হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
দেখতে দেখতে ২০১৭ সাল শেষ হতে চলল। ডিসেম্বরের শেষে বছরের যে সালতামামি প্রকাশিত হবে সেখানে জাতীয় আন্তর্জাতিক অনেক ঘটনাই উঠে আসবে। আমাদের জাতীয় ও আঞ্চলিক রাজনীতি-অর্থনীতি এবং আন্তজার্তিক দুনিয়ায় নানামাত্রিক ঘটনার মধ্য দিয়ে এ বছর বিশ্ব ইতিহাসে একটি নতুন মাইল ফলক রচিত হয়েছে। ২০১৭ সালে সূচিত ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিত আগামী দশক জুড়ে প্রভাব বিস্তার করতে থাকবে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। ২০১৭ সাল একদিকে যেমন গত দশকে সূচিত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তজার্তিক ভূ-রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে একটি বিপরীতমুখী টার্নিংপয়েন্ট তৈরী করেছে অন্যদিকে শত বছর আগে প্রথম মহাযুদ্ধের ফলাফল এবং আগামী দিনের বিশ্বনেতৃত্বের নতুন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মেরুকরণের শতবর্ষের পরিসমাপ্তির কালনির্দেশক হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। প্রথম মহাযুদ্ধের মাঝপথে ১৯১৭ সালের নভেম্বর মাসে বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বালফোর তৎকালীন বৃটিশ ইহুদি কমিউনিটি নেতা লর্ড রথশিল্ডকে লেখা এক সংক্ষিপ্ত চিঠিতে প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের জন্য একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছিলেন। বালফোর ডিক্লারেশন নামে পরিচিত সেই ঘোষণার মধ্য দিয়ে যুদ্ধে ইহুদিদের সর্বাত্মক সমর্থন বৃটিশ ও মিত্রদের পক্ষে চলে যায়। এর ফলে ক‚টনৈতিক শান্তি প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে একটি সম্ভাব্য শান্তিপূর্ণ যুদ্ধবিরতির প্রচেষ্টা নস্যাৎ হয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘাতের মধ্য দিয়ে জয়পরাজয় নিশ্চিত করে এর ফলাফল নিজেদের পক্ষে নিতেই ইহুদিরা তাদের সর্বশক্তি নিয়োজিত করে। প্রথম মহাযুদ্ধের ফলাফল হিসেবে অটোমান সা¤্রাজ্যের ভাঙ্গন ও পতন, জার্মানীর উপর অপমানজনক শর্ত চাপিয়ে দিয়ে হিটলারের মত চরম জাতীয়তাবাদি নেতার উত্থান এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটনের মনস্তাত্বিক ও পারিপার্শ্বিক বাস্তবতার উদ্ভব ঘটেছিল। জার্মানীতে ১৯৩৩ সালের নির্বাচনে হিটলারের বিজয়ের পর চরম ইহুদি বিদ্বেষী ভ’মিকার প্রতি জার্মানদের ব্যাপক সমর্থন ছিল। এটা হঠাৎ করেই সৃষ্টি হয়নি ইউরোপের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্নে ইহুদিদের দ্বিচারিতা ও গোপন অভিসন্ধি বিভিন্ন দেশের শাসকদের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাড়িয়েছিল। এ কারণে ইউরোপের সবগুলো দেশই যেন নিজ নিজ দেশ থেকে ইহুদিদের তাড়াতে পারলেই বাঁচে। এমন প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখেই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর কালে একটি অস্বাভাবিক ও অরাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনে আরব মুসলমানদের ভূমিতে একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদি নীল নকশায় রাশিয়াসহ ইউরোপীয় দেশগুলোর সমর্থন পেয়ে যায়। অবশ্য এর পেছনে নাৎসী বাহিনীর কথিত হলোকস্ট বা লাখ লাখ ইহুদি নিধনের ঘটনার সেনশনাল প্রচারনা বিশ্ববাসির সমর্থন আদায়ে বিশেষ ভ‚মিকা রেখেছিল।
ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহে শত বছরের মাইলফলক সর্বদাই গুরুত্বের সাথে সেলিব্রেট করা হয়। ১৯১৭ সালের বালফোর ঘোষনার মধ্য দিয়ে বিশ্বের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে এক নতুন ও কৃত্রিম সংকটের সৃষ্টি হয়। ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদি নীল নকশা এবং শত শত বছরে সুদি ব্যবসার মধ্য দিয়ে গড়ে তোলা ইহুদি ব্যাংকার ও ধনকুবেরদের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রচুর অর্থব্যয় করে ফিলিস্তিনের দরিদ্র আরবদের জমিজমা কিনে নিয়ে সেখানে ইহুদি আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা যখন তেমন সুফল দিচ্ছিলনা তখন পশ্চিমা সামরিক শক্তিতে বলিয়ান ইহুদি মিলিশিয়া বাহিনীগুলো ফিলিস্তিনের গ্রামগুলো দখল করতে রক্ত ও আগুনের হোলিখেলায় মেতে উঠে। তারা জাহাজ থেকে নেমে বুলডোজার চালিয়ে শত শত ফিলিস্তিনি গ্রামকে ধ্বংসস্তুপে পরিনত করে। প্রানভয়ে পালিয়ে যাওয়া ফিলিস্তিনীদের সব চিহ্ন মুছে দিয়ে সেখানকার গ্রাম ও জনপদগুলোর নতুন নামকরণ করে কোটি কোটি ডলার খরচে নতুন ইহুদি বসতি গড়ে তোলা হয়। এরপর থেকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাদের। বালফোর ডিক্লারেশনের শত বছর এবং অবৈধ প্রক্রিয়ায় ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের সত্তুর পর এখনো ইসরাইলীরা আরবদের জমি দখল করে নতুন নতুন ইহুদি বসতি স্থাপন করে চলেছে। প্রতিবছর প্রতিদশকে ইহুদি রাষ্ট্রের সীমা বর্ধিত হয়েছে আর বাস্তহারা ফিলিস্তিনীদের নির্যাতন ও দাবিয়ে রাখার নতুন নতুন পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় বালফোর ডিক্লারেশনের মধ্য দিয়ে যখন ফিলিস্তিনে একটি রাষ্ট্রের সম্ভাব্য রূপরেখা তৈরী হয়ে গিয়েছিল, ঠিক একই সময়ে বিশ্ব ইতিহাসের আরেকটি বড় ঘটনা ঘটেছিল রাশিয়ায়। মার্ক্সবাদের দার্শনিক রূপরেখায় ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিনের নেতৃত্বে সংঘটিত বলশেভিক বিপ্লব সমগ্র বিশ্বের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সুচনা করেছিল। ১৯১৭ সালের অক্টোবরে সংঘটিত বিপ্লবের মাধ্যমে রাশিয়ায় সামন্তবাদ ও জারতন্ত্রের পতন এবং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার উত্থান একদিকে পশ্চিমা পুঁজিবাদি ব্যবস্থার জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়ায়। বলতে গেলে সোভিয়েত ও পূর্ব ইউরোপীয় সমাজতন্ত্রের উত্থান বিশ্বব্যবস্থায় এক ধরনের ভারসাম্য তৈরী করেছিল। ব্যাপক অর্থনৈতিক সামাজিক বৈষম্য, অস্থিতিশীলতা অনিশ্চয়তা, অশান্তি ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের কারণ হয়ে ওঠা পুঁজিবাদ এখনো বিশ্বের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রনে রাখতে সক্ষম হলেও মাত্র সত্তর বছরের মাথায় সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের মধ্য দিয়ে আবারো বিশ্বব্যবস্থায় বড় ধরনের ভারসাম্যহীনতা তৈরী করে। অক্টোবর বিপ্লবের শতবর্ষ পূর্তিতে এখন বিশ্ব ইতিহাসে অক্টোবর বিপ্লবের প্রাসঙ্গিকতা ও মার্ক্সবাদি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার দার্শনিক ও প্রায়োগিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে নতুন মাত্রা যুক্ত হতে দেখা যাচ্ছে। সেই সাথে আজকের বিশ্বের রাজনৈতিক বাস্তবতায় পুঁজিবাদের সাথে বাণিজ্যিক-অর্থনৈতিক নিয়স্ত্রণব্যবস্থা, যুদ্ধ ও মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের কুশীলবদের তৎপরতা ও মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিকভাবে অকার্যকর একটি জায়নবাদি ইহুদি রাষ্ট্রকে কৃত্রিমভাবে টিকিয়ে রাখার বাস্তবতা নিয়ে নতুনভাবে আলোচনা শুরু হয়েছে। সোভিয়েত সমাজতন্ত্র সত্তুর বছরের বেশী টিকেনি। কোন