Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রুমাল

শান্তা ফারজানা | প্রকাশের সময় : ২২ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মাছটা তখনও জীবিত ছিল। লেজটা নাড়ছিল। ডানে বামে। কখনো কখনো ডাবল পলিথিনের ভেতরে থেকেও মাথা ঝাকাচ্ছিল। সিলভার কার্প মাছ। এতক্ষণ খেয়াল করতে পারেনি অনুপ। এবার একটু আড়চোখে তাকালো মহিলাটার দিকে। বেশ আধুনিক। কালোর সাথে ছাই রঙের স্কার্ফ মাথায়, পায়ে গোল্ডেন কারুকার্যের স্যান্ডেল। একটা পুতির হ্যান্ড পার্স কোলের উপর রাখা। বেশভূষার সাথে হাতের পলির মাছটা কেমন যেন বেমানান। বাসাবোর জ্যাম ঠেলে ওভারব্রিজ পার হয়ে বেশ দ্রুতই ছুটছিল যানটা। কিন্তু ফকিরাপুলের এই অস্বস্থিকর জ্যামে আটকে গেল আবার। বেশ ভালোই জ্যাম। এরই মধ্যে হঠাৎ মাছের লেজে চোখ পড়লো। তারপর চোখ পড়লো সেই মাছের মালিকের দিকে। দু’একবার অবশ্য চোখাচোখিও হয়ে গিয়েছিল। অনুপ আবারো তাকায় স্যান্ডেলের দিকে। খুব নামকরা এক জুতার দোকান  থেকে মৌমিকে ঠিক এমনই এক জোড়া জুতা কিনে দিয়েছিল সে। মেয়েটার জামা জুতা গহনা ব্যাগ কোন কিছুর প্রতিই তেমন কোন আকর্ষণ ছিল না। অনুপই কিনে দিতো, তবে মৌমির এই ছিল সমস্যা। খালি জুতা ছিঁড়ে যেত। ভালো একজোড়া জুতা ওর পায়ে কখনোই ১ মাসের বেশি টিকত না। আসলে অনেক হাঁটত মেয়েটা। দুই টাকা বাঁচানোর জন্য অনেক শ্রম দিতো। মৌমির কথা মনে হতেই খারাপ হয়ে গেল মনটা। মেয়েটাকে আজ চারদিন হলো পাওয়া যাচ্ছে না।
আরে ফারুক সাহেব, কী অবস্থা?
কী অবস্থা? এখনতো আপনাদের পোয়াবারো?।
কী বা এমন দেখলেন ভাই? সবসময় শুধু খরা থাকে বাণিজ্যের ময়দান। দুই একবার বৃষ্টি হলেই যে বন্যা হবে এমনটা ভাবেন কেন?
আরে রাখেন তো ভাই। হিংসে করে নয় খুশি হয়েই বলছি। যেভাবে দে দেনা দেন অর্ডার পাচ্ছেন দেখে মনে হচ্ছে ‘খুল্ যা সিম সিম’ টাইপস কোন মন্ত্র পেয়েছেন। হা হা হা।
ফারুক সাহেবের হাসির দিকে তাকিয়ে থাকে অনুপম। কথাটা আসলে ভুল বলেননি। আজ প্রায় মাস খনেক; ভাগ্য যেন দু’হাত ভরে দিচ্ছে তাকে। অর্ডারের পর অর্ডার আসছে। শুধু তাই নয় ফরেইন অর্ডার বিশেষ করে মালয়েশিয়া আর দুবাইয়ের ডিলারই লক্ষ লক্ষ টাকার। তবে গার্মেন্টস ব্যবসায় এমনই। প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজার। তার মতো ছোট খাট ব্যবসায়ী এভাবে টিকে যাবে সেটা অনেকটা ভাগ্যেরই ব্যাপার।
নিন অনুপ সাহেব, শুরু করুন।
সামনে রাখা বাটিটার দিকে তাকিয়ে থাকে অনুপ। সেখানে একটা আস্ত কোয়েল রকমারি মসলায় রান্না হয়েছে। ছোট পাখিটার জন্য মায়া লাগে অনুপের। হঠাৎ মনে পড়ে মৌমির কথা। সেবার রেল গেইটের মোড়ের বাজারে হাঁস মুরগির ডিমের পাশাপাশি যখন ছোট ছোট কোয়েল বিক্রি করছিল লোকটা। হঠাৎ রেগে উঠে মৌমি। সব কিছুই খেতে হবে নাকি? ডিমগুলো ফুটে সুন্দর বাচ্চা হতো। পাখিগুলো ডানা মেলে খেলা করতো। অথচ. . .একটু মায়াও হলো না।
আরো অনেক কথা বলে লোকটাকে ঝেড়েছিল মৌমি। সেদিন ডিম দেখেই এত্ত ক্ষেপেছিল যদি সদ্য কোয়েল দেখতো এভাবে রান্না করা তাহলে না জানি কী বলত? আসলে মানুষ যে কীভাবে এদের জবাই করে।
ঐ মামা, এদিকে আস তো?
