Inqilab Logo

শক্রবার ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ কার্তিক ১৪৩১, ০৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দান-খয়রাতে উদার মধ্যবিত্ত

প্রকাশের সময় : ২৩ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১২:০৮ এএম, ২৩ জুন, ২০১৭


চট্টগ্রামে ঈদ-রমজানের সৌন্দর্য : প্রবাসীদের অবদান শীর্ষে
শফিউল আলম : এক. বনেদী পরিবারের দানশীলা ব্যক্তিত্ব জহুরা আখতার চৌধুরানী। ৮২ বছর বয়স। জীবন সায়াহ্নে এসে অসুস্থ শরীর নিয়ে এখনও সমাজের গরিব-দুঃখী মানুষের পাশে থাকাই পছন্দ। অভিজ্ঞতার কথা থেকে বললেন, ‘আমার গরিব পাড়া-পড়শীদের ডেকে-খুঁজে খাওয়ানো-পরানোর মধ্যে পরম তৃপ্তি পেয়েছি। অসুখে-বিসুখে, মেয়ের বিয়েশাদিতে আল্লাহতায়ালা আমাকে যতটুকু সামর্থ্য দিয়েছেন সারাজীবন সাহায্য-সহযোগিতার চেষ্টা করেছি মাত্র। আত্মীয়-স্বজনদের খোঁজ নিয়েছি। তবে বিনিময়ে কোনো কিছুই পাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল না। মানুষের বুকভরা দোয়া পেয়েছি। তাতেই খুশি। শরীরে কুলায় না তবুও আমি গরিব মানুষের সাথে মেলামেশা করে খুব আনন্দ পাই’।    
দুই. মনির হোসেন সপরিবারে ভাড়া বাসায় থাকতেন চট্টগ্রাম নগরীর শোলক বহরে। গত ৩১ মে থেকে এক সপ্তাহের মধ্যে পরপর তিন দফায় অতিবৃষ্টি ও জোয়ারে অনেক এলাকা তলিয়ে যায়। মনিরের নিচতলার বাসা কাঁদা-পানি ও ময়লা হাঁটু সমান। স্ত্রী সন্তানসহ চার সদস্যের পরিবার নিয়ে থাকা দূরে থাক রান্না-বান্না, অজু-গোসল বন্ধ।
মাহে রমজানে দুঃখ-কষ্টের কথা জানতে পেরে মনিরের পুরো পরিবারকে তারই এক সহকর্মী বন্ধু আশরাফুল ইসলাম চকবাজারে নিজের ভাড়া বাসায় নিয়ে আসেন। পানিবদ্ধতা থেকে অন্তত রোজার মাসটিতে একটু স্বস্তিও জায়গা খুঁজে পাওয়া গেল। খুব প্রশান্তির সুরেই মনের কথাগুলো কৃতজ্ঞতার সঙ্গে জানালেন মনির। বললেন, ‘এই শহরে আমার ধনী আত্মীয়-স্বজনও আছেন। কই তারা তো একটিবার ভুলেও দেখতেও যাননি পানিবন্দী হয়ে রোজায় কী দুর্দশায় আমরা ছিলাম! মনির ও আশরাফ দুই জনই মধ্যবিত্ত। আর চট্টগ্রামে এ ধরনের দয়ামায়া ও উদারমনা সংস্কৃতি নতুন কিছু নয়। চাটগাঁবাসীর অতিথিপরায়ণতা দেশে তো বটেই দেশের বাইরেও সুখ্যাতি ছড়িয়ে আছে। তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ‘বাণিজ্যিক রাজধানী’ খ্যাত ‘ধনী’র এই শহরে বিত্তবান ব্যক্তিদের সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে তুলনামূলক অস্বচ্ছল মানুষদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়ার মন-মানসিকতা আগের মতো নেই। যেন দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। যদিও ব্যাতিক্রম আছে। বিশেষত বনেদী ঐতিহ্যবাহী পরিবারের ক্ষেত্রে। সেই তুলনায় বরং মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তরাই