বিএনপির মানববন্ধন আজ, পাল্টা কর্মসূচি আওয়ামী লীগ
সারা দেশের মহানগর ও জেলা পর্যায়ে আজ মানববন্ধন করবে বিএনপি ও তার মিত্ররা। আর এ
আলম শামস : অনিকা ত্রিপুরা (৯) বেলছড়িপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণির ছাত্রী। আগে নিয়মিত স্কুলে যেত না। এখন বছরের প্রথমদিন বিনামূল্যে নতুন বই পাচ্ছে, উপবৃত্তি পাচ্ছে। স্কুলকে সুন্দর করা হয়েছে, স্যার ও ম্যাডামদের পড়ানোও খুব ভালো লাগে। নিজের মায়ের ভাষায় পড়বে বই পেয়ে সে খুব খুশি। আবার প্রতিদিন মিড ডে মিল বা দুপুরের খাবার পাচ্ছে। পাহাড়ি জনপদের অনেক শিশুই এখন অনিকা ত্রিপুরার মত খুশি এখন প্রতিদিন দল বেঁধে শিশুরা স্কুলে যায়।
যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, স্কুলের অবকাঠামো উন্নয়ন, বিনামূল্যে বই প্রদান, উপবৃত্তি প্রদান, বিদ্যালয়ভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা, আর্কষণীয় পাঠদান, মিড ডে মিল, শিক্ষকদের আন্তরিক নিবিড় তত্ত¡াবধানে পাহাড়ি জনপদের শিশুরা বিদ্যালয়মুখী হচ্ছে।
পাহাড়ি এলাকাতে শিক্ষার হার বাড়ছে। বিশেষ করে শিশু শিক্ষার হার উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। ২০১৫ সালে রামগড়ে জরিপকৃত শিশুর সংখ্যা ছিল ৯৪৪৩। ভর্তিকৃত শিশুর সংখ্যা ছিল ৯,৪০৮। ২০১৬ সালে জরিপকৃত শিশুর সংখ্যা ৯,৪৬৯। ভর্তিকৃত শিশুর সংখ্যা ৯,৪৩০। ২০১৭ সালে জরিপকৃত শিশুর সংখ্যা ১০,০২৭। ভর্তিকৃত শিশুর সংখ্যা ১০,০০৫। প্রতিবছর গুটিকয়েক শিশু প্রতিবন্ধিতার কারণে ভর্তি হয়নি। নানান সুযোগ-সুবিধা থাকায় শিশুরা নিয়মিত স্বেচ্ছায় বিদ্যালয়ে আসছে। বর্তমান সরকারের এসব বিদ্যালয়ভিত্তিক পরিকল্পনার কারণে স্কুলে শিশুর সংখ্যা বাড়ছে। ভর্তি বহির্ভূত শিশু সংখ্যা প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে আসছে। পাশাপাশি ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর হার কমছে।
মাত্র কয়েক বছর আগেও পাহাড়ি জনপদে যে ছেলেমেয়েরা স্কুলের পরিবর্তে সময় কাটাতো বনে-বাদাড়ে, মাঠে-ঘাটে, গো-চারণে, পাহাড়ি দুর্গম জঙ্গলে, কিংবা মা-বাবার কাজে সহযোগিতা করে, আজ তারাই বিদ্যাপীঠে। সমতল ভূমির পাশাপাশি পাহাড়ি জনপদে প্রাথমিক শিক্ষায় যে বড়ো ধরনের পরিবর্তন এসেছে এটা তারই দৃষ্টান্ত।
চারদিকে উঁচু-নিচু ছোটো-বড়ো পাহাড়, পাহাড়ের গায়ে গড়ে ওঠা বন জঙ্গলই এসব এলাকায় বসবাসকারী উপজাতিদের জীবন-জীবিকা। এসব পাহাড়ি জনপদে শিক্ষার হার অনেক কম ছিল। স্কুলগামী শিক্ষার্থীর চেয়ে ঝরে পড়ার হারই ছিল বেশি। এর প্রধান কারণ ছিল বিদ্যালয় সংকট, শিক্ষক সংকট, অনুন্নত রাস্তাঘাট, দারিদ্র্য, কুসংস্কার, অবহেলা-অসচেতনতা, সর্বোপরি শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশের অভাব। সংগত কারণেই প্রত্যন্ত এলাকার বসবাসকারীদের স্বপ্নের মধ্যেও ছিল না তার ছেলেমেয়ে স্কুলে পড়বে, শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে দেশ সেবায় নিয়োজিত হবে।
এই অবস্থায় এসব এলাকায় শিক্ষার হার বাড়াকে অসম্ভব বলেই ধরে নিয়েছিল এখানকার মানুষ। কিন্তু শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে পাহাড়ি জনপদের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণের এই অসম্ভব কাজটিকে সম্ভব করতে সক্ষম হয়েছে বর্তমান সরকার। মাত্র এক দশক আগেও এ জনপদে যেখানে স্কুলগামী ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল মাত্র হাতেগোনা কয়েকজন, সেখানে এখন তা বেড়ে প্রায় শতভাগে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে একসাথে এত বিদ্যালয় কোনো সরকার জাতীয়করণ করেনি। শুধু তাই নয়, জাতীয়করণকৃত ও রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শতভাগ ছাত্রছাত্রীকে দেওয়া হচ্ছে উপবৃত্তি। বছরের প্রথম দিনেই তাদের হাতে দেওয়া হয় নতুন বই। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার জন্য আলাদা কক্ষ, আলাদা শিক্ষক, শিশুতোষ শিক্ষা উপকরণ দেওয়া হয় প্রতিবছর। প্রতিটি বিদ্যালয়কে দৃষ্টিনন্দন করে রাখার জন্য প্রত্যেক বছরই ৪০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়, যার মাধ্যমে বিদ্যালয় রঙ করা, ফুল বাগান সৃষ্টি, শহিদ মিনার তৈরি ও পরিচর্যা করা হয়। প্রতি ৩ বছরে প্রত্যেক বিদ্যালয় মেরামতের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় ৫০ হাজার থেকে দেড় লক্ষ টাকা। প্রত্যেক বিদ্যালয়েই সরকার নিয়োগ দিয়েছেন একজন নৈশপ্রহরী। শিক্ষা অফিসে দেওয়া হয়েছে কয়েকটি মোটরসাইকেল।
পাহাড়ি জনপদে বেশ কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেগেছে বাহারি রং-এর ছোঁয়া। পুরো বিদ্যালয়ে ভেতর বাইরে দেয়ালে বিভিন্ন রঙ করা হয়েছে। এর ওপর আঁকা হয়েছে আল্পনা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ জ্ঞানী ব্যক্তিদের বাণী। স্কুলের সামনে রয়েছে মনোরম ফুলের বাগান ও একটি শহিদ মিনার।
এখন বিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য ছেলেমেয়েরা উদগ্রীব থাকে। অভিভাবকের আগেই ছেলেমেয়েরা স্কুলে আসার জন্য তৈরি হয়ে যায়। এর কারণ হিসেবে তারা জানান, বিদ্যালয়ে রয়েছে তাদের নানান খেলার সামগ্রী। খেলার ছলে তাদের শেখানো হয় লেখাপড়া। শেখানো হয় গান। তারা বলেন, স্কুলগুলোর চেহারা নান্দনিক হয়ে উঠেছে। এখন বিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকালেই মন ভরে যায়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যেভাবে শিক্ষাঙ্গনকে আলোর দিকে নিয়ে এসেছেন তা অতীতের ইতিহাসকে হার মানিয়েছে।
রামগড় উপজেলায় বিদ্যালয় সংখ্যা ৬১, শিক্ষক সংখ্যা ৩২০, শূন্যপদ ৪৬। বিনামূল্যে বই প্রদান, উপবৃত্তি প্রদান, বিদ্যালয়ভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, শিক্ষকদের নানামুখী প্রশিক্ষণ প্রদানসহ নানা কার্যক্রম গ্রহণ করায় দিন দিন শিশুভর্তি ও ঝরে পড়া পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। সবচেয়ে দুর্গম বিদ্যালয়গুলোতে ফিডিংসহ শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসন ব্যবস্থা, উপবৃত্তির পাশাপাশি বা বিকল্প হিসেবে মিড ডে মিল চালু, নিবিড় তত্ত¡াবধান, শিক্ষকপদ বৃদ্ধিসহ পদগুলো অপেক্ষাকৃত মেধাবীদের দিয়ে পূরণ এবং সবক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা পুরোপুরি নিশ্চিত করা গেলে প্রাথমিক শিক্ষার সার্বিক অবস্থার আরো উন্নতি সম্ভব।
পাহাড়ি জনপদের কোনো কোনো এলাকায় অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, বাসস্থান থেকে বিদ্যালয়ের অধিক দূরত্ব, বিদ্যালয়ে শিক্ষক স্বল্পতা, ঢিলেঢালা পাঠদান, দারিদ্র্য, অভিভাবকদের অসচেতনতা, কুসংস্কার ইত্যাদি সমস্যা এখনো বিদ্যমান। এসব সমস্যা সমাধান হলে পাহাড়ি জনপদে শিক্ষার হার শতভাগে পৌঁছাতে বেশি সময় লাগবে না।
পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা ঘুরে প্রায় একই চিত্র দেখা যায়। পাহাড়ি জনপদে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক মাতৃভাষায় পাঠ্যবই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিলেও অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই নেই ঐ ভাষার শিক্ষক। আবার অনেক বিদ্যালয়ে শিক্ষক থাকলেও নেই ওই ভাষায় পাঠদানের প্রশিক্ষণ। ফলে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের মাতৃভাষায় পাঠ্যবই পাঠদান কিছুটা হলেও ব্যাহত হচ্ছে। এই সব সমস্যা দূর হলে পাহাড়ি জনপদে শতভাগ শিক্ষার আলো ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়বে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।