হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
আইনের শাসন কার জন্য? আইন মান্য করার দায় কার সবচেয়ে বেশী? এ দুটি প্রশ্ন দীর্ঘদিন ধরেই দেশে ঘুরপাক খাচ্ছে। সুপ্রীম কোর্টের ফুলবেঞ্চ থেকে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় প্রকাশিত হওয়ার পর এমন প্রশ্ন এখন উঠেছে। দেশে এক ধরনের বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। রাজনৈতিক প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় একশ্রেনীর মানুষ যা ইচ্ছা তাই করে বেড়াচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে কিছু কিছু নৃশংস ঘটনার তথ্য ও চিত্র নাটকীয়ভাবে ভাইরাল হয়ে কোটি মানুষের বিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছে। সম্মিলিত প্রতিবাদ এবং অকাট্য- ভিজুয়াল তথ্যপ্রমানের কারণে কোন কোন অপরাধিকে ধরে বিচারের আওতায় আনতে বাধ্য হয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। যেখানে অপরাধিকে খুঁেজ বের করে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা এবং সর্বশ্রেণীর মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই সব দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সাধারণ দায়িত্ব, সেখানে আমাদের দেশে নিতান্ত বাধ্য না হলে, সরকারীদলের রাজনৈতিক স্বার্থ বা সরকারের প্রত্যক্ষ নির্দেশ না থাকলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কোন প্রভাবশালী অভিযুক্ত বা সন্দেহভাজনকে আইনের আওতায় আনতে খুব কর্মঠ সচেষ্ট হয়। রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেনীর সদস্য ও কর্মকর্তার এমন ভূমিকার কারণে দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে যায়। আর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আস্থা নষ্ট হয়ে গেলে মানুষ পারতপক্ষে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর স্মরনাপন্ন হতে চায়না। এ ধরনের পরিস্থিতিতে ভুক্তভোগি সাধারণ মানুষ এক ধরনের বিচারহীনতার সংস্কৃতির অভিশাপ বুকে নিয়ে মানবেতরভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টা করেন, অথবা অধিক সংখ্যক বিক্ষুব্ধ মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার ফলে সামাজিক অপরাধ বেড়ে যায়। সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা ও অপরাধবৃদ্ধির সাথে সাথে সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বেড়ে যেতে দেখা যায়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকারীদল ও বিরোধি দলের রাজনৈতিক অবস্থান ও শাসন ক্ষমতার ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানের বদলে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে বিরোধি মত দমন এবং একপাক্ষিক ক্ষমতা চর্চার মধ্য দিয়ে এই অস্থিতিশীলতা সমাজ ও রাষ্ট্রকে একটি সর্বব্যাপী সামাজিক-রাজনৈতিক অবক্ষয় ও অপরাধ প্রবণতার দিকে ঠেলে দেয়। বিগত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর একতরফা নির্বাচনের পর থেকে বাংলাদেশে এমন অবস্থা ক্রমে প্রবল রূপ লাভ করছে। ছাত্রলীগ কর্মীদের হাতে প্রকাশ্য রাজপথে পথচারী বিশ্বজিৎ দাসকে নির্মমভাবে কুপিয়ে মারার দৃশ্য সিলেটে ছাত্রলীগ নেতা বদরুলের হাতে কলেজ ছাত্রী খাদিজা আক্তারকে নৃশংসভাবে চাপাতি দিয়ে কোপানোর দৃশ্য, অথবা সাম্প্রতিক বগুড়ায় যুবলীগ নেতা তুফান সরকারের ধর্ষণকান্ড এবং ভিকটিম মেয়ে ও তার মাকে মাথা ন্যাড়া করে শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়ার ঘটনাকে দেশের সমাজতাত্বিকরা বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে সৃষ্ট ঘটনা হিসেবেই অভিহিত করেছেন। যারা রাষ্ট্রক্ষমতাকে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অধিকার বলে মনে করেন এবং ক্ষমতাসীন দলের পরিচয়ধারি ব্যক্তিরা আইনের হাতের চেয়েও নিজেদের হাতকে বেশী লম্বা মনে করার কারণেই দেশে এমন অসংখ্য ঘটনার জন্ম হয়েছে। এসব ঘটনা এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতার কারণে দেশের প্রায় প্রতিটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান প্রকারান্তরে আক্রান্ত ও দুর্বল হয়েছে। এর ফলে এসব প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা হারিয়ে সাধারণ মানুষের আস্থাহীনতার শিকার হয়েছে। কোন রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি মানুষের আস্থার সংকট সামাজিক-রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার জন্ম দেয় এ ধরনের পরিস্থিতি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সম্ভাবনা এবং জনগনের সম্প্রীতির বন্ধনকে নস্যাৎ করে দেয়।
রাষ্ট্রের সংবিধান তার জনগণের সম্মিলিত অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি। রাষ্ট্রের মূল স্তম্ভগুলোর মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান নিশ্চিত করার রক্ষাকবচ সংবিধান। সংকীর্ণ রাজনৈতিক কারণে কখনো কখনো জনগনের সাধারণ ইচ্ছার ব্যত্যয় সৃষ্টিকারী আইনও সংসদে পাশ হতে পারে, সে ক্ষেত্রে বিচার বিভাগ তথা সর্বোচ্চ আদালত সংবিধান ও জনপ্রত্যাশার প্রহরির ভ’মিকা পালন করে থাকে। একইভাবে নির্বাচনের সময় ক্ষমতায় যিনি বা যারাই থাকুন একটি স্বাধীন, শক্তিশালী ও দলনিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে ভোটার আস্থা ও গ্রহনযোগ্য নির্বাচন সম্ভব হয়। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর আইনানুগ নিরপেক্ষ ভূমিকা, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতিদমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশনসহ সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষ ভূমিকা নিশ্চিত করা গেলে দেশে নির্বাচনকালীন তত্বাবধায়ক বা সহায়ক সরকারের কোন প্রশ্ন উঠেনা। যে সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনের শাসন ও ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শৃঙ্খলা ও নিরপেক্ষতা প্রশ্নাতীত ভূমিকায় প্রতিষ্ঠিত সে সব দেশে নির্বাচনে ক্ষমতাসীনরা প্রভাব সৃষ্টি করতে পারেনা বলেই সেখানে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের প্রয়োজন পড়েনা। অগণতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে বিজয়ের মধ্য দিয়ে বিগত নব্বই দশকের শুরুতে যে রাজনৈতিক মতৈক্য ও সর্বদলীয় সমঝোতা গড়ে উঠেছিল তার মূল এজেন্ডাই ছিল জাতীয় নির্বাচনের সকলের জন্য সমান সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে নির্বাচনকে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার অঙ্গিকার। তিনজোটের রূপরেখায় নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্বাবধায়ক সরকারের প্রস্তাব এ কারণেই সব দল ও সব মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন লাভ করেছিল। মানুষের সেই সমর্থন বিফলে যায়নি। কিছু বিচ্ছিন্ন বিতর্ক বাদ দিলে নির্বাচনকালীন তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সবগুলো নির্বাচনই দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত যে কোন নির্বাচন থেকে ভাল ও গ্রহনযোগ্য হয়েছে। এ ক্ষেত্রে একটি সাধারণ সাজুয্য বর্তমান, আর তা হচ্ছে- নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সর্বশেষ ক্ষমতাসীন দলের বড় ভরাডুবি ঘটতে দেখা যায়। রাজনৈতিক পরিভাষায় যাকে ‘ইনকামব্যান্সি ফ্যাক্টর’ বলে অভিহিত করা হয়। আর ক্ষমতা ত্যাগের আগেই নানা জরিপ ও গোয়েন্দা রিপোর্টে ক্ষমতাসীনরা পরবর্তি নির্বাচনে নিজেদের ভরাডুবি আঁচ করেই তত্বাবধায়ক সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উদাহরণ সামনে এনে নিজেদের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের অজুহাত খাড়া করে থাকে। এ ক্ষেত্রে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী এবং ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারী একপাক্ষিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিএনপি ও আওয়ামিলীগ প্রমান করেছে ক্ষমতা হারানোর ভয়ে দু’পক্ষই জনগনের রায়ের মুখাপেক্ষি হতে চায়না। তবে দুই দলের নেতাদের মধ্যে কিছুটা ব্যতিক্রমী ইতিহাসও তৈরী হয়েছে। পনের ফেব্রুয়ারী নির্বাচনের আগে বিএনপি নেতা বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচনকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা হিসেবে আখ্যায়িত করে শুধুমাত্র তত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে সন্নিবেশিত করেই নতুন নির্বাচন দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা’ রক্ষা করেছিলেন এবং তিনমাসের মধ্যেই নতুন নির্বাচন দিয়ে ১৯৯৬ সালের জুনমাসে ২১ বছর পর আওয়ামিলীগকে পুনরায় ক্ষমতায় আসার পথ করে দিয়েছিলেন। তত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা না থাকলে হয়তো আওয়ামিলীগের পক্ষে ক্ষমতায় আসা সম্ভব হতো না। অন্যদিকে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারী নির্বাচনের আগে