Inqilab Logo

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

উত্তারাঞ্চলের তিন জেলায় ফের বন্যা

ভারতের ঢল ও টানা বৃষ্টিতে বাড়ছে তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি কুড়িগ্রামের উলিপুরে ব্যাপক ভাঙন পানি নিয়ন্ত্রণে ব্যারাজের ৪৪টি গেট খুলে দেওয়া হয়েছে

ইনকিলাব রিপোর্ট | প্রকাশের সময় : ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

ভারত থেকে নেমে আসা ঢল ও টানা বৃষ্টিপাতের ফলে উত্তরাঞ্চলের তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি বাড়ছে। ফলে রংপুর, গাইবান্দা ও লালমনিরহাটে আবার বন্যা দেখা দিয়েছে। নদীর পানি বৃদ্ধির ফলে ভাঙনও বাড়ছে। ভাঙনের আতঙ্কে দিন কাটছে নদী পাড়ের বাসিন্দাদের। কুড়িগ্রামের উলিপুরে গত কয়েকদিনে তিস্তা নদীর তীব্র ভাঙনে ৩টি গ্রাম নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে। নদী গর্ভে চলে গেছে ১ কিলোমিটার পাকা সড়ক, একটি কমিউনিটি ক্লিনিক, দু’টি মসজিদ, একটি মন্দির, ঈদগাহ মাঠ, বজরা পশ্চিমপাড়া দাখিল মাদরাসা, পুরাতন বজরা বাজার, একটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, আড়াই শতাধিক বাড়িঘর ও বিস্তীর্ণ আবাদি জমি।

কয়েকবার বন্যার ধকল কাটতে না কাটতেই আবারও পানিবন্দি হয়ে পড়েছে তিস্তাপাড়ের মানুষ। তিস্তাপাড়ের প্রায় লক্ষাধিক মানুষ বন্যা কবলিত। পানি বৃদ্ধিতে চর এলাকায় আমনের ক্ষেত তলিয়ে গেছে। অনেক এলাকায় সবজির ক্ষেতও পানিতে তলিয়ে গেছে। পানি নিয়ন্ত্রণে ব্যারাজের ৪৪টি গেট খুলে দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে ভাঙনও বাড়ছে। গতকাল সকালেও তিস্তায় বিপদ সীমার ১৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। তবে বিকালে সেটা ৩০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। আবাহাওয়া অধিদফতরের তথ্য মতে, উত্তরাঞ্চলে আগামী ২৪ ঘন্টা বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। সেই সাথে উজানের দেশ ভারতেও ভারি বৃষ্টি হতে পারে। এতে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, ধরলা এসব নদীর পানি বাড়তে পারে।

রংপুর থেকে হালিম আনছারী জানান, ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টিতে তিস্তার পানি বেড়ে নিম্নাঞ্চল ও তীরবর্তী এলাকা প্লাাবিত হয়েছে। এতে তিস্তাাপাড়ের প্রায় ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। গতকাল বিকেলে দোয়ানি পয়েন্টে তিস্তর পানি কমলেও ভাটিতে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলার নিম্নাঞ্চলগুলোতে বানের পানি ঢুকে পড়েছে। ইতিমধ্যে গঙ্গাচড়া উপজেলার কোলকোন্দ, লক্ষিটারী, বিনবিনার চরসহ নিম্নাঞ্চলের আমন ক্ষেতসহ অন্যান্য ফসলী জমিতে বানের পানি ঢুকে পড়েছে।

লালমনিরহাট থেকে মোঃ আইয়ুব আলী বসুনীয়া জানান, ভারতের ঢল ও টানা বৃষ্টিতে লালমনিরহাটে তিস্তার পানি বেড়ে বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। ভাটি এলাকায় ধীরে ধীরে পানি বৃদ্ধি পেয়ে নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বন্যা মোকাবেলায় নিজেদের সবটুকু গুছিয়ে নিচ্ছেন নদী পারের মানুষজন। পাউবো উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী রাশেদীন ইসলাম জানান, উজানে অর্থাৎ ভারতে ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। এতে তিস্তার পানি বেড়ে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, গতকাল বিকেল ৩টায় তিস্তার পানি বিপদসীমার ৫ সে.মি.নিচ দিয়ে পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয়েছে।

এ বছর পঞ্চম দফা বন্যায় জেলার পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ, আদিতমারী ও সদর উপজেলার তিস্তা নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে ১৫ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধিতে জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী, শৈইলমারী, নোহালী, চর বৈরাতি, আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা, কালমাটি, পলাশী ও সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ, চোংগাডারা, গোকুণ্ডা ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। লালমনিরহাট জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, তিস্তার পানি বিপদসীমার উপরে প্রবাহিত হয়ে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আমরা জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুত রয়েছি।

