Inqilab Logo

শনিবার, ২৯ জুন ২০২৪, ১৫ আষাঢ় ১৪৩১, ২২ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

বঙ্গোপসাগর ফুঁসে উঠলে বন্যার আরো অবনতি ঘটবে

| প্রকাশের সময় : ১৬ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

শফিউল আলম : বন্যার গ্রাস ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। গতকাল (মঙ্গলবার) যমুনা নদ ৫টি পয়েন্টের সবকটিতে, ব্রহ্মপুত্র নদ ২টিতেই এবং পদ্মা ২ পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। রাক্ষুসী যমুনায় পানি মারাত্মক হারে বৃদ্ধি পেয়ে বাহাদুরাবাদে অতীতের সর্বোচ্চ রেকর্ড অতিক্রম করেছে এবং বিপদসীমার ১৩২ সেমি উপর দিয়ে (২০.৮২ মিটার) প্রবাহিত হচ্ছে। রাজধানী ঢাকার চারপাশেও বন্যার পদধ্বনি দেখা দিয়েছে।
কেননা বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু, তুরাগ, টঙ্গী-খাল, কালিগঙ্গা, ধলেশ্বরী, বংশী নদী, শাখা ও উপনদীর পানি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঢাকার আশপাশের এই ৮টি নদী বিপদসীমার ৩৭ সেমি থেকে ১৯৩ সেমি নিচে রয়েছে। উত্তর ও উত্তর-পূর্বে নিম্নাঞ্চলে বন্যার অবনতির ফলে দেশের মধ্যাঞ্চল ও দক্ষিণ-মধ্যাঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত হচ্ছে। বর্তমানে ২৫টি জেলায় প্রায় ৮ লাখ মানুষ বন্যা কবলিত। সর্বশেষ তথ্য-উপাত্তে ১৯টি নদ-নদী ৩০টি পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
আর নর্বনাশা বানের তোড়ে তলিয়ে যাচ্ছে হাজারো গ্রাম-জনপদ আর শহর। সেই সাথে ভয়ানক আকারে বৃদ্ধি পেয়েছে নদীভাঙন। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, হিমালয় পাদদেশীয় অঞ্চলসমূহ চীন তিব্বত, নেপাল, ভূটান এবং ভারতের বিহার, গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ, সিকিম থেকে শুরু করে আসাম, অরুণাচল, মেঘালয়সহ উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে অতিবর্ষণের কারণে উজানভাগের নদ-নদী অববাহিকায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ভারতীয় আবহাওয়া বিভাগ আগামী সপ্তাহ পর্যন্ত ব্যাপক অঞ্চলজুড়ে অতিবর্ষণ, পাহাড়ি ঢল ও বন্যার সর্বাত্মক সতর্কতা বজায় রেখেছে। এ অবস্থায় ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদ, গঙ্গা-পদ্মা ও মেঘনায় অর্থাৎ প্রধান তিনটি অববাহিকায় বাংলাদেশ প্রান্তে নদ-নদী শাখা ও উপনদীসমূহে উজানের পানির চাপ আরো বৃদ্ধি পেতে পারে। এতে করে বন্যার আরো অবনতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। কেননা বাংলাদেশে মূল তিনটি অববাহিকায় অবস্থিত নদ-নদীগুলোর ৭০ থেকে ৯৪ ভাগ পানি উল্লেখিত উজানের মূল উৎস (ক্যাচমেন্ট এরিয়া) হতেই আসে।
বন্যা পরিস্থিতির পূর্বাভাস বিষয়ে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) জলবায়ু ও পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মোঃ রিয়াজ আখতার মল্লিক গতকাল ইনকিলাবকে জানান, বন্যার অবনতির সাথে ভাটিতে বঙ্গোপসাগরে এই বন্যার পানি গড়ানো বা অনায়াসে অপসারিত (ড্রেনেজ) হবে কিনা সেই বিষয়টিও একটি ফ্যাক্টর হিসেবে বিবেচিত। কেননা বৈশ্বিক উষ্ণায়নে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এমনতিইে বেড়ে চলেছে। দেশের নদ-নদীসমূহের বেশিরভাগই তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে এবং নদীর তীরেও পর্যাপ্ত উঁচু বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের অভাব রয়ে গেছে। অনেক বাঁধ ভাঙাচোরা, জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। তদুপরি বর্তমান সময়টাতে যদি বাংলাদেশ সংলগ্ন উত্তর বঙ্গোপসাগর-উপকূল স্ফীত হয়ে উঠে তাহলে ভাটির দিকের পানির অপসারণ বাধাপ্রাপ্ত হবে এবং বন্যার আরো অবনতি ঘটতে পারে। প্রসঙ্গত চলতি মাসে বঙ্গোপসাগরে একাধিক লঘুচাপ সৃষ্টি এবং এরমধ্যে একটি মৌসুমি নিম্নচাপ হতে পারে। তাছাড়া আগামী ২১ আগস্ট রয়েছে অমাবস্যা-লগ্নের ভরা জোয়ার। এই দুটি কারণে যে কোন সময়ই ফুলে-ফুঁসে উঠতে পারে সাগর-উপকূলভাগ।
এদিকে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র সূত্রে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি ও নদ-নদী প্রবাহের সর্বশেষ পূর্বাভাসে জানা যায়, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা এবং গঙ্গা-পদ্মা নদ-নদীসমূহের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপরদিকে সুরমা-কুশিয়ারা নদীসমূহের পানির সমতল হ্রাস পাচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র নদের পানি আগামী ২৪ ঘণ্টায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। আর যমুনা নদের পানিবৃদ্ধি আগামী ২৪ ঘণ্টায়ও অব্যাহত থাকতে পারে। অপরদিকে গঙ্গা-পদ্মা নদীসমূহের পানি বৃদ্ধি আগামী ৭২ ঘণ্টায়ও অব্যাহত থাকতে পারে। তবে বৃহত্তর সিলেটের সুরমা-কুশিয়ারা নদীসমূহের পানি আগামী ৪৮ ঘণ্টায় হ্রাস পেতে পারে। উজানের বৃষ্টিপাতের অবস্থা সম্পর্কে ভারতীয় আবহাওয়া বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বিগত ২৪ ঘণ্টায় বাংলাদেশের উজানভাগে ভারতের আসাম ও মেঘালয়ের অনেক জায়গায় হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাত হয়েছে। তবে ভারী বৃষ্টি হয়নি। গঙ্গা অববাহিকায় উজানে বিহারে অধিকাংশ জায়গায় হালকা বা মাঝারি বর্ষণ হয়েছে। ব্রহ্মপুত্র নদ সবকটি পয়েন্টে বিপদসীমার উপরে প্রবাহিত হচ্ছে। যমুনা নদ বাহাদুরাবাদ, সারিয়াকান্দি, কাজীপুর ও সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ব্রহ্মপুত্র-যমুনার পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাসে ভারতের আসাম, মেঘালয় ও অরুণাচলে বর্ষণ আগামী ২৪ ঘণ্টায় কমতে পারে। তবে আজ (বুধবার) পর্যন্ত দুদিন ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় ভারতের আসাম ও মেঘালয় প্রদেশে ভারী বর্ষণ হতে পারে। ব্রহ্মপুত্রের ভারতীয় অংশে গত ২৪ ঘণ্টায় আসামের গোয়াহাটি, পান্ডু, গোয়ালপাড়া ও ধুবরীতে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় ধুবরী ও গোয়াহাটিতে পানি কমতে পারে। এ অবস্থায় ব্রহ্মপুত্রের বন্যা আগামী ২৪ ঘণ্টায় অপরিবর্তিত এবং যমুনায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে।
এদিকে গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকায় গত ২৪ ঘন্টায় গঙ্গার পাংখা (চাঁপাইনবাবগঞ্জ), রাজশাহী ও হার্ডিঞ্জব্রিজ পয়েন্টে পানির সমতল যথাক্রমে ২২ সেমি, ২৬ সেমি ও ২৫ সেমি করে বৃদ্ধি পেয়েছে। পদ্মা নদীর পানি আরও বৃদ্ধি পেয়ে গোয়ালন্দে (রাজবাড়ী) বিপদসীমার ৬২ সেমি ও ভাগ্যক‚লে (মুন্সিগঞ্জ) ১০ সেমি উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এমনকি ভাটির দিকে সুরেশ্বরে বিপদসীমার ২২ সেমি নিচে এসে গেছে। বর্তমানে গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি সমতল রাজশাহী ও হার্ডিঞ্জব্রিজ পয়েন্টে পানি আরো বেড়ে গিয়ে যথাক্রমে বিপদসীমার ১.৫৭ মিটার ও ৯২ সেমি নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পূর্বাভাস মতে, গঙ্গা-পদ্মার উজানে আগামী ২৪ ঘন্টায় ভারতের বিহারে ভারী বৃষ্টিপাত হতে পারে। গঙ্গা নদীর বাংলাদেশের উজানে ভারতে ফারাক্কায় পানির সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাহেবগঞ্জ পয়েন্টে পানি অপরিবর্তিত আছে। আগামী ২৪ থেকে ৩৬ ঘণ্টায় গঙ্গা নদীর বাংলাদেশের উজানে পানি বৃদ্ধি পাবে। এতে করে আগামী ৭২ ঘণ্টায় বা তিন দিনেও গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে।