প্রত্যক্ষ সংঘাত-সংঘর্ষ ছাড়া ভেতর থেকেই ধসে পড়েছিল মার্ক্সবাদি সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা। একইভাবে ১৯৪৮ সালে ইঙ্গ-মার্কিন পৃষ্ঠপোষকতায় মধ্যপ্রাচ্যে যে জায়নবাদি ইহুদি রাষ্ট্রটি সৃষ্টি করা হয়েছিল তা’ এখন সত্তুরে পা দিতে চলেছে। একটি রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য ৭০ বছর খুব বেশী সময় না হলেও সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের পর থেকে পশ্চিমা যুদ্ধবাদি সাম্রাজ্যবাদ টিকিয়ে রাখতে একটি নতুন শত্রুর প্রয়োজন হয়ে পড়ে। বিশেষত: মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের ইসলামি বিপ্লব এবং ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়ার মত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে নতুন নতুন রাষ্ট্রশক্তির সম্ভাবনা দেখা দেয়ায় জায়নবাদি ইহুদি রাষ্ট্রের ভবিষ্যত নিয়েও নতুন আশঙ্কা দেখা দেয়। উল্লেখ্য, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বব্যবস্থার সাম্প্রতিক প্রপঞ্চসমুহের সবগুলোই জায়নবাদের পৃষ্ঠপোষক ও পশ্চিমা নিওকন রাজনীতিকদের তৈরী করা। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের এক দশক পর ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে নিউন ইয়র্কের বিশ্ববাণিজ্যকেন্দ্র ও পেন্টগনে সন্ত্রাসী বিমান হামলার ঘটনাকে পুঁজি করে যে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষনা দেয়া হয়েছিল এর পেছনের জায়নবাদি কুশীলবরা এর নাম দিয়েছিল এন্ডলেস ওয়ার বা অন্তহীন যুদ্ধ।
অন্তহীন যুদ্ধ নাম দিলেও তা যে অন্তহীন নয় সিরীয় যুদ্ধের সাম্প্রতিক বাস্তবতা থেকে তা অনেকটা আন্দাজ করা যায়। অবশ্য এর আগে ২০০৬ এবং ২০০৮ সালে গাজা যুদ্ধে লেবানিজ হেজবুল্লাহ ও হামাসের সাথে ইসরাইলী সেনাবাহিনীর নাস্তানাবুদ হওয়ার মধ্য দিয়েই মূলত: অন্তহীন যুদ্ধের যবনিকাপাতের আলামত স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। এরপর ২০১২ সালে আবারো ইসরাইলী বাহিনী হামাসের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে ৮ দিনের মাথায় আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি সম্পাদিত হয়। তিনটি যুদ্ধের ফলাফল ও মধ্যপ্রাচ্যে ভবিষ্যত রাজনৈতিক বিবর্তন আঁচ করে ২০১২ সালেই সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ভবিষদ্বানী করেছিলেন, ২০২২ সালের পর ইসরাইল নামক রাষ্ট্রের অস্তিত্ব থাকবেনা। তখনো সিরীয় যুদ্ধের ফলাফল কোথায় গিয়ে দাড়ায় তা আন্দাজ করা সম্ভব ছিলনা, ইরানের পারমানবিক প্রকল্প ঘিরে অনবরত প্রোপাগান্ডা এবং ইরানের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য যুদ্ধের হুমকিও যথেষ্ট সক্রিয় থাকা সত্বেও হিনরি কিসিঞ্জার এমন ভবিষ্যদ্বানী করেছিলেন। ইসরাইলের প্রবল আপত্তি ও সক্রিয় ক’টনৈতিক তৎপরতা সত্বেও গত বছর ইরানের সাথে ৬ বিশ্বশক্তির পারমানবিক সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং রাশিয়া, ইরান ও চীনের সমন্বিত হ্স্তক্ষেপের মধ্য দিয়ে চলতি বছর সিরিয়া যুদ্ধের মোড় আমূল পাল্টে যাওয়ায় যুদ্ধবাদি ইসরাইল অস্তিত্ব সংকটের আশঙ্কা করতে শুরু করেছে। এহেন বাস্তবতাকে সামনে রেখেই ইসরাইল লেবানন ও হেজবুল্লাহর সাথে আরেকটি যুদ্ধের ছক আঁকছে। সিরীয় যুদ্ধের ধারাবাহিকতায় ইসরাইল ও লেবাননের মধ্যে আগামী সম্ভাব্য যুদ্ধে সিরিয়া, ইরাণ, তুরস্কসহ মধ্যপ্রাচ্যের মার্কিন বশংবদ রাজতান্ত্রিক দেশগুলো এবং রাশিয়া, চীন ও সরাসরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছে। একাধিক পারমানবিক