হোটেলের কিশোর ছেলেটা এগিয়ে আসে। শুন, এই কোয়েলটা নিয়ে যাও। আমাকে বরং মরিচ পেয়াজ দিয়ে একটি ডিম ভেজে দাও।
আরে অনুপ সাহেব, খান না। এত টাকা আয় করছেন ১৫০ টাকার একটি কোয়েল খেলে আপনার টাকা ফুরোবে না। খুব সুস্বাদু হয়েছে রান্নাটা। কুড়কুড় করে কোয়েলের হাড় চিবুতে চিবুতে বলে উঠে ফারুক সাহেব।
হোটেল থেকে বেরিয়ে কারখানার দিকে যায়, অনুপ। সবাই কাজ করছে। কর্মীরা হাপিয়ে যাচ্ছে। পরশুর মধ্যেই ডেলিভারী পাঠাতে হবে গেঞ্জিগুলি। দশ হাজার গেঞ্জি। স্ত্রিন প্রিন্টের ওয়ার্ডার এসেছে। ডিজাইন কোম্পানি দিয়েছে। তারা শুধু প্রিন্ট করছে, ছাপা মারছে, ইস্ত্রী করে প্যাকেট করছে ব্যস। তবে অনেক ছোট। এতটুকু রুমে দুটো ফ্যান আরো একটা টেবিল ফ্যানের ব্যবস্থা করেছে অনুপ। তবুও সবাই ঘেমে নেয়ে অস্থির। অনুপও হাত লাগায়, নিজেরই তো কাজ। অর্ডারটা দিয়েছে একজন মোবাইল কোম্পানি। তাদের একটা প্রোগ্রাম নাকি আছে। এ সমস্ত অর্ডার সাধারণ পত্রিকায় সার্কুলার দিয়ে করে তারা। তবে ভাগ্যের জোরে অনুপ পেয়ে যায়। এরা হঠাৎই নাকি টি-শার্ট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আর তাদের হাতে সময় ছিল কম। আশপাশে বড় বড় হোসিয়ারিরা ব্যস্ত ছিল তাই অর্ডারটা ছোট ব্যবসায়ী অনুপের হাতেই আসে। এমন কাকতালীয় ঘটনা এই প্রথম নয়, পুরোমাস জুড়েই হচ্ছে। আর অনুপ কোন অর্ডারকেই না করছে না। হাতের লক্ষ্মী দূরে ঠেলে কী লাভ? সে নিজেও দিন রাত মেহনত করছে। কারখানাতে কাজ বেশ গুছিয়ে এসেছে। এই মজনু, যা ফ্ল্যাক্সটা ভরে চা আর সিঙ্গারা নিয়া আয়। বিকেল গড়িয়ে কখন যে, সন্ধ্যা চলে এসেছে টেরই পায়নি। কাজের মধ্যে থাকলে যা হয় আর কি। সবাই একটু বিশ্রাম করুক। হাত মুখ ধুয়ে সে নিজেও বসে চেয়ারটাতে। রুমালটা বের করে মুখ মোছার জন্য। সাদা রুমালে নীল সুতায় সুন্দর করে লেখা ‘ভুলো না আমায়’ আর লেখার নিচে লাল সুতায় দুটো গোলাপ বোনা। মৌমি সেলাইয়ের কাজে অনেক পারদর্শী। যদিও আজকালকার যুগে মেয়েরা এসব কাজকে সেকেলে মনে করে কিন্তু মৌমি এগুলো খুব শখ করে তৈরি করে। তথাপি সে ওয়াল ম্যাট তৈরি করে তা মার্কেটে সেল দেয়। ভালো আয় হয় তার। নিজের যাবতীয় খরচের ব্যবস্থা হয়ে যায়। মৌমি প্রায়ই দুঃখ করে বলতো সে লেখাপড়া শিখতে চায়! নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়। অনুপও তাই চায়। তিন বছরের সম্পর্ক তাদের। মেয়েটার মধ্যে কোনদিন কোন চাহিদা দেখেনি সে। তবে খুব প্রত্যয়ী ছিল সে। সেলাই করে করে টাকা জমানো মুখের কথা নয়। অনুপের আজকের এই কারখানার পেছনে মৌমির অবদান অনেক। মাস্টার্স শেষ করে যখন চাকরির জন্য ঘুরছিল এখানে সেখানে তখন মৌমিই তাকে সাহস দিয়েছিল, প্রেরণা যুগিয়েছিল। মেয়েটার তার জমানো টাকা তুলে দিয়েছিল অনুপের হাতে। ঐ টাকা কয়টা তো ছিল কাগজের নোট মাত্র। আসল মূলধনটা ছিল সাহস-মনোবল। এটা না হলে এই পর্যন্ত পৌঁছাতে পারত না অনুপ। এই বছরেই বিয়ে করে নিবে। এমনই ভাবনা ছিল দুজনের। আরো আগেই পারতো হলো না, শুধু ব্যবসায়ের নড়বড়ে অবস্থার কারনে। ভাগ্য তো ফিরল এই মাসখানেক।

ক্রিং ক্রিং ক্রিং
মোবাইল বেজে ওঠে। ধরতে না ধরতেই বন্ধ হয়ে যায়। তারপর আবারও বেজে ওঠে।
হ্যালো. . ,
ওপাশ থেকে মিষ্টি কণ্ঠ হঠাৎ ঝাকুনি দিয়ে উঠে এপাশের অনুপকে।
গলা ঝাকুনি দিয়ে বলে উঠে সে।
কে বলছেন?
হুম্ম্। অনুপ ... কেন আমাকে চিনতে পারছো না? কাল রাতেই না কত কথা হলো।
রিনিতা? হঠাৎ তার মনে পড়ে আজ সপ্তাহ্ দুয়েক হলো দিন নাই রাত নাই মেয়েটা তাকে ফোন করছে। মাঝে মাঝে তো ঘুমাতেও দেয় না। কণ্ঠে কী এক জাদু আছে যে কথা বলতে অন্য রকম ভালো লাগে।
শুনছেন?
কথার স্রোতে ভেসে বেড়ায় অনুপ। কণ্ঠটা রিনঝিন চুড়ির আওয়াজের মতো কানে লাগে অনুপের। সে ফিরে আসে কল্পনার জগৎ থেকে।
শুনছি। তারপর এদের কথা চলে প্রায় ঘণ্টাখানেক। এর মধ্যে তাদের প্রায় দুবার দেখাও হয়েছে। পাশেরই রেস্টুরেন্ট। মেয়েটা দেখতে সুন্দর। কোমড় ছড়ানো কোঁকড়ানো চুল। ছড়ানো চোখের পাতা আর বাদামী উজ্জ্বল চোখের মণি। লম্বাটে আঙ্গুল আর গোলাপী নখ। মার্জিত চেহারা। স্মার্ট বেশভূষা। মেয়েটা শিক্ষিতাও। ভালো লাগে অনুপের। মেয়েটার চলাফেরা কথাবর্তায় আধুনিকতার ছাপ। এত ব্যস্ততার মাঝেও না বলতে পারে না তাই।

রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবে অনুপ। কোথায় গেল মৌমি? সপ্তাহ খানেক আগে সে ফোন করেছিল। ব্যস্ত আছে বলে কেটে দিয়েছিল ফোনটা। রাগ করেছে নাকি? ভাবতে ভাবতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। আসলে ব্যস্তই তো ছিল। মাথার উপরেই ফ্যান ফুল স্পিডে ঘুরছে। তবুও ঘামছে সে। রুমালটা বের করে মুখটা মুছে নেয়। এই রুমালটা অনেক লাকি তার জন্য। যেদিন থেকে ভালোবাসা নিয়ে রুমালটা তাকে দিয়েছিল মৌমি তখন থেকেই তার ভাগ্যের জোয়ার শুরু হয়। কিন্তু আজ সপ্তাহ হয়ে গেল মৌমির কোন খোঁজ নেই। মেয়েটার সাথে চরম অবমাননা করা হয়েছে আসলে। সারা রাত ঘুম হলো না অনুপের। নাভানা চড়ে বাসাবোর দিকে যাচ্ছে অনুপ। মাদারটেক চৌরাস্তার দিকের গলির একটা বাড়ির আগের বাড়িটা মৌমিদের। মেয়েটার ফোন বন্ধ। কোন খোঁজ-খবর নেই। বৃষ্টি পড়ছে, বাতাস চারদিকে। খিলগাঁও ফ্লাইওভারে উঠেছে নাভানাটা। ক্রিং ক্রিং। কেটে দেয় ফোনটা। রিনিতার ফোন। মেয়েটা বার বার বিরক্ত করেই চলেছে। রুমালটা বের করে সে। সুন্দর করে লেখা ‘ভুলনা আমায়’। উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকে জানালায়। হঠাৎই ব্রেক ধরে ড্রাইভার। ওভারটেক করতে গেলে যা হয়। হুমড়ি খেয়ে পড়ে গাড়ির যাত্রীরা। অনুপ কিছু বুঝে উঠার আগেই হাত থেকে পড়ে যায় রুমালটা। জানালার বাইরে। উড়তে উড়তে হারিয়ে যায়। আবারো বেজে উঠে রিংটোন। রিনিতা নয়। বিদেশি নম্বর। দুবাইয়ের ডিলাদের কাছে মাল পৌঁছাতে দেরি হয়েছে। তাই লটটা আবার ফেরত আসছে অনুপের ঠিকানায়। হাফ পেমেন্টটা দাবি করছে তারা। মাথায় ভেঙ্গে পড়া আকাশ নিয়েই ছুটে যায় মৌমিদের বাড়িতে। সেখানে গিয়ে পায় মৌমির মৃত্যু সংবাদ। মাওলানার দ্বিতীয় স্ত্রী হতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল মেয়েটা। তাই তার ক্রুদ্ধ পিতা তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। মাদারটেকের গলিতেই বসে পড়ে অনুপ। মনে হতে থাকে কে যেন চুপি চুপি বলছে, ভুল না আমায় ...।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন