Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

হজের পাঁচদিন করণীয়

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ১৮ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

বর্তমানকালে ৮ জিলহজ থেকে ১২ জিলহজ পাঁচদিনব্যাপী হজ কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিকতা পালন করা হয়ে থাকে। নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৭ জিলহজ হজের সূচনা খুতবার মাধ্যমে করেছিলেন এবং তিনি সা. ১৩ জিলহজ মিনা ত্যাগ করেছিলেন। সাহাবাগণের মধ্যে যারা ১২ জিলহজ মিনা ত্যাগ করতে চেয়েছিলেন তাদেরকে সূর্যাস্তের পূর্বে তিন জামারায় পাথর নিক্ষেপ শেষ করে মিনা ত্যাগ করার অনুমতি দিয়েছিলেন। ফলে একালে ৮-১২ জিলহজ হজ কার্যক্রম চলছে। স্বল্প সংখ্যক হাজী ১২ জিলহজ মিনা অবস্থান করে ১৩ জিলহজ তিন জামারায় পুনঃ পাথর নিক্ষেপ করে মিনা ত্যাগ করেন। পবিত্র মক্কা ও নিকটস্থ মিনা, আরাফাত ও মুজদালিফা তথা এ ১৬ বর্গ কি.মি. এরিয়াকে কেন্দ্র করে চলে হজ কার্যক্রম।
হজ উপলক্ষে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বিপুল সংখ্যক মুসলিম নর-নারী পবিত্র মক্কায় এসে অবস্থান নেন। যারা হজের আগে জিয়ারতের উদ্দেশ্যে পবিত্র মদীনা গিয়েছিলেন, তারাও হজের কয়েকদিন বাকি থাকতেই পবিত্র মক্কা পৌঁছে যান। হজের কার্যক্রম শুরু হওয়ার ২/৩ দিন আগে থেকেই জেদ্দা বিমান বন্দরে হজ যাত্রীদের আগমন বন্ধ করে দেওয়া হয়। অন্যথায় হজযাত্রীদের সময়মতো মক্কায় জমা করা সম্ভব হয় না। বস্তুত জিলহজ মাসের শুরু থেকেই পবিত্র মক্কায় হজ যাত্রী সমাগম ব্যাপকতর হতে থাকবে।
আগে সউদী আরবে অবস্থানরত প্রবাসীরা হজ করতে আসতেন, তেমনিভাবে সউদীরাও হজ করতে আসতেন তাদের নিজস্ব গাড়ি নিয়ে। এ সংখ্যা লাখ লাখ বলা যাবে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে সউদী সরকার কঠোর আইন করেছে যাতে যে কেউ অনুমতি ছাড়া হজ করবার জন্য পবিত্র মক্কায় আসতে না পারে, ব্যবস্থাপনা ও শৃঙ্খলার জন্য। সউদী নাগরিকদেরও যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে মোয়াল্লেমের নিয়ন্ত্রণে থেকে হজ করতে হয়। তাও পাঁচ বছরে একবার। হজের বহু আগে থেকেই পবিত্র মক্কার চতুষ্পার্শে¦ কড়া চেকপোস্ট বসানো হয়। যাতে যেনতেনভাবে যে কেউ পবিত্র মক্কায় ঢুকতে না পারে। এতে হাজীর সংখ্যা হঠাৎ কমে ৩০-৩৫ লাখ থেকে এখন ২০-২৫ লাখ হয়েছে।
জিলহজ মাসের ৪ তারিখ থেকে ৭ তারিখের মধ্যে সমস্ত পবিত্র মক্কা শহর হজযাত্রীতে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। তখন সকাল-বিকাল-রাত-দিন সব সমান। হজযাত্রীগণ তথা আল্লাহর মেহমানদেরকে বুকে ধারণ করে এই পবিত্র শহর এক অপূর্ব জনসমুদ্রের রূপ লাভ করে। এ সময় সউদী সরকারের সমস্ত দৃষ্টি এ দিকে নিবদ্ধ থাকে। নিরাপত্তা, পানি, খাদ্য, চিকিৎসা, যানবাহন নিয়ন্ত্রণ সবকিছু স্বাভাবিক রাখতে সউদী সরকারকে হিমশিম খেতে হয়।
আমাদের বাংলাদেশ থেকে যারা প্রথম হজ করতে যান, তারা কিছুটা টেনশনে থাকেন যে হজের আহকাম সুষ্ঠুভাবে পালন করতে পারবেন কি-না; বিশেষ করে যাদের সাথে মহিলা থাকে। মনে রাখা দরকার, হজযাত্রীগণ আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলার দাওয়াতি মেহমান। সুতরাং বিব্রত হওয়ার কোন কারণ নেই। বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি সব হজযাত্রী মোয়াল্লেমের তত্ত¡াবধানে হজ করে থাকেন। আপনাকে প্রথমেই এক দুইটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ১০ তারিখ মিনাতে হজের কোরবানী নিজ উদ্যোগে করবেন নাকি মিনা রওয়ানা হবার আগে পবিত্র মক্কার ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে কোরবানীর কুপন কিনে করবেন।
