Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ছাগলের মৃত্যুতে ৫৭ ধারা

| প্রকাশের সময় : ২ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

স্টালিন সরকার : একটি ছাগলের মৃত্যুর খবর ফেসবুকে শেয়ার করায় এক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার মামলা হয়েছে। আব্দুল লতিফ মোড়ল নামের ওই সাংবাদিক খুলনার স্থানীয় দৈনিক প্রবাহের ডুমুরিয়া উপজেলা প্রতিনিধি। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠিয়ে দিয়েছে। ঘটনার বিবরণে জানা যায়, গত ২৯ জুলাই মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ তাঁর নিজ এলাকা ডুমুরিয়ায় কয়েকজন দুস্থের মাঝে হাঁস, মুরগি ও ছাগল বিতরণ করেন। প্রতিমন্ত্রীর কাছ থেকে পাওয়া জুলফিকার আলীর ছাগল ওই রাতেই মারা যায়। এ খবর স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশ হলে লতিফ মোড়ল ফেসবুকে শেয়ার করলে তার বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা হয়। সে মামলা আবার করেছেন সুব্রত নামের একজন। ছাগল মরার ওই খবরে প্রতিমন্ত্রীর সন্মান ক্ষুন্ন হয়েছে; অথচ মামলা করেছে সুব্রত।
ডুমুরিয়া থানার ওসি সুকুমার বিশ্বাস বলেছেন, বাদী মামলার সঙ্গে যে নথি জমা দিয়েছেন তাতে অপরাধের আলামত রয়েছে। এ ঘটনার কয়েক দিন আগে ভাবমূর্তি ক্ষুন্নের অভিযোগ তুলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ফাহমিদুল হকের বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা করেন তারই সহকর্মী অধ্যাপক আবুল মনসুর আহাম্মদ। শাহবাগ থানায় দায়ের করা ওই মামলার বাদীর অভিযোগ অধ্যাপক ড. ফাহমিদুল হক ফেসবুক আইডিতে আমাকে উদ্দেশ্য করে লেখেন আমার কারণে নাকি মাস্টার্স পরীক্ষার ফলাফল দীর্ঘসূত্রতায় পড়েছে। এতে আমার সন্মান ক্ষুন্ন হয়েছে; অতএব ৫৭ ধরায় মামলা।
তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার অপব্যবহার প্রণিধানযোগ্য। প্রথমত প্রতিমন্ত্রীর দেয়া ছাগল মরার খবর ফেসবুকে শেয়ার করায় প্রতিমন্ত্রীর সন্মান ক্ষুন্ন হয়েছে। তিনি মামলা না করে মামলা করিয়েছেন আরেকজনকে দিয়ে। আবার পরীক্ষার রেজাল্ট সময় মতো প্রকাশ করতে না পারার তথ্য প্রকাশ করায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক সহকর্মী আরেক অধ্যাপকের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। ছোট্ট দু’টি ঘটনায় বোঝা যায় তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা রুপ কত ভয়ঙ্কর। খুলনার মফস্বলের সাংবাদিক আব্দুল লতিফ মোড়লের ভাগ্য ভাল ছাগল মরেছে। প্রতিমন্ত্রী গরু বিতরণ করলে সে গরু যদি মারা যেত আর সেই খবর যদি ফেসবুকে শেয়ার করতেন তাহলে সাংবাদিক লতিফের বিরুদ্ধে কতজন মামলা করতেন কে জানে! কারণ ছাগলের চেয়ে গরুর মূল্য কয়েকগুন বেশি। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে পণ্য বা প্রাণীর মূল্যের ওপর তো ‘মান’ নির্ভর করে। আবার রেজাল্ট দিতে বিলম্ব ইস্যুতে এক অধ্যাপক আরেক অধ্যাপকের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। মূলত ৫৭ ধারা শুধু মিডিয়া কর্মীদের মধ্যেই শুধু নয়; সর্বত্র ভীতি-আতঙ্ক-উদ্বেগ ছড়াচ্ছে। কারো দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে রিপোর্ট লিখলে এখন মানহানির অভিযোগে সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়। সাংবাদিক পুরস্কারের বদলে তিরস্কৃত হন। নিম্নমানের পণ্য এবং ভেজাল পণ্যের গুনগত মান নিয়ে প্রশ্ন তুললে ৫৭ ধারায় মামলা দায়ের করা হয়। ইনকিলাবসহ বেশ কয়েকটি পত্রিকার সম্পাদক-প্রকাশক ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা হয়েছে। মামলা দায়ের হলে ভুক্তোভোগীকে কি যাতনায় পড়তে হয় তা ভুক্তোভোগীরাই বোঝেন। খবরে প্রকাশ ২০১৬ সালে এই ধারায় মোট মামলা হয়েছে ৩৬টি। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত এই সংখ্যা ২৬। এর আগে ২০১৫ সালে এই আইনে ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটির ৯ সদস্য এবং তাঁদের সঙ্গে আরও ৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছে। ৫৭ ধারা কার্যত সংবাদপ্রত্রসহ মিডিয়া শিল্পে ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি করেছে।
