শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
কুতুবউদ্দিন আহমেদ
বিদ্রোহী’র পর বাংলা ভাষায় বনলতা সেন এর মতো তুমুল জনপ্রিয় কবিতা বোধহয় আর একটিও নেই। পরম আশ্চর্যের বিষয় হল যে, দু টি কবিতার জনকই সমসাময়িককালের; তাঁদের দু জনের জন্মসাল এক, ১৮৯৯। কী সেলুকাস! ১৮৯৯ কী দারুণ এক সৌভাগ্য নিয়ে এসেছে বাংলা নামক দুখিনী মায়ের কোলে! বাংলা ভাষা প্রসব করেছে তার শ্রেষ্ঠ দুই সন্তানের একই বছরে। ১৮৯৯ এ জন্ম নেয়া দু জন কবি কিনা লিখলেন বাংলা ভাষার সবচে জনপ্রিয় দুটি কবিতা। তবে কবিতা দুটি পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয়েছে বছর দশেক আগে-পরে; তিরিশের দশকে আর চল্লিশের দশকে। তবে আমাদের আজকের আরাধ্য বিষয় বনলতা সেন।
‘বনলতা সেন’ এর এই হিংসা উদ্রেককারী জনপ্রিয়তার পেছনে রহস্যটা কী? কেন এই আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা? রহস্যের অপার আলো-আধারি নাকি এর নান্দনিকতা পাঠককে আকৃষ্ট করে? কিন্তু রুচিশীল পাঠকমাত্রই বুঝবেন কবিতাটির জনপ্রিয়তার কারণ আসলে এর দুটোই হতে পারে। মানুষ চিরকালই রহস্য রসিক আর ‘বনলতা সেন’ এর শরীরের পুরোটাই রহস্যে আবৃত। আবার নান্দনিকতার বিচারেও কম যায় না; বলতে হয়, নান্দনিকতার ছটায় ভরা কবিতাটির প্রতিটি অক্ষরকণিকা। ‘বনলতা সেন’ এমন একটি রহস্যভরা কবিতা যা পাঠমাত্রই পাঠক এর রহস্যের বেড়াজালে আটকে যেতে বাধ্য হয়। হাজার বছর ধরে পথ হাঁটা, নাটোরের বনলতা সেন, চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, মুখ যার শ্রাবস্তীর কারুকার্য, পাখির নীড়ের মত চোখ, শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা এই সকল চুম্বকীয় উপমায় পাঠক বিস্মিত না হয়ে পারে না; পাঠক অবলীলায় ভাবনার জগতে চলে যায়।
নাটোরের বনলতা সেনের প্রতিও রয়েছে পাঠকের দুর্নিবার কৌতূহল। কে এই বনলতা সেন? বনলতা সেন নামে আদৌ কি কোন মানবী ছিল এই নক্ষত্রে? জীবনানন্দের সঙ্গে তার সম্পর্কই বা কী? কবির সঙ্গে কি তার প্রণয় ছিল? ছিল কোনো ঘনিষ্ঠতা? তাঁকে এই মানবী দু দÐ শান্তি দিয়েছিলই বা কীভাবে? নাকি সবই কবির উর্বর মস্তিষ্কপ্রসবিত কল্পণা? ইত্যাদি নানান প্রশ্ন ঘুরপাক খায় পাঠকের মস্তিষ্কে। মানুষ বরাবরই রহস্যের ঘূর্ণিপাকে ঘুরপাক খেতে পছন্দ করে।
জীবনানন্দ গবেষকেরা প্রাণপাত করেও নাটোর এবং বনলতা সেনের কোনো সুরাহা করতে পারেননি। শোনা যায় জীবনানন্দ কখনই নাটোরে যাননি। তাঁর শৈশব, যৌবন এমনকি কর্মজীবনেরও অনেকখানি কেটেছে বরিশালে। জীবনের বাকিটুকু কলকাতায়। তাঁর কবিতা বিষয়ক সংগ্রাম, চাকরি, চাকরি হারানো এসবের অধিকাংশ ঘটনাই ঘটে গেছে সেখানে।
জীবনানন্দ গবেষকেরা কিছু তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছেন। তারা মনে করেন বনলতা সেন নামে কোনো একজন মানবী বাস্তবে অবশ্যই ছিলেন। তার সঙ্গে কবির পরিচয় এবং ঘনিষ্ঠতা ছিল। কবি নাটোরে না গেলেও তাঁর সঙ্গে অন্য কোথাও পরিচয় হয়েছিল। গবেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, কবিতার নান্দনিকতার প্রয়োজনে তিনি নাটোর নামটির সুপ্রয়োগ ঘটিয়েছেন; প্রকৃতপক্ষে এই মানবী নাটোরের কেউ নন। তবে এর পেছনে বাস্তবে যে কেউ একজন ছিলেন সেটা প্রমাণের জন্য কেউ কেউ দৃষ্টান্ত হিসেবে কবির আত্মজৈবনিক একটি উপন্যাসের উপস্থাপন করেন। তাঁর ‘কারুবাসনা’ উপন্যাসটিতে বনলতা নামক এক নারীর সাবলিল এবং গুরুত্বপূর্ণ উপস্থিতি রয়েছে। উপন্যাসটির নায়ক তাকে খুব ভালোবেসেছিলেন। এই নায়ক বেচারাকেই যদি জীবনানন্দ কল্পণা করা যায় তাহলে সকল রহস্যের জট একমুহূর্তে খুলে যায়।