এবং অব্যবহিত পরে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ৫ জানুয়ারী নির্বাচনকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা আখ্যায়িত করে শীঘ্রই জাতীয় সমঝোতার ভিত্তিতে নতুন নির্বাচন দেয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। অধিকাংশ আসনে বিনাভোটে নির্বাচিত হওয়ার অগণতান্ত্রিক উদাহরণ সৃষ্টির পর এ নির্বাচনকে মেনে না নিয়ে নতুন করে একটি গ্রহনযোগ্য নির্বাচনের জন্য বিশ্বসম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে সরকারের প্রতি বার বার তাগিদ দেয়ার পরও এ ব্যাপারে কোন সমঝোতার উদ্যোগ না নিয়ে আরেকটি একতরফা নির্বাচনের চেষ্টা চালাচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। সেখানে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচনকালীন তত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল এবং নির্বাচন কমিশন আইনের মারাপ্যাঁচ কাজে লাগিয়ে প্রধান বিরোধিদল বিএনপির নিবন্ধন বাতিলের জুজু দেখিয়ে সংসদ বহাল রেখেই শেখ হাসিনার অধীনে বিএনপিকে নির্বাচনে আসতে বাধ্য করার চেষ্টা চলছে।
একটি সিনেমা হলের মালিকানা বিষয়ক মামলার রায়ে সর্বোচ্চ আদালত তার পর্যবেক্ষণে নির্বাচনকালীন তত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। যেখানে বলা হয়েছিল সরকার ইচ্ছা করলে আরো দুই দফা এই ব্যবস্থায় নির্বাচন করতে পারে। সুপ্রীমকোর্টের এই পর্যবেক্ষণকে কাজে লাগিয়েই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে আওয়ামিলীগ দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করে নেয়। সেই থেকে দেশের নির্বাচনব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা এবং রাজনৈতিক অচলাবস্থা একটি অনিশ্চিত যাত্রায় সামিল হয়েছে। উল্লেখ্য, যে মুন সিনেমা হলের মালিকানা সংক্রান্ত মামলার রায় দিতে গিয়ে সংবিধানের অন্তত ৩টি সংশোধনী অবৈধ ঘোষনা করে বাতিল করে দেয়া হলেও মামলার মূল বিষয়বস্তুু সিনেমা হলের মালিকানা সংক্রান্ত রায় বাস্তবায়নে সরকার কোন পদক্ষেপই নেয়নি। মামলা রায়ে ৬০ দিনের মধ্যে মূল মালিককে সম্পত্তি ফেরত দিতে বলা হলেও রায় ঘোষিত হওয়ার তিন বছর পরও সম্পত্তি ফেরত না পেয়ে মামলার বাদিপক্ষ সরকারের সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ করেছিলেন। অভিযোগ দায়েরের পর আরো ৩ বছর এবং রায় ঘোষণার ৬ বছর পার হওয়ার পরও রিটকারী মালিকপক্ষ সম্পত্তি ফেরত পায়নি। অথচ ২০১১ সালের ৫ মে রিভিও আবেদনের রায় প্রকাশের দুই মাসের মধ্যে রায়ের অনুকুলে সংবিধানের পঞ্চম, অষ্টম ও ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাস করে সরকার। এই সংশোধণীতে সংবিধানে কয়েকটি মৌলিক পরিবর্তন আনা হলেও এসব সংশোধনীতে সংসদের বিরোধিদল বিএনপি’র কোন ভূমিকাই ছিলনা। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর পর এর প্রক্রিয়া ও নীতিগত পদ্ধতির সমালোচনা করে দেশের সংবিধান বিশেষজ্ঞরা এ পদ্ধতিকে অগণতান্ত্রিক বলে আখ্যায়িত করেছেন। সংসদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে অনৈতিক কায়দায় রাষ্ট্রের সংবিধান সংশোধনের এই পদ্ধতিকে মার্কিন ফাউন্ডিং ফাদারদের অন্যতম ও চতুর্থ প্রেসিডেন্ট জেমস মেডিসন ‘টাইর্যানি অব দি মেজরিটি’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। এ ধরনের রাজনৈতিক পদক্ষেপের ফলে সমঝোতার পরিবেশ বিঘিœত হয় এবং সংঘাতের রাজনীতির প্রসার ঘটে। বাংলাদেশে বিগত তিন-চার বছরের রাজনৈতিক বাস্তবতায় তারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। রাষ্ট্রের তিনটি মূল স্তম্ভ বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ এবং আইনসভার দায়-দায়িত্ব এবং ক্ষমতার ‘চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স’ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে সংসদীয় পদ্ধতির একটি সরকার বেপরোয়া ক্ষমতা চর্চার সুযোগ গ্রহণ করতে পারে। নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তর ও জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে বিশেষত: বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। এ কারণেই সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের পর্যবেক্ষণ দেশের গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রশ্নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পুন:স্থাপনের মাধ্যমে বিচারপতিদের অভিসংশনের ক্ষমতা সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের হাত থেকে জাতীয় সংসদের হাতে পুন:ন্যাস্ত করে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে পাস করা ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া রায়টি এখন দেশে একটি অনাকাঙ্খিত রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। গত ১লা আগস্ট রায় ঘোষিত হওয়ার পর থেকে সরকারের আইন সভা ও নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগের সাথে রীতিমত এক ধরনের অঘোষিত যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। এ ক্ষেত্রে একজন সাবেক প্রধান বিচারপতিসহ সরকারের অনুগত কয়েকজন সাবেক বিচারপতি যেমন বর্তমান প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে কঠোর ভাষা প্রয়োগ করেছেন, বর্তমান সংসদীয় গণতন্ত্রের শরিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ব্যাপক জনসমর্থনপুষ্ট বিএনপি’র নেতারা প্রকাশ্যই আপীল বিভাগের পর্যবেক্ষণের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। স্বাধীনতার পর থেকে মূলত রাজনৈতিক ক্ষমতাসীনদের কারণে আমাদের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর তিনটি অঙ্গ বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য বিনষ্ট হওয়ায় দেশের মানুষ ক্রমে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। আইন সভা ও মন্ত্রীসভার একেকজন সদস্য যেন নিজ এলাকার নব্য জমিদারে পরিণত হয়েছেন। এ কথা ঠিক যে, আমাদের দেশের নাম গণপ্রজাতন্ত্রি বাংলাদেশ, সিংবিধান অনুসারে দেশের জনগণই এই প্রজাতন্ত্রের মালিক। কিন্তু যেখানে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোট ছাড়াই অধিকাংশ আসনে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠনের সুযোগ থাকে, যেখানে বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন বা দুর্নীতি দমন কমিশনকে নির্বাহী বিভাগের প্রভাবাধীনে কাজ করতে হয়, সেখানে নির্বাচনকে ক্ষমতার প্রভাবমুক্ত রাখা এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করা প্রায় অসম্ভব। আমাদের দেশের গত কয়েক দশকের রাজনৈতিক বাস্তবতায় দেশের নাগরিক সমাজ ও সচেতন জনমন্ডলির বাইরেও অতি সাধারণ মানুষের মধ্যেও এই উপলব্ধি ঘটেছে যে, সরকার গঠনে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং রাষ্ট্রের তিনটি প্রধান অঙ্গের মধ্যে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান বা চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স তৈরি করা জরুরি। আগামী বছর অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে এখনো দেশে কোন রাজনৈতিক সমঝোতা ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ দেখা যাচ্ছেনা। এরই মধ্যে প্রায় আটশ পৃষ্ঠার রায় পুরোটা পাঠ ও অনুধাবন করা না গেলেও যতদূর বোঝা যায়, ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পর্যবেক্ষণে আমাদের সমসাময়িক ও ভবিষ্যত রাজনীতির কালো ও অস্বচ্ছ অধ্যায়গুলোতে আলো ফেলা হয়েছে। তবে সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের প্রতিক্রিয়া অনুসারে এ দেশের মানুষ বাংলাদেশকে ‘জাজেস রিপাবলিক’ হিসেবে দেখতে চায়না। বাংলাদেশের মানুষ সত্যিকার অর্থে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ ও আইনের শাসন দেখতে চায়। এ দেশের বিচারপতি, আমলা, সরকারের মন্ত্রী, এমপি, সরকারী ও বিরোধিদলের নেতাসহ সকলেই দেশের স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তুলতে দেশের মানুষের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। দেশ এখন একটি দীর্ঘমেয়াদি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। দেশে চলমান প্রাকৃতিক, রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক দুর্যোগে একটি সামাজিক-রাজনৈতিক সমঝোতার পরিবেশ গড়ে তোলা আবশ্যক। ক্ষমতার জোরে রায় বাস্তবায়ন বিলম্বিত করা যায়, গোপন সমঝোতাও অসম্ভব নয়। তবে দেশের কোটি কোটি মানুষের চোখ, বিবেক, স্মৃতি ও ইতিহাসকে ফাঁকি দেয়া সম্ভব নয়। শুধু বিচারপতি ও সরকারের সমঝোতা বা বোঝাপড়া নয়, আগামী নির্বাচন এবং আগামী দিনের বাংলাদেশকে নিয়ে স্বপ্ন বাস্তবায়নে দেশের মানুষ একটি ব্যাপকভিত্তিক রাজনৈতিক সমঝোত ও আইনগত সংস্কারের প্রত্যাশা করছে। সংবিধানের ষোড়শ সংশাধনী বাতিলের রায় ও আপীল বিভাগের পর্যবেক্ষণ সে ক্ষেত্রে একটি নতুন সম্ভাবনা তৈরী করেছে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।