৭ জিলহজ জোহরের নামাজের পর কা‘বা শরীফের ইমাম সাহেব খুতবা দিবেন। ঐ খুতবায় হজের আহকামের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা থাকে। আপনি যদি কেরান বা ইফরাদ হজযাত্রী হন, তবে হজের প্রথম ফরজ ইহরাম অবস্থায় আছেন। যদি আপনি তামাত্তু হজযাত্রী হন (বাংলাদেশী ৯৮ ভাগই তামাত্তু হজ করেন, এটাই উত্তম।) তবে সাধারণ পোশাকে আছেন বিধায় অদ্য হজের নিয়তে (প্রথম ফরজ) ইহরাম পরিধান করে নিবেন। উল্লেখ্য হজ তিন প্রকার: কেরান, তামাত্তু ও ইফরাদ।
৮ তারিখ সকালে মিনা রওয়ানা হয়ে যাওয়াই তরতিব। তবে মোয়াল্লেমগণ গাড়ির স্বল্পতা ও ভিড় এড়াবার জন্য ৭ তারিখ সন্ধ্যা থেকে হজযাত্রীগণকে পবিত্র মক্কা থেকে মিনা নিয়ে যাওয়া শুরু করে থাকে। আপনি সরকারি হজযাত্রী হয়ে সরকারি ঘরে থাকলে এশার পর মোয়াল্লেমের বাস আপনার দালানের নিকট এসে আপনাকে উঠিয়ে নিবে। সরকারি গাইড আপনাকে সহায়তা করবে। আর যদি থাকেন বেসরকারি হয়ে কাফেলা এজেন্সির ঘরে তবে সন্ধ্যায় বা এশার নামাজের পর ৫ দিনের জরুরি ব্যবহার্য হলকা কাপড়চোপড় নিয়ে বাসের অপেক্ষায় থাকতে হবে। যখন পর্যায়ক্রমে বাসগুলো আসতে থাকবে তখন হুড়োহুড়ি পরিহার করে লাইনে দাঁড়িয়ে বাসে উঠা দরকার। এ সব বাস দিয়ে ৮ জিলহজ সকাল পর্যন্ত হজযাত্রী পরিবহন করা হয়। মিনায় ৮ তারিখ জোহর থেকে পরদিন ফজর পর্যন্ত মোট ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়া সুন্নাত। মিনায় অবস্থান করাই ইবাদত, এ স্থানে নামাজ ও দোয়া ব্যতীত তেমন কোন কাজ নেই। সাম্প্রতিককালে মিনায় মোয়াল্লেম তার নিয়ন্ত্রণাধীন সমস্ত হাজীকে রান্না করে খাওয়ায়। তার বিনিময়ে কাফেলা এজেন্সি থেকে টাকা নিয়ে থাকে।
মিনা থেকে ৯ তারিখ সকালে আরাফাতের উদ্দেশে রওয়ানা হওয়া সুন্নাত। কিন্তু এখানেও মোয়াল্লেমগণ বাসের স্বল্পতা ও ভিড় এড়ানোর জন্য ৮ তারিখ এশার পর থেকে হজযাত্রীগণকে আরাফাতের দিকে নিয়ে যাওয়া শুরু করে। আরাফাত হজের দ্বিতীয় (এবং প্রধান) ফরজ। এই ফরজের বিকল্প বা কাফ্ফারা কোন কিছুই আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। অর্থাৎ যে ব্যক্তি ৯ তারিখ আরাফাতে প্রবেশ করতে না পারল তার হজ হল না। আরাফাত দোয়া কবুলের অন্যতম স্থান। এখানে হজযাত্রীগণ একদিনের জন্য মোয়াল্লেমের তাঁবুতে অবস্থান করেন। মোয়াল্লেমগণ এদিন তাদের আওতাধীন সমস্ত হাজীদের জন্য দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করে থাকেন। আরাফাতের একমাত্র মসজিদ মসজিদে নামিরাতে একসাথে জোহর ও আছর নামাজ পড়া হয়। বাংলাদেশী হাজীরা আমাদের হানাফী মাজহাব অনুযায়ী তাঁবুতে জোহর ওয়াক্তে জোহর, আসর ওয়াক্তে আসর কসর করে পড়বেন। তবে বর্তমানে অনেক কাফেলা এজেন্সিরা তাঁবুতেও জোহর আসর মসজিদে নামিরার মতো পরপর পড়ে থাকেন। মাঠে, রাস্তায় বা তাঁবুতে অবস্থান করে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করা দরকার। ঐ দিন আরাফাতে উপস্থিত হাজীদের ওপর আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে এত অধিক রহমত বর্ষিত হয় যে, তা দেখে শয়তান একেবারে হতাশ ও নিরুদ্যম হয়ে পড়ে।