জীবনানন্দের অন্যতম গবেষক ভূমেন্দ্র গুহ অবশ্য বনলতার উপস্থিতি কবির ডায়েরিতে কিছুটা খুঁজে পেয়েছিলেন; তবে যতটুকু পেয়েছিলেন ততটুকু প্রমাণ হিসেবে যথেষ্ট নয়। আবার সমালোচকদের কেউ কেউ মনে করেন, বাস্তবের বনলতা ছিলেন ¯্রফে একজন গণিকা। অবশ্য যারা কবিতার রহস্যের ভেতরে না গিয়ে মোটা দাগে দু দÐ শান্তি দেবার বিষয়টি সরাসরি বুঝে নেন, তাদের নিকট বনলতা একজন গণিকা হওয়াটা অবান্তর কিছু না। কিন্তু বুঝতে হবে, জীবনানন্দের মতন জীবনবিমুখ কবির পক্ষে গণিকালয়ে গমন করা সম্ভব কি-না। তবে আসল কথা, এ-সবই গবেষকদের উর্বর মস্তিষ্কের কল্পণামাত্র। বাস্তবতার সঙ্গে এর কোনো যোগসূত্র না থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে এ-কথা ঠিক, যতদিন বনলতা বিষয়ক রহস্য উদঘাটন না হবে ততদিন পাঠকেরা ছুটবে রহস্যের পিছু পিছু। এখানেই ‘বনলতা সেন’ এর চরম সার্থকতা।
‘বনলতা সেন’ কবিতাটি প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৩৬ এ কবি বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত বিখ্যাত ‘কবি’ পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যায়। পুস্তকাকারে প্রকাশ পায় ১৯৪২ এ বুদ্ধদেব বসুর কবিতা ভবন থেকে ‘এক পয়সায় একটি’ কবিতা সিরিজে। এতে জীবনানন্দ খুব একটা সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তিনি খুব করে চেয়েছিলেন কবিতাটির সম্মানজনক একটি স্থান। অবশেষে ১৯৪৪ এ জীবনানন্দের ‘মহাপৃথিবী’ নামে নতুন একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পায়; বনলতা সেন এর স্থান হয় এই কাব্যগ্রন্থটির শুরুতেই। এতেও কবির মনোতুষ্টি হয়নি। কবি হয়তো তখনই অনুমান করতে পেরেছিলেন কবিতাটির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে; মর্যাদা সম্পর্কে, এর দীর্ঘায়ু সম্পর্কে। তিনি চেয়েছিলেন নিজের এই সৃজন কর্মটির উচিত মর্যাদা দিতে। সবশেষে ১৯৫২ তে বনলতা সেন নামে তাঁর পূর্ণাঙ্গ একটি কাব্যগ্রন্থই আলোর মুখ দেখে; এবং গ্রন্থটির প্রচ্ছদ আঁকেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়।
কবিতা লিখতে এসে জীবনানন্দকে বারবার চরম বঞ্চণা আর হতাশায় নিপতিত হতে হয়েছে; অপমানে নীলকণ্ঠ হয়েছেন কতবার। অথচ লোকটি ছিলেন চরম মৃদু, স্বল্প ও মিষ্টভাষী; জীবনের মারপ্যাচ, গলি-ঘুপচি অতোটা বুঝতেন না, বোধকরি বোঝার ইচ্ছেও তাঁর ছিল না। বনলতা সেনই প্রথম এই কবিকে উঁচুতে তুলে ধরেন। এই কবিতাটিই প্রথম পাঠকের কাছ থেকে কবি স্বীকৃতি, জনপ্রিয়তা এনে দেয়; জীবনান্দ সেখান থেকেই কবি হয়ে ওঠেন। এমনকি জীবদ্দশায় তিনি যে একমাত্র স্বীকৃতিটি পান সে ঐ ‘বনলতা সেন’ এর জন্যই। ১৯৫৩ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলনে ‘বনলতা সেন’ ১৯৫২-এর শ্রেষ্ঠ কাব্যের স্বীকৃতি পান।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।