শক্তিধর রাষ্ট্রের অংশগ্রহন এবং সামরিক, ভূ-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্ন জড়িত থাকায় এ ধরনের একটি আঞ্চলিক সংঘাত শেষ পর্যন্ত পারমানবিক যুদ্ধে রূপ নিতে পারে বলে কেউ কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তবে এ ধরনের যুদ্ধের ঝুঁকি ইসরাইল বা অ্যাংলো-জায়নিস্ট এই মুহূর্তে গ্রহন করবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। গত একদশকে এক এক করে তাদের সব কয়টি প্ল্যানই ভেস্তে গেছে। প্রথমত: লিবিয়ায় গাদ্দাফি সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে তেমন কোন রাজনৈতিক স্বার্থ অর্জিত না হলেও প্ল্যান এ’-এর আওতায় সিরিয়ায় আসাদ সরকারকে হটিয়ে ও হত্যা করে সেখানে দায়েশসহ কয়েকটি গ্রুপের মধ্যে সিরিয়াকে ভাগ করে দিয়ে সিরিয়া ভাঙ্গার নীলনকশা ব্যর্থ হয়েছে। দ্বিতীয়ত: ইরাকের দক্ষিনাঞ্চলে একটি কুর্দি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাসহ আইএস এর দখলে থাকা একাধিক অঞ্চল নিয়ে আলাদা রাষ্ট্র গঠন তথা ইরাক ভাঙ্গার চক্রান্তও ব্যর্থ হয়েছে। তৃতীয়ত: তুরস্কে এরদোগান বিরোধি অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রতিক বাস্তবতা ইঙ্গ-মার্কিন ও জায়নিস্টদের নিয়ন্ত্রনের পুরোপুরি বাইরে চলে গেছে। বাহ্যত বিশ্ব অর্থনীতি এখনি ইউনিপোলার মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে গেছে, এমনটা হয়তো বলা যাচ্ছেনা। তবে চীন-রাশিয়া-ইরান এক্সিসের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামরিক উত্থানের মধ্য দিয়ে বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতিতে ইতিমধ্যেই যে ভারসাম্য তৈরী হয়েছে তা ক্রমে দ্রুত মার্কিন ও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বিপক্ষে চলে যাচ্ছে।
শত বছর আগে ১৯১৭ সালে বালফোর ঘোষনার মধ্য দিয়ে বৃটিশ ঔপনিবেশিক স্বার্থের নিগড়ে জন্ম হয়েছিল অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তি জাপান, জামার্নী, ইতালী ও তুরস্কের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ইঙ্গ-মার্কিন নেতৃত্বে যে নতুন পুঁজিবাদি বিশ্বব্যবস্থা গড়ে ওঠে তার নেপথ্যের কুশীলব পশ্চিমা কর্পোরেট পুঁজিবাদের ধারক ইহুদি ব্যাংকার ও বর্ণবাদি নিওকন রাজনীতিকরা। এক শতাব্দীর পথ পরিক্রমাশেষে বিংশ শতকের যে ইতিহাস আমাদের সামনে ভেসে ওঠে তার প্রতিটি ছত্রে ছত্রে জড়িত রয়েছে পুঁজিবাদি কর্পোরেট মুনাফাবাজি ও ইসরাইলের নিরাপত্তা স্বার্থজনিত গোপন নীল নকশা। মাত্র ৭০ বছরের মধ্যে সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার পতন ঘটলেও পশ্চিমা পুঁজিবাদের সর্বগ্রাসি শোষণযন্ত্রের বিরুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার ধারনা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের মধ্যে একটি মনোজাগতিক অবস্থান তৈরী করেছে। এতকিছুর পরও সমাজতন্ত্রের পতনের কারণগুলো চিহ্নিত করতে গেলে যে বিষয়টি সর্বাগ্রে উঠে আসে তা হচ্ছে প্রায়োগিক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রদর্শণ সাধারণ মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ, ধর্ম ও পারলৌকিক বিশ্বাসকে অগ্রাহ্য করেছিল। এ কারণেই সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের পর সেখানে পুঁজিবাদি ব্যবস্থার প্রতিযোগিতাই শুধু শুরু হয়নি সেই সাথে শত বছর ধরে নিস্তব্ধ পড়ে থাকা সেখানকার গির্জাগুলোতে আবার ঘন্টাধ্বনি বাজতে শুরু করেছে মানুষ আবার দলে দলে মসজিদ-মন্দিরে যেতে শুরু করেছে, নতুন নতুন মসজিদ, গির্জা ও মন্দির তৈরী হচ্ছে। মানব