তথ্য প্রযুক্তি আইন-২০১৩-এর ৫৭ ধারা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন চলছে। সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের স্বার্থ রক্ষাকারী সংগঠনগুলো এ ধারা বাতিলের দাবিতে একের পর এক কর্মসূচি পালন করছেন। টিভি খবরে দেখলাম গতকালও টেলিভিশন মালিকদের সংগঠন অ্যাটকো এবং সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন নিউজ পেপার ওনারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব) সদস্যরা তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে অন্যান্য দাবির সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বাতিলের দাবি করেছেন। দেশের বুদ্ধিজীবী, মানবাধিকারকর্মী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সম্পাদক পরিষদ এই ধারা বাতিলের দাবিতে সোচ্চার। এরই মধ্যে এ আইন বাতিলের নির্দেশনা চেয়ে উচ্চ আদালতে রিট মামলা বিচারাধীন।
সংবিধানের ৩৯ (২)-এর ‘ক’ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার’-এর কথা। অথচ তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় নাগরিককে সুরক্ষা দেওয়ার বিপরীতে হয়রানির সুযোগ রাখা হয়েছে। সংবিধান রাষ্ট্রের ‘নাগরিক’কে কথা বলার ‘সুযোগ’ দিলেও তথপপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা কথা বলার অধিকার ‘হরণ’ করেছে। ৫৭ ধারার আইনে মামলা দায়ের হলে সেটি ‘আমল ও অজামিনযোগ্য’। এতে করে রাজনৈতিক হিংসা প্রতিহিসায় ধারাটি যত্রতত্র ব্যবহৃত হচ্ছে। তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার ভয়ংকর ৭টি শব্দবন্ধ যুক্ত করা হয়েছে। সেগুলো হলো: মিথ্যা ও অশ্লীল, নীতিভ্রষ্টতা, মানহানি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি। যেকোনো নিরীহ কথাকেই এসব বিমূর্ত অভিযোগের ফাঁকে ফেলা সম্ভব। সবচেয়ে মারাত্মক ব্যাপার হলো এই ৭টি অপরাধ আদৌ করা হয়েছে কি না, আইনে তা নির্ধারণের ভার দেওয়া হয়েছে পুলিশের ওপর। পুলিশই অভিযোগ শুনে মামলা নিয়ে গ্রেফতারী পরোয়ানা পাঠাতে পাঠাচ্ছে। অথচ এই অপরাধ হয়েছে কিনা তা নিরুপন করতে ব্যাক্তির সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ, ভাষাবিদ, জনপ্রশাসনবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, ধর্মবিশারদ এবং অপরাধ বিশেষজ্ঞ হওয়া বাঞ্ছনীয়। সেটা কি আমাদের পুলিশ বাহিনীর পক্ষে সম্ভব? যার কারণে ফেসবুকে ছাগল মারা যওয়ার খবরে শেয়ার দেয়াকে ডুমুরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বাদীর অভিযোগে ‘অপরাধের আলামত’ রয়েছে মনে করছেন। ছাগল নিরীহ প্রাণী। ছাগলকে হৃদয় দিয়ে ভালবাসের এমন লোক খুবই কম। কিন্তু কুকুরকে ভালবাসেন এমন লোকের সংখ্যা ঢাকা শহর হাজার হাজার। ঢাকার অভিজাত এলাকাগুলোয় বসবাসরত সম্পদশালীরা দেশি-বিদেশী কুকুর প্রতিপালন করেন। প্রতিদিন তারা কুকুরের খাওয়ার পিছনে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন। কয়েক বছর আগে এক সাবেক প্রেসিডেন্টের পোষা কুকুর গাড়ীর নীচে পড়ে আহত হলে চিকিৎসার জন্য নামকরা এক হাসপাতালে নেয়া হয়। দূভ্যার্গজনক হলো আহত কুকুরটিকে বাঁচানো যায়নি। ওই কুকুরের মৃত্যু শোকে সাবেক প্রেসিডেন্ট সবার সামনে হাউমাউ করে কেঁদেছেন। কুকুরের শোকে খাওয়া দাওয়া পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছিলেন। প্রশ্ন হলো ছাগল মারা যাওয়া খবরে মান-সন্মানের এই অবস্থা; কুকুর মরার খবর কেউ ফেসবুকে শেয়ার করলে সংক্ষুব্ধ ব্যাক্তি কি করবেন? প্রশ্ন হলো তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার যাঁতাকল থেকে মুক্তি কখন মিলবে?