আরাফাত থেকে সূর্যাস্তের পরপর মুজদালিফা অভিমুখে রওয়ানা হতে হয়। এ সময় কিন্তু হজযাত্রীগণকে মোয়াল্লেমের বাস নিয়ে কিছুটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হতে পারে। যেহেতু আরাফাত থেকে মুজদালিফায় মোয়াল্লেমের বাসের একাধিক ট্রিপ দিতে হয়, তাই প্রথম ট্রিপে মুজদালিফা যেতে হলে সূর্যাস্তের অনেক আগে থেকেই বাসে উঠে সূর্যাস্তের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। আর দ্বিতীয় ট্রিপে যেতে অনেক সময় আরাফাতে গভীর রাত হয়ে যেতে পারে।
আরাফাত থেকে মুজদালিফায় পৌঁছে এশার ওয়াক্তে এক আজান দুই ইকামতে মাগরিব ও এশার নামাজ পড়তে হয়। অতঃপর মিনায় শয়তানের প্রতি নিক্ষেপ করার নিমিত্তে ৪৯টি পাথর সংগ্রহ করবেন। মুজদালিফায় মোয়াল্লেম তথা কাফেলা এজেন্সির কোন ব্যবস্থাপনা নেই। নিজ উদ্যোগে রাতের অবস্থান ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করতে হয়। মুজদালিফায় অবস্থান করে ভোরে সুবহে সাদিক হওয়ার তোপধ্বনি শুনলে ফজরের নামাজ পড়ে মিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবেন। পাহাড়ঘেরা মিনার ময়দান অনেকটা উত্তর-দক্ষিণ লম্বালম্বি। সরকারি হাজী এবং বাংলাদেশের কয়েকটি মাত্র এজেন্সির হাজী অতিরিক্ত টাকা ব্যয় করে মিনার মধ্যখানে অনেকটা জামারার নিকটের তাঁবুতে অবস্থান করে থাকেন। বাকি বাংলাদেশী লক্ষাধিক হাজী মিনার দক্ষিণে মুজদালিফায় এবং মিনার পূর্বে পাহাড়ের অপরপ্রান্তে মোয়াল্লেমের তাঁবুতে অবস্থান নেন।
মুজদালিফা থেকে ১০ তারিখ ভোরে মিনা রওয়ানা হতে আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনি কি তাঁবুতে যাবেন নাকি কংকর নিক্ষেপ করতে সরাসরি শয়তানের দিকে চলে যাবেন। এদিন তথা ১০ জিলহজ পরপর হজের ৪টি আহকাম রয়েছে। তথা প্রথম দিন শুধুমাত্র বড় জামারায় ৭টি পাথর নিক্ষেপ (দ্বিতীয় ওয়াজিব) করে দমে শুকরিয়া (তৃতীয় ওয়াজিব) তথা হজের কোরবানী করতে হয়। যা তামাত্তু ও কেরান হাজীর জন্য ওয়াজিব, ইফরাদ হাজীর জন্য মুস্তাহাব। অতঃপর মাথার চুল কাটতে হবে (চতুর্থ ওয়াজিব)। এরপর ইহরাম মুক্ত হবেন। পবিত্র মক্কায় হজের (তৃতীয় ফরজ) তাওয়াফ করবেন। সাথে সাথে হজের পঞ্চম ওয়াজিব সাফা-মারওয়া তারতিব মতো সায়ী করতে হবে। হজের তৃতীয় ফরজ তাওয়াফ, অতঃপর সাফা-মারওয়া সায়ী ১০ তারিখ করতে পারাটা উত্তম। সম্ভব না হলে, ১১ বা ১২ তারিখও করা যায়।
১১ জিলহজ জোহর ওয়াক্ত থেকে প্রথমে ছোট জামারা, অতঃপর মেজ জামারা, অতঃপর বড় জামারায় ৭টি করে ২১টি পাথর নিক্ষেপ করতে হবে। অনুরূপভাবে ১২ জিলহজ জোহর ওয়াক্ত থেকে ৩ শয়তানের প্রতি ২১টি পাথর নিক্ষেপ (ওয়াজিব) করে সূর্যাস্তের পূর্বে মিনা ত্যাগ করা যায়। যারা চান তারা রাত মিনায় অবস্থান করে ১৩ জিলহজ ৩ শয়তানের প্রতি ২১টি পাথর নিক্ষেপ করে মিনা ত্যাগ করতে পারেন।
হজ কার্যক্রমের শেষ তথা ষষ্ঠ ওয়াজিব পবিত্র মক্কা ত্যাগ করার পূর্বে তাওয়াফ করতে হবে। এটি স্বাভাবিক পোশাকে করা হয় এবং এই তাওফাফে সায়ী নেই।
লেখক : সভাপতি, হজযাত্রী কল্যাণ পরিষদ চট্টগ্রাম।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: হজ

২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