একে অপরের সুদিন কী দুর্দিনে ছুটে আসে। গরিব-অভাবী দিনে এনে দিনে খাওয়া কিংবা বিপদগ্রস্ত মানুষের প্রতি সাহায্য-সহযোগিতার হাত দ্রæত প্রসারিত হয় মধ্যবিত্তদের। অগ্নিমূল্যের বাজারে সীমিত আয়ে পরিবার নিয়ে কঠিন জীবন বাস্তবতার মধ্যেই মধ্য ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত অনেকেই গরিবদের দিকে উদার সাহায্যের হাত প্রসারিত করছেন। বিশেষত এবার রমজান ঘূর্ণিঝড়, জোয়ার, অতিবৃষ্টি, পাহাড় ধসের মতো উপর্যুপরি দুর্যোগ কবলিত হওয়ায় অনেকেই খেয়ে না খেয়ে রোজা পালন করছেন। সামনের ঈদ। তাদের চোখের সামনে শুধুই হাহাকার। এহেন অবর্ণনীয় দুঃসহ বিপদ চট্টগ্রামের অধিকাংশ বিত্তবান মানুষের কঠিন হৃদয়কে স্পর্শ করতে পারেনি। বরং মধ্যবিত্তরা যার যা আছে তা নিয়েই বিপদগ্রস্ত রোজাদারদের পাশে দাঁড়াতে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন স্থানে।  
মাহে রমজানের শেষ দিনগুলো এখন যেন দ্রুতই পার হয়ে যাচ্ছে। সমাজের ভাগ্যবঞ্চিতদের দিকে হাত বাড়ানোর এবং হাজার গুণ সওয়াব ও দুস্থ মানবতার বুকভরা দোয়া, ভালোবাসা অর্জনের মহাসুযোগও প্রায় শেষের দিকে। পবিত্র লাইলাতুল কদর সামনে রেখে গতকাল (বৃহস্পতিবার) চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এই মহতি দিবসে দান-খয়রাতে উদারমনা হিসেবে বেশ সক্রিয় ও তৎপর ভূমিকায় অবতীর্ণ দেখা গেছে চট্টগ্রামের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সাধারণ মানুষকে। ‘হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ এই রজনীতে (সুরা ক্বাদর)’ শত টানাপড়েনের মধ্যেও মধ্য ও নিম্ন-মধ্যবিত্তরা যার যার সাধ্যমতো যাকাত, দান-খয়রাত, বিভিন্ন ধরনের খাদ্যসামগ্রী বিতরণ, দরিদ্র ও অস্বচ্ছল আত্মীয়-পরিজনদের পাশে দাঁড়িয়ে ঈদের আনন্দকে ভাগাভাগি করার প্রচেষ্টা চোখে পড়ার মতো।
শবে কদরের মহান দিবসে চাটগাঁর লাখো মধ্যবিত্ত গতকাল আত্মীয়-পরিজন, গরিব স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধবদের ঘরে ঘরে সাহারী ও ইফতার সামগ্রী বিতরণ করতে ছুটেছেন। মসজিদে মসজিদে তাবারুক বিতরণ হয়েছে। মুসল্লিদের মাঝে ইফতার সামগ্রী ও রাতে ইবাদতরতদের কাছে গিয়ে পানি বিতরণ হয়েছে। মহা রজনীর অত্যধিক গুরুত্বের জন্য অনেক পরিবার যাকাতের অর্থ বিলি-বন্টন করেছেন। বলতে গেলে এটাই ফি-বছর চট্টগ্রামে মাহে রমজানের সৌন্দর্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভাব-অনটন, দুর্যোগের কবলে পড়ে রোজার এই শেষ দিকে দান-সদকা, খয়রাত ও সাহায্যের আশায় প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজারো অভাবী মানুষ রোজ ছুটে আসছে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে।    
অতীত-বর্তমানে ফারাক      
