থাকে। একসাথে দুই-তিন মাসের শুটিং করে রাখি। তিন মাসের শুটিংকে এমনভাবে শিডিউল করি যাতে একমাসের মধ্যে তা শেষ করতে পারি। তারপর এডিটিংয়ের জন্য ৫ দিন সময় রাখি। আবার এক মাসের শুটিংয়ের কাজটি এক সপ্তাহ বা ১৫ দিনে সম্পন্ন করি। এমনভাবেই শুটিং রাখি যে, একটা কাজের সাথে আরেকটা কাজের যেন বাধা সৃষ্টি না হয়। প্রত্যেকটি কাজের জন্য শিডিউলটা কঠোরভাবে মেইনটেইন করি।
শিল্পীদের শিডিউল নিয়ে কোন বিপর্যয় হয় কিনা?
না, কোন সমস্যা হয়না। কারণ হচ্ছে, এটি ছকের মধ্যে করা হয়। আগে থেকেই জানি, আমার নাটকের যেসব চরিত্রে শিল্পীরা অভিনয় করছেন, তাদের শিডিউল ঠিক করা থাকে। যেমন নভেম্বর মাসে কি কাজ করব, সেটা অক্টোবরেই শিডিউল করা থাকে, কিংবা ডিসেম্বরে কি কাজ করব তার পরিকল্পনা এখন থেকেই চলছে।
দেশীয় নাটকে দর্শকের বিমুখতার সময়ে একসঙ্গে তিন ধারাবাহিক নির্মাণ ও প্রচারের বিষয়টি ঝুঁকিপূর্ণ কিনা?
আসলে আমি একজন নির্মাতা। দেশীয় নাটক যে দর্শক দেখছে না, তা নয়। আবার আগের মতো যে দেখছে, তাও নয়। বর্তমানে কিছু কিছু নাটক ভারতেও কিন্তু জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। যেমন আমার বকুলপুর চলছে। আমার ভারতীয় অনেক দর্শক আছে। তারা আমাকে ফোন দেয়, নাম্বার জোগাড় করে ফোন দিয়ে বলে, আমরা প্রজেক্টর লাগিয়ে প্রশান্তি নিয়ে আপনার নাটক দেখি। আসলে তারাও বাংলাভাষার ভিন্ন গল্প ও প্রেক্ষাপটের নাটক দেখতে চায়। এটা আমাদের নাটকের জন্য একটা সুখবর।
ভারতের সিরিয়ালগুলো এতটা পপুলার কেন? আমাদের নাটকে কিসের কমতি আছে বলে মনে করেন?
কমতি অবশ্যই কিছুটা আছে। ভারতের একটা প্রজেক্ট করতে গেলে দেখবেন অনেক কাস্টিং। আমরা যে বাজেটটা নিয়ে কাজ করি, তার তুলনায় ওদের বাজেট অনেক বেশি। ওরা যখন একটা প্রজেক্ট করতে যায়, তখন তারা একটা গ্রুমিং করে নেয়। দেখবেন ভারতের বেশিরভাগ শিল্পী নতুন। ওরা বিভিন্ন নতুন শিল্পী নিয়ে আসে, তাদের গ্রুমিং করায়। তারপর তাকে ক্যামেরার সামনে হাজির করে। আমাদের দেশে নতুন শিল্পী নেয়ার ক্ষেত্রে চ্যানেলকে জিজ্ঞেস করতে হয়। চ্যানেল আবার ¯পন্সরমুখী, ¯পন্সররা ওমুক আর্টিস্টকে চিনে কিনা বা তাদের ব্র্যান্ডিং তাকে দিয়ে করবে কিনা, এ বিষয়গুলো থাকে। ফলে আমাদের নাটক পারফেক্টলি করা যাচ্ছে না বাজেটের কারণে। এখানে মূল হচ্ছে বাজেট। এ থেকে আমাদের বের হতে হবে। সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে। চ্যানেলকেও এগিয়ে আসতে হবে। যারা ¯পন্সর দিচ্ছে, তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে, চ্যানেলকেও বাঁচাতে হবে। তাদের ¯পন্সর করতে হবে নতুন শিল্পীদের পেছনে। এতে নতুন শিল্পী যেমন তৈরি হবে, তেমনি গল্পে ভিন্নতাও আসবে। আমরা যদি সম্মিলিতভাবে উদ্যোগী হই, তাহলে ভারতের সিরিয়ালগুলোর মতো দর্শকপ্রিয় করা সম্ভব।
একসময় বাংলাদেশের নাটক পশ্চিমবঙ্গে অনেক জনপ্রিয় ছিল। বর্তমানে তা দেখা যায় না। এর কারণ কি?
সেই সময় যখন নাটক নির্মান হতো বা আমরা নাটক নির্মাণ করতাম, তখন সময় কিন্তু গ্রুমিং করা হতো। গল্পের চরিত্র বুঝে, ভেবে, গল্পটা বুঝে তারপর কাজ করা হতো। এখন শিল্পীদের এত ব্যস্ততা বেড়ে গেছে যে সে সময় তারা পান না। শুধু শিল্পীদের ব্যস্ততা নয়, আমরা যারা নির্মাতা আছি বা অন্যান্য যারা আছে, সবারই ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। ফলে শিল্পীদের ওই ভাবনার সময়টুকু আর নেই। আগে শুধু বিটিভি ছিল, এখন অনেক চ্যানেল। কাজের সংখ্যা বেশি। এজন্য কেউ স্থিরভাবে যে চিন্তা করবে বা একটা প্রজেক্ট নিয়ে ভাববে, সেই সময়টুকু এখন কারো নেই। এ কারণে এক ঘাটতি রয়েছে। তবে আমি মনে করি, প্রত্যেকেরই উচিৎ চিন্তা-ভাবনা এবং শ্রম দিয়ে একটি প্রজেক্ট দাঁড় করানো। তাহলে, ভারতের সিরিয়ালের মতো আমরাও দর্শক আকৃষ্ট করতে পারব।
বাংলাদেশী দর্শকদের দেশীয় নাটকের প্রতি বিমুখ হওয়ার কারণ কি?
এখন যে ভালো নাটক হচ্ছে না, তা নয়। তবে আরও ভালো নাটক নির্মান করতে হবে। ছোটবেলায় আমরা অয়োময়, সংশপ্তকের মতো নাটক দেখতাম । কবে এই নাটক প্রচার হবে, তার জন্য বসে থাকতাম। নাটকগুলোর গল্প আটকে রাখতো। এখন অনেক চ্যানেল, অনেক নাটক। এর মধ্যে দর্শককে ভালো গল্প দিয়ে ধরে রাখতে হবে। ভালো গল্পের প্রতিযোগিতা করতে হবে। শুধু তাইনা নাটকের বাজেটও বাড়াতে হবে। একমাত্র বাজেটের কারণে আমরা আটকে আছি। অনেক কিছু করতে পারিনা।
তিন ধারাবাহিকের তিন ধরনের গল্প নিয়ে কাজ করতে গিয়ে সমস্যার সৃষ্টি হয় না? কিভাবে সামাল দেন?
এটা বলতে পারেন, অভ্যাস হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে একসঙ্গে একাধিক ধারাবাহিক নিয়ে কাজ করছি। ফলে কোন সমস্যা হছে না। আগে ফিল্মে ছিলাম। ’৯৭ সালে ফিল্ম থেকে নাটকে আসি। আসার পর থেকে এই পর্যন্ত চলছি। ধারাবাহিকভাবেই আমার দুইটা-তিনটা নাটক চ্যানেলে থাকেই। এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের বিরতী পড়ে নাই। বলতে পারেন, একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকা এবং অভ্যস্ত হয়ে পড়ায় সমস্যা হয় না।
শুধু কি ব্যবসার জন্য আপনি তিনটি ধারাবাহিক একসঙ্গে নির্মাণ ও প্রচার করছেন?
মোটেই না। শুধু ব্যবসার জন্য নির্মাণ নয়। এক্ষেত্রে মানের সাথে আপস করি না। কোন ছাড় দেইনা। আগেই বলেছি, ভাল নাটকের জন্য ভালো বাজেট প্রয়োজন। সীমিত বাজেটের মধ্যে যতটুকু পারি করে যাই। কারণ, ইন্ডাস্ট্রি এবং বাজারটাও তো ধরে রাখতে হবে।
শেষ পর্যন্ত নাটকের গল্পের ধারাবাহিকতা ও মান ধরে রাখা কি সম্ভব হয়?
খুব সুন্দর কথা বলেছেন। অনেক সময় দেখা যায়, আমার নাটকে তিনটা স্টার কাস্টিং আছে। একটা সময় দেখা যায়, তিনজন স্টারকেই আমার একসঙ্গে লাগবে। যখন নাটকটা প্রচার শুরু হয়, দেখা যায় কোন ভাবেই তিনজন স্টারের শিডিউল মিলাতে পারলাম না, বা এই শিল্পীটা আমাকে শিডিউল দিলো না, তখন বাধ্য হয়ে আমাকে নাটক চালানোর জন্য বাকি দুই শিল্পীর সাথে মিল রেখে তার কানেক্টিং চরিত্রের সাথে মিলিয়ে গল্প ঘুরাতে হবে। যার কারণে, শেষ দিকে এসে একটু সমস্যা হয়। তবে আমি চেষ্টা করি যেন গল্পের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা যায়।
টেলিভিশন নাটকের সবচেয়ে বড় সংকট কী?
বাজেট সংকট। বাজেটের কারইেই আমরা অনেক কিছু করতে পারছি না, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও।
একটি ভালো নাটক নির্মানে কত বাজেট দরকার?