জীবনের এই মৌলিক বিষয়টিকে অগ্রাহ্য করে কোন রাষ্ট্রদর্শন মানুষের মধ্যে আস্থা অর্জন করতে পারবেনা। অক্টোবর বিপ্লবের শত বছরপূর্তিতে মার্ক্সবাদি সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের কারণসমুহ নিয়ে যখন নানা বিচার বিশ্লেষণ চলছে তখন আমরা এ দেশের মার্ক্সবাদি তাত্তি¡করা গতানুগতিক ধারায় পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে চলেছেন। আজকের বিশ্ববাস্তবতায় পুঁজিবাদের প্রধান প্রতিপক্ষ ইসলাম, অন্যদিকে মার্ক্সবাদের প্রতিপক্ষ একদিকে যেমন পুঁজিবাদ অন্যদিকে ইসলামসহ সব ধরনের ধর্মীয় বিশ্বাস ও ধর্মীয় অনুশাসন। তারা মার্ক্সবাদকেই ধর্মের জায়গায় বসাতে চেয়ে ব্যর্থ হয়েছে। মাওবাদি কমিউনিজমের নামে চীনে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত হলেও বিশ্বের সবচে জনবহুল এই দেশটি পুঁজিবাদী আধিপত্য কায়েমের প্রতিযোগিতায় সামিল হওয়ার মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার ধারনাকে অনেকটা ফিকে ও অবজ্ঞেয় করে তুলেছে। প্রলেতারীয় একনায়কত্ব চীনে এখন পুঁজির একনায়কত্বে পরিনত হয়েছে। সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা সমস্যায় চীনের বিতর্কিত ভ’মিকার পেছনে কাজ করেছে তা পুঁজিবাদি স্বার্থের রূপরেখা মাত্র। এ ক্ষেত্রে তেলের জন্য মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ বাধিয়ে দেয়ার পশ্চিমা পুঁজিবাদি নীলনকশা আর রাখাইনে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা গণহত্যা ও জাতিগত নির্মূল অভিযানে চীনা বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক স্বার্থের অমানবিক নীতিকৌশলের মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য নেই। আজকের বিশ্ববাস্তবতায় এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, পুঁজিবাদের চরম বিকাশ এখন যে চরম অর্থনৈতিক বৈষম্য তৈরী করেছে তা ক্রমশ আরো ঘনীভ’ত হয়ে একটি সর্বাত্মক লুণ্ঠন ও অর্থনৈতিক লুটতরাজের জন্ম দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা অর্থনীতিতে ধস, ভর্তুকি বা বেইলআউট প্রকল্পের জনগনের করের হাজার হাজার কোটি ডলার কোন কৃষ্ণ গহŸরে চালান করে দেয়ার বাস্তবতা থেকেই বিশ্বে নতুন নতুন যুদ্ধের হুমকি এবং ব্যর্থ ও অকার্যকর রাষ্ট্রের জন্ম হচ্ছে। প্রথম মহাযুদ্ধে আরব রিভল্ট, উসমানীয় সাম্রাজ্যর পতন এবং বহুধাবিভক্তির মধ্য দিয়ে পশ্চিমারা যে নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডারের সূচনা করেছিল শত বছর পর সেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে পশ্চিমার প্রথমে আরব বসন্ত অত:পর আইএস-দায়েশ এবং মিথ্যা প্রচারনা ও প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে পরস্পরের প্রতি অসহিষ্ণু ও প্রতিপক্ষ বানিয়ে মধ্যপ্রাচ্যকে আরেকটি শতবর্ষের গোলকধাঁধায় ফেলার সুগভীর চক্রান্ত অব্যাহত রয়েছে। তবে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদে এবারের চক্রান্ত ব্যর্থতার আভাসও ইতিমধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। গত শতকে সংঘটিত দু’টি মহাযুদ্ধ এবং গত দুই দশকে সংঘটিত পশ্চিমা সামরিক আগ্রাসনে কোটি কোটি মানুষের আত্মত্যাগের শিক্ষা থেকে মধ্যপ্রাচ্যে একটি নতুন গণতান্ত্রিক ও ইসলামি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ বিনির্মানের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও সমঝোতা এখন সময়ের দাবী। মধ্যপ্রাচ্যের নতুন রাজনৈতিক সম্ভাবনা তৃতীয় বিশ্বের সব দেশেই ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।