 

Show all comments
  • মিজান ২ আগস্ট, ২০১৭, ১:০৪ পিএম says : 0
    এগুলো সরকারের কর্তাব্যক্তিরা দেখেন না ?
    Total Reply(0) Reply
  • শিপন ২ আগস্ট, ২০১৭, ১:০৭ পিএম says : 0
    সংবিধানের ৩৯ (২)-এর ‘ক’ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার’-এর কথা। অথচ তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় নাগরিককে সুরক্ষা দেওয়ার বিপরীতে হয়রানির সুযোগ রাখা হয়েছে। .... এখন প্রশ্ন হলো: ২টা কী এক সাথে থাকতে পারে ?
    Total Reply(0) Reply
  • কাসেম ২ আগস্ট, ২০১৭, ১:০৯ পিএম says : 0
    আমি বুঝি না আর কত মানুষ হয়রানির শিকার হলে তারপর ৫৭ ধারাটি বাতিল করা হবে ?
    Total Reply(0) Reply
  • বাবুল ২ আগস্ট, ২০১৭, ১:১০ পিএম says : 0
    লেখাটির জন্য লেখক এবং দৈনিক ইনকিলাবকে ধন্যবাদ।
    Total Reply(0) Reply
  • তানিয়া ২ আগস্ট, ২০১৭, ১:৩৩ পিএম says : 0
    ৫৭ ধারা বাতিলের চেয়ে অপপ্রয়োগ ঠেকানো জরুরি
    Total Reply(0) Reply
  • সানজিদা ২ আগস্ট, ২০১৭, ১:৩৯ পিএম says : 0
    এভাবে আর কত মানুষকে যে ভোগান্তির শিকার হতে হবে তা আল্লাহই ভালো জানে
    Total Reply(0) Reply
  • lokman ২ আগস্ট, ২০১৭, ২:১০ পিএম says : 0
    Plz stop this .............
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ৫৭ ধারা

৩০ জানুয়ারি, ২০১৮
৩ আগস্ট, ২০১৭
২৬ জুলাই, ২০১৭

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