আসলে একটা নাটকের বাজেট নির্ভর করে গল্প, কাস্টিং বা নাটকের অ্যারেজমেন্ট বুঝে। নির্দিষ্ট করে বাজেট বলা যায় না। তবে একটি ভালো নাটক নির্মাণ করতে হলে ভালো বাজেটটা খুবই দরকার।
ভালো নাটক নির্মাণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান কি?
গল্প। নাটক নির্মাণে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হয় গল্পে। গল্প থাকতে হবে, চিত্রনাট্য থাকতে হবে। একটি ভালো গল্প একটি ভালো নির্মাণ। এখন যদি আমাকে একটা আজেবাজে গল্প এনে দিল, নির্মাণটাও কিন্তু আজেবাজে হবে। একটা ভালো গল্প হলে নির্মাণ চিন্তাও ভাল হবে।
বাংলাদেশী নাটকে বর্তমানে অনেকটা অস্থিরতা ও অশ্লীলতা দেখা যাচ্ছে। দেশের সংস্কৃতির জন্য এটা কতটা হুমকি?
খুবই সুন্দর প্রশ্ন। আমরা বাঙ্গালী, বাংলাকে ভালোবাসা উচিত। টেলিভিশন মিডিয়া হচ্ছে, একটা ড্রয়িং রুম মিডিয়া। এখানে মা-বাবা ও সন্তানরা বসে নাটক দেখে। নাটক দেখে তারা যেমন বিনোদন পাবে, তেমনি কিছু শিখবেও। দুঃখের বিষয়, ইদানিং অনেক নাটকে অশালীন ভাষা প্রয়োগ করা হচ্ছে। যারাই করছে তাদেরকে বলব, আপনাদের ঘরেও তো মা, ছেলে-মেয়ে আছে। নাটকটা দর্শকদের একটা শেখার জায়গা, আপনাদের দেখেই সন্তানরা শিখবে। এ বিষয়টি বিবেচনা করে নাটকের ভাষা প্রয়োগের ক্ষেত্রে আপনাদের সচেতন হওয়া উচিৎ।
এসব নাটকের কিন্তু ভিউস হচ্ছে...
প্রশ্ন হচ্ছে, কারা দেখছে? সাময়িক এই ভিউ’র জন্য দেশের সংস্কৃতিকে বিনষ্ট করার এমন প্রবণতা অত্যন্ত দুঃখজনক। এসব দেখাতে দেখাতে পরে তারা আর কি দেখাবেন?
সিনেমা বানানোর কোন পরিকল্পনা আছে কি?
অবশ্যই পরিকল্পনা আছে। এখন তো ভালো একটা সময় যাচ্ছে। যেহেতু ফিল্ম থেকে আসছি আমি। ফিল্মের প্রতি আমার তো আলাদা একটা দরদ আছেই। একটা ভালো গল্পের খোঁজে আছি। ইনশাআল্লাহ ফিল্ম করব, যদি বেঁচে থাকি।
গ্রামীণ প্রেক্ষাপটের নাটকে এখন প্রায়ই দেখা যায় হাস্যরসাত্মক। ৮০-৯০ দশকের গ্রামের নাটকগুলোতে কিন্তু সিরিয়াস গল্প দেখা যেত। এই ব্যাপারে কি বলবেন?
দিনে দিনে মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন হয়, রুচির পরিবর্তন হয়, ভাবের পরিবর্তন হয়। সেই সময়ের যে ভাবনাগুলো ছিল, এখন ভাবনাগুলো কিছুটা আধুনিক হয়েছে। সেই সময়ও আধুনিক ছিল। সেই সময়ের নাটক আর এ সময়ের নাটকের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, সেই সময় বাস্তবধর্মী ব্যাপার ছিল। তবে এখন সেধরনের চিত্রনাট্য এবং তা ফুটিয়ে তোলার ব্যাপারটা একটু কম আছে। তবে চেষ্টা করছি আমরা। এখনও কিছু কিছু ভালো নাটক হচ্ছে। সামনে হয়তো ভালো দিন আবার আসবে।
কখন কোন চ্যানেলে প্রচারিত হচ্ছে আপনার নাটক?
বকুলপুর যাচ্ছে দীপ্ত টিভিতে শনি থেকে বৃহ¯পতিবার রাত ৮ টায়। এটিএন বাংলায় চলছে রবি ও সোমবার রাত ৮ টা ৪০ মিনিটে স্বপ্নের রাণী, আরটিভিতে যাচ্ছে গোলমাল সোমবার থেকে বৃহ¯পতিবার রাত ৯টা ২০ মিনিটে। আরটিভির আরেকটা ধারাবাহিক করছি। নাম যাদুনগর। গ্রামীণ পটভূমির গল্প। হাডুডু খেলা নিয়ে। ইতোমধ্যে ৮০ পর্বের শুটিং শেষ হয়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: এখন ভারতের দর্শকও আমাদের নাটক দেখে -কায়সার আহমেদ
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