গাইবান্ধা থেকে আবেদুর রহমান স্বপন জানান, : গাইবান্ধায় গত দুই দিন থেকে তিস্তা নদী ও ব্রহ্ম নদের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। নদীর কানায় কানায় পানি বিরাজ করছে। যে কোনো সময় বন্যায় রূপ নিতে পারে। গাইবান্ধা সদর, সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার চরাঞ্চলগুলোতে বন্যার পানি উঠে ফসল ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বর্তমানে লালমনিরহাট জেলা ও রংপুর জেলার কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এই পানি ভাটির দিকে প্রবাহিত হলেই গাইবান্ধা সদর সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার চরাঞ্চল বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এদিকে নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে বিভিন্ন এলাকায় ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। একারণে নদীপারের মানুষজন দিশেহারা হয়ে পড়েছে। ভাঙ্গন কবলিত এলাকাগুলো হচ্ছে সুন্দরগঞ্জের পাড়াসাদুয়া, পোড়ারচর, ফুলছড়ির উরিয়া। এলাকাবাসীরা জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ফসলি জমি,গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, রাস্তাঘাট ও দুই শতাধিক বসতবাড়ি নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে। পোড়ার চর এলাকার রেজাউল করিম জানান, গত দুই সপ্তাহে প্রায় এক শতাধিক ঘরবাড়ি নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট ও করতোয়া নদীর পানি বিপদ সীমার অনেক নীচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে নদীর পানি বৃদ্ধির কারলে ঊড়িয়া এলাকাসহ কয়েকটি এলাকায় নদীর তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে।

কুড়িগ্রামের উলিপুর থেকে হাফিজুর রহমান সেলিম জানান, কুড়িগ্রামের উলিপুরে ভয়াবহ ভাঙনের মুখে পরেছেন তিস্তা পারের মানুষজন। গত কয়েকদিনে তিস্তা নদীর তীব্র ভাঙনের কবলে পড়ে ৩টি গ্রাম নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে। নদী গর্ভে চলে গেছে ১ কিলোমিটার পাকা সড়ক, একটি কমিউনিটি ক্লিনিক, দু’টি মসজিদ, একটি মন্দির, ঈদগাহ মাঠ, বজরা পশ্চিমপাড়া দাখিল মাদরাসা, পুরাতন বজরা বাজার, একটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, আড়াই শতাধিক বাড়িঘর ও বিস্তীর্ণ আবাদি জমি। সরেজমিনে উপজেলার বজরা ইউনিয়নের তিস্তা নদীর ভাঙন কবলিত সাতালস্কর, কালপানি বজরা ও পশ্চিম বজরা দেখা যায়, ভাঙন কবলিত এলাকার মানুষজন তাদের শেষ সম্বল ঘর-বাড়ি অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন। আবাদি জমি ও ঘর বাড়ি হারিয়ে অনেকেই নিঃস্ব হয়েছেন।

এলাকাবাসী আব্দুল কাদের (৬৯), সাইফুল রহমান (৪৯), বায়েজিদ আলম (২৯)সহ অনেকে জানান, গত এক মাস ধরে ভাঙন শুরু হয়েছিল বজরা ইউনিয়নের পশ্চিম কালপানি বজরা, সাতালস্কর ও কালপানি বজরা গ্রামে। উত্তরে জজমিয়ার বাড়ি থেকে দক্ষিণে রোস্তম মৌলভীর বাড়ি পর্যন্ত প্রায় দু’কিলোমিটার এলাকাব্যাপী ভাঙন শুরু হয়েছে। এরমধ্যে গত চারদিনে হঠাৎ করে ভাঙনের তীব্রতার ফলে বজরা পশ্চিমপাড়া দাখিল মাদরাসা, পুরান বজরা বাজার, ২টি মসজিদ, ১টি মন্দির, ২টি ঈদগাহ মাঠ, গাছপালা ও ২ শতাধিক একর ফসলি জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। তারা আরও বলেন, ভাঙনের তীব্রতা এমনি ভয়াবহ ছিল যে গত মঙ্গলবার কমিউনিটি ক্লিনিক ও অর্ধশতাধিক বাড়ি মুহূর্তের মধ্যে নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। কোন রকমে প্রাণ বাঁচিয়েছেন অনেকেই। এ ব্যাপারে কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, গত ২০-২৫ বছর পূর্বে মুল নদীর স্রোত ছিল এই এলাকায়। গ্রামগুলোর উজানে নদী শাসনের ব্যবস্থা নেয়ায় এখানে হঠাৎ করে ভাঙন শুরু হয়েছে। আমরা বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। দ্রুতই ব্যবস্থা নেয়া হবে।

গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ থেকে মোশাররফ হোসেন বুলু জানান, গাইবান্ধায় গত দুই দিন থেকে তিস্তা নদী ও ব্রহ্ম নদের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। নদীর কানায় কানায় পানি বিরাজ করছে। যে কোনো সময় বন্যায় রুপ নিতে পারে। জেলার সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার চরাঞ্চলগুলোতে বন্যার পানি উঠে ফসল ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বর্তমানে লালমনিরহাট জেলা ও রংপুর জেলার কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এই পানি ভাটির দিকে প্রবাহিত হলেই গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার চরাঞ্চল বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এদিকে নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে বিভিন্ন এলাকায় ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। একারণে নদীপারের মানুষজন দিশেহারা হয়ে পড়েছে। ভাঙ্গন কবলিত এলাকাগুলো হচ্ছে সুন্দরগঞ্জের পাড়াসাদুয়া, পোড়ারচর, ফুলছড়ির গাবরীরচর। গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরগঞ্জ, গাইবান্ধা, ফুলছড়ি ও সাঘাটা পয়েন্টে নদ-নদীর পানি স্বাভাবিক রয়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বন্যা

১৫ অক্টোবর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