মেঘনা অববাহিকায় গত ২৪ ঘণ্টায় বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অববাহিকার বৃহত্তর সুরমা-কুশিয়ারা নদীসমূহের পানি কিছুটা কমেছে। সর্বশেষ সুরমা নদী কানাইঘাটে ৯৪ সেমি, সিলেটে ৪৫ সেমি ও সুনামগঞ্জে ৬৬ সেমি, কুশিয়ারা নদী অমলশীদে ৭৫ সেমি, শেওলায় ৬৮ সেমি ও শেরপুর-সিলেটে ৩ সেমি, পুরাতন সুরমা নদী দিরাইয়ে ১০ সেমি, কংস নদী নেত্রকোণা জেলার জারিয়াজঞ্জাইলে ১৫৭ সেমি এবং তিতাস নদী ব্রা‏হ্মণবাড়িয়ায় বিপদসীমার ৩ সেমি উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। সুরমা-কুশিয়ারা নদীর পানি আগামী ৪৮ ঘণ্টায় হ্রাস পেতে পারে। আবহাওয়া পূর্বাভাসে আগামী ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রাম বিভাগে ভারী বৃষ্টিপাত হতে পারে। এরফলে আগামী ২৪ ঘণ্টায় দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় পার্বত্য অববাহিকায় কয়েকটি নদীর পানি বৃদ্ধির শঙ্কা রয়েছে।
উল্লেখযোগ্য নদ-নদীর বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহের গতকাল সর্বশেষ অবস্থান ছিল- প্রধান অববাহিকায় ব্রহ্মপুত্র নদ কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী পয়েন্টে পানি আরও বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৮৬ সেমি উপর দিয়ে এবং নুনখাওয়া পয়েন্টে ১৪ সেমি উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। যমুনা নদে গতকালও ৫টি পয়েন্টেই পানি আরো ব্যাপক হারে বেড়েছে। এরমধ্যে বাহাদুরাবাদে বিপদসীমার ১৩২ সেমি উপরে, সারিয়াকান্দিতে ১২০ সেমি উপরে, কাজীপুরে ১৪০ সেমি, সিরাজগঞ্জে ১৩৪ সেমি ও ভাটিতে আরিচায় ৪৪ সেমি উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। বিপদসীমার এক মিটারের (১শ’ সেমি) ঊর্ধ্বে প্রবাহিত যমুনাসহ বিভিন্ন নদ-নদী রেড অ্যালার্ট সতর্কতার পর্যায়ে রয়েছে।
উত্তর জনপদের ধরলা নদীর পানি কুড়িগ্রামে বিপদসীমার ৮৯ সেমি উপরে, বদরগঞ্জে যমুনেশ্বরীর পানি আরো বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১৪৩ সেমি উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। দেশের মধ্যাঞ্চলে বন্যা আরও বিস্তারের ফলে ঢাকা বিভাগের টাঙ্গাইলের এলাসিনঘাটে ধলেশ্বরী নদীর পানি আরো বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৭৫ সেমি উপর দিয়ে, আত্রাই নদী বাঘাবাড়িতে ২৮ সেমি উপরে, লাক্ষ্যা নদী ১২ সেমি উপরে এবং সিংরায় গুর নদী ৩২ সেমি উপরে প্রবাহিত হয়। গঙ্গা-পদ্মা ছাড়াও এই অববাহিকায় নদীগুলোতে পানিবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। একই অববাহিকায় দিনাজপুরে পুনর্বভা নদী বিপদসীমার ৪৫ সেমি উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তাছাড়া বিপদসীমার উপরে রয়েছে ইছ-যমুনা, ছোট যমুনা, আত্রাই ও কপোতাক্ষ নদ-নদী।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বন্যা

১৫ অক্টোবর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