শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
কবি জীবনানন্দ দাশ ছিলেন একজন কালসচেতন ও ইতিহাসসচেতন কবি। আধুনিক কাব্যকলার বিচিত্র ইজম প্রয়োগ ও শব্দ নিরীক্ষার ক্ষেত্রে ও তার অনন্যতা বিষ্ময়কর। বিশেষতঃ কবিতার উপমা প্রয়োগে জীবননান্দের নৈপুন্য তুলনাহীন। কবিতাকে তিনি মুক্ত আঙ্গিকে উত্তীর্ণ করে গদ্যের স্পন্দনযুক্ত করেন, যা’ পরবর্তী কবিদের প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছে। জীবন বোধকে নাড়া দিয়েছে।
কবি জীবনানন্দ দাশ ১৮৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা সত্যানন্দ দাশ ছিলেন স্কুল শিক্ষক ও সমাজ সেবক । তিনি ‘ব্রহ্মবাদী’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন। মাতা কুসুম কুমারী ছিল একজন বিখ্যাত কবি। জীবনানন্দ দাশের বাল্য শিক্ষার সূত্রপাত হয় মায়ের কাছেই। তারপর তিনি বরিশালের ব্রজমোহন স্কুলে ভর্তি হন। ১৯১৫ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন জীবনানন্দ দাশ। ১৯১৭ সালে ব্রজমোহন কলেজ থেকে আইএ প্রথম বিভাগে এবং ১৯১৯ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্সসহ বিএ পাস করেন। ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেন। ১৯২২ সালে কলকাতা সিটি কলেজে ইংরেজি ভাষা সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। জীবনানন্দ দাস ১৯৩৫ সালে বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে যোগদান করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের কিছু আগে তিনি স্বপরিবারে কলকাতায় চলে যান।
জীবনানন্দের কাব্যচর্চার শুরু হয় অল্প বয়স থেকেই। স্কুলে ছাত্রাবস্থায় তার প্রথম কবিতা ‘বর্ষ-আবাহন’ ব্যহ্মবাদী পত্রিকায় বৈশাখ ১৩২৬/এপ্রিল ১৯১৯খ্রি:) প্রকাশিত হয়।
১৯২৭ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কাব্যগ্রস্থ ‘ঝরাপালক’। ১৯৩০ সালের ৯ মে বিয়ে করেন রোহিনী কুমার গুপ্তের মেয়ে লাবণ্য গুপ্তকে। বিবাহিত জীবন তার মোটেই সুখের ছিল না। বিয়ের পর অনেকদিন কর্মহীন জীবন কেটেছে জীবনানন্দ দাশের। দুটি সন্তান ছিল তার মেয়ে মঞ্জুশ্রী ও ছেলে সমরানন্দ। জীবননান্দ দাশ বৈষয়িক জীবনে কখনো সফলতা পাননি । বার বার ভাবতেন আত্মহত্যার কথা। ভেবেছিলেন স্ত্রী, পুত্র, কন্যা নিয়ে সাগরের জলে ডুবে মরবেন।। সারাটা জীবন তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম স্থান মনে করতেন আমাদের এই বাংলাদেশকে। জীবননান্দ দাশ কবি হলেও অসংখ্য ছোটগল্প, কয়েকটি উপন্যাস ও প্রবন্ধ গ্রন্থ রচনা করেছেন। জীবদ্দশায় তিনি এগুলো প্রকাশ করেননি। ঔপন্যাসিক ও গল্পকার হিসেবে জীবনানন্দের স্বতন্ত্র প্রতিভা ও নিভৃত সাধনার উন্মোচন ঘটে মৃত্যুর পরে প্রাপ্ত তার অসংখ্য পান্ডুলিপিতে। জীবনানন্দের প্রথম কাব্যে নজরুল, সতেন্দ্রনাথ ও মোহিতলালের কাব্য ধারার প্রভাব থাকলেও দ্বিতীয় কাব্য থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন মৌলিক ও ভিন্ন পথের অনুসন্ধানী।
তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থগুলো হচ্ছে ধূসর পান্ডুলিপি (১৯৩৬ খ্রি:), বনলতা সেন (১৯৪২ খ্রি:), মহাপৃথিবী (১৯৪৪ খ্রি:), সাতটি তারার তিমির (১৯৪৮ খ্রি:), রূপসী বাংলা (১৯৫৭ খ্রি:), বেলা অবেলা কার বেলা (১৯৬১ খ্রি:)। এছাড়াও বহু অগ্রন্থিত কবিতা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে মাল্যবান (১৯৭৩ খ্রি.), সুতীর্থ (১৯৭৭ খ্রি.) জলপাইহাটি (১৯৮৫ খ্রি.) জীবন প্রণালী (অপ্রকাশিত), রাসমতির উপাখ্যান (অপ্রকাশিত) ইত্যাদি। তার রচিত গল্পের সংখ্যা প্রায় দুই শতাধিক। কবিতার কথা (১৯৫৫ খ্রি.) নামে তার একটি মননশীল ও নন্দন ভাবনা মূলক প্রবন্ধ গ্রন্থ আছে। সম্প্রতি কলকাতা থেকে তার গদ্য রচনা ও অপ্রকাশিত কবিতার সংকলন রূপে ‘জীবনানন্দ সমগ্র’ (১৯৮৫ খ্রি:) নামে বারো খ- রচনাবলী প্রকাশিত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের (১৮৬১-১৯৪১ খ্রি:) নিবিড় প্রকৃতিচেতনা তার কবিতায় গভীর দ্যোতনা লাভ করেছে। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যময় নিসর্গ ও রূপকথা- পুরাণের জগৎ তার কাব্যে হয়ে উঠেছে চিত্র রূপময়। বিশেষত ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থে যেভাবে আবহমান বাংলার চিত্ররূপ ও অনুসুক্ষè সৌন্দর্য প্রকাশিত হয়েছে তাতে তিনি রূপসী বাংলার কবি হিসেবে খ্যাত হয়েছেন।
জীবনানন্দ দাশ আধুনিক বাংলা কবিদের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য। তার কবিতার চিত্রময়তা, যার সঙ্গে আমরা অনায়েসে ঘনিষ্ঠ বোধ করি। এটি তার জনপ্রিয়তার অন্যতম একটি কারণ। যে প্রকৃতির বর্ণনা জীবনানন্দ করেন, বাস্তবে তাকে আমরা আর খুঁজে পাই না। পাই না বলেই হয়তো হারানো সেই সৌন্দর্যকে আমরা নিজের ভেবে আরও প্রবলভাবে আঁকড়ে ধরি। অনেক সময় তার উচ্চারিত শব্দ চিত্র আমাদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রয়েগেছে। স¤্রাট বিম্বিসার কে, বির্দভ নগর কোথায়, তা’না জেনেই মনে মনে নিজের মতো এক চিত্র ও ধ্বনির জগৎ আমরা গড়ে নেই। আগাগোড়া তার কবিতার সুর বিষন্ন, সবচেয়ে উজ্জ্বল যে রং তাও ধূসর, অথচ তা’ সত্ত্বেও জীবননান্দ দাশের কবিতায় আমরা ব্যক্তিগত প্রণোদনার উৎস খুঁজে পাই। তবে প্রকৃতির পাশাপাশি জীবনানন্দের শিল্প জগতে মূর্ত হয়েছে, বিপন্ন মানবতার ছবি এবং আধুনিক নগর জীবনের অবক্ষয়, হতাশা, নিঃসঙ্গতা ও সংশয়, রোধে জীবনানন্দ ছিলেন একজন সমাজ সচেতন কবি। তিনি ইতহাস চেতনা দিয়ে অতীত ও বর্তমানকে অচ্ছেদ্য সম্পর্ক সূত্রে বেঁধেছেন। তার কবি স্বভাব ছিল অন্তর্মুখী, দৃষ্টিতে ছিল চেতনা থেকে নিশ্চেতনা ও পরচেতনার শব্দ রূপ আবিষ্কারের লক্ষ্য। এ সূত্রে তিনি ব্যবহার করেছেন ইম্প্রেশনিস্টিক রীতি, পরাবাস্তবতা, ইন্দীয় বিপর্যাস ও রঙের অত্যাশ্চর্য টেকনিক। জীবনানন্দ বাংলা কাব্য সাহিত্যের যে অজ্ঞাত পূর্ব ধারা আবিষ্কার করেছিলেন তা জীবনানন্দের সমকালীন সময়ে খুব কম কাব্য রসিক কিংবা নন্দন তাত্ত্বিকরা বুঝতে পেরেছিলেন।
জীবনানন্দের গল্প-উপন্যাসে অভিব্যক্ত হয়েছে দাম্পত্য জীবনের সঙ্কট, নরনারীর মনস্তত্ত্ব ও যৌন সম্পর্কের জটিলতা এবং সমকালের আর্থসামাজিক কাঠামোর বিপর্যয়। তার প্রায় গল্প উপন্যাস আত্মজৈবনিকতার প্রকাশ ঘটেছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে জীবনান্দের কবিতার ভূমিকা ঐতিহাসিক। ষাটের দশকে বাঙালির জাতিসত্তা বিকাশের আন্দোলনে এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে সংগ্রামী চেতনায় বাঙালি জনতাকে তার “রূপসী বাংলা” তীব্রভাবে অনুপ্রাণিত করে। জীবনানন্দ ছিলেন আধুনিক যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি। তার বিখ্যাত কাব্য গ্রন্থ “বনলতা সেন” নিখিল বঙ্গ রবীন্দ্র সাহিত্য সম্মেলনে ১৯৫৩ সালে পুরস্কৃত হয়। জীবনানন্দের “শ্রেষ্ঠ কবিতা” গ্রন্থটি ১৯৫৪ সালে ভারত সরকারের সাহিত্য আকাডেমি পুরস্কার লাভ করে। ১৯৫৪ সালের ২২ অক্টোবর কলকাতায় এক ট্রাম দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে জীবনানন্দ দাশ অকালে মৃত্যুবরণ করেন।
জীবনানন্দ দাসকে নিয়ে আমাদের আগ্রহ ও বিস্ময় প্রায় অন্তহীন। তার ব্যবহৃত শব্দের ভেতর থেকে ইন্দ্রীয় গ্রাহ্য এবং ইন্দ্রিয়াতীত সমস্ত অনুভূতির সন্ধান পাওয়া সম্ভব। সেই সব শব্দ থেকে বিচ্ছুরিত হয় একই সাথে আলো আর অন্ধকার।
বিশ শতকের অন্য কোনো বাঙালি কবি আমাদের কল্পনায় এমন প্রবলভাবে দাগ কাটেনি। আজও তার কবিতার অলঙ্কার শব্দ ব্যবহার এবং অধুনা আবিষ্কৃত গদ্যের ভাষা আমাদের ক্রমেই বিস্মিত করে চলেছে। জীবনানন্দের মৃত্যুর ৬১ বছর পরও তিনি সমকালীন বাংলা কাব্য সাহিত্যের প্রধান কবি হিসেবে আজও অধিষ্ঠিত।
তথ্যসূত্র :
১. জীবনানন্দ : গোপাল চন্দ্র রায়
(প্রকাশ কাল ১৯৭১ খ্রি:)
২. জীবনানন্দ দাশ : রোখসানা চৌধুরী
৩. কবি জীবনানন্দ দাস : (জীবনানন্দ দাসের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে : ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯ খ্রি.)
প্রভাত কুমার দাস।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।