কঠিন বাস্তবতা হলো, ব্যতিক্রম দৃষ্টান্তগুলো বাদ দিলে অগণিত ‘ধনী’র এই শহরে বিত্তবানশ্রেণীর এসব ক্ষেত্রে ভূমিকা যেন অতীতের তুলনায় ফিকে হয়ে গেছে। হারাতে বসেছে বিত্তবানদের দান-বদান্যতায় দীর্ঘকালের লালিত ঐতিহ্য তথা চাটগাঁইয়া কালচার। অথচ গত ৩০, ৪০, ৫০, ১০০ বছর পূর্বে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে অনেক জনহিতকর ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে মূলত টাটগাঁর বিত্তবান ব্যক্তিবর্গের আর্থিক সহায়তায়। এরমধ্যে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল, নন্দনকানন মুসাফিরখানা (অধুনালুপ্ত), পাহাড়তলী চক্ষু হাসপাতাল, কদমমোবারক এতিমখানা, আমানত শাহ এতিমখানা, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ডায়াবেটিক হাসপাতালসহ এখানে-সেখানে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান। খোঁজ খবর নিয়ে জানা যায়, হালে চট্টগ্রামের অনেক ধনাঢ্য পরিবার (তবে সবাই নন) বিশেষত ঈদ ‘অবকাশ’ পালন করতে ছুটে যান দুবাই, আমেরিকা, ইউরোপ, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া কিংবা ব্যাংককের আলোচিত পাতায়া বীচের মতো নষ্ট-রাজ্যে। গরিব-দুঃস্থ পাড়া-পড়শী কিংবা আত্মীয়-পরিজনদের দিকে ফিরে তাকানোর সময় তাদের কোথায়!
দানের হাত ‘বড়’     
সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক এম হারুনুর রশীদ বলেন, সামাজিক প্রচলিত কথায়ই আছে, দান-অনুদানের হাত সবসময়ই উপরে এবং ‘বড়’ থাকে। অভাবী, বিপদগ্রস্ত মানুষ অপরের সাহায্য চায়। এটাই স্বাভাবিক। সাহায্যের হাত বাড়ালে মানুষের বড়ত্ব প্রকাশিত হয়। যেহেতু মানুষ আল্লাহর শ্রেষ্ঠ জীব। তাছাড়া দান করার সৌভাগ্যও আল্লাহ তায়ালার দান। এই শিক্ষা মূলত পরিবার থেকেই আসে। অতীতে বড় জনেরা শিশুদের হাত দিয়ে দান-সদকা দিতেন। তবে হালে পরিবারে এসব নিয়ে সুশিক্ষার আওতা সঙ্কুচিত হয়ে গেছে। তিনি জানান, দানের ফলে অর্থ-সম্পদের প্রবাহ ক্রমেই উপরস্তর থেকে নিম্নগামী হয়ে থাকে। গরীব মানুষদের মুখে হাসি ফুটে ওঠে অন্তত রোজার মাসটিতে। তাদের যাপিত জীবনের দুঃখ-ক্লেশ মুছে গিয়ে কিছুটা গতিমান হয়। তাছাড়া ইসলামেই দিক-নির্দেশনা দেয়া হয়েছে যে, ধনীর সম্পদে গরিবের হক রয়েছে। দান মানে দয়া বা করুণা নয়। তবে সামর্থ্য থাকা সত্তে¡ও দানের হাত সঙ্কুচিত করে রাখা ও নিজেরা নিজেদের নিয়েই ভোগ-বিলাসে মত্ত থাকা ব্যক্তি, পরিবারের সংখ্যাও এই চট্টগ্রাম শহরে নেহাত কম নয়!   
প্রবাসীরা এগিয়ে      
প্রধানত সউদী আরবসহ মধ্যপ্রাচ্য এবং বিশ্বের অনেক দেশে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের অন্তত ৫০ থেকে ৬০ লাখ লোক কর্মরত আছেন বিভিন্ন পর্যায়ে। মাহে রমজানে দান-খয়রাত, সদকা বিশেষত যাকাতের একটি বিরাট প্রবাহ আসছে তাদের কাছ থেকে। গত ক’দিনে বেশ কয়েকজন প্রবাসীর সাথে আলাপকালে তারা জানান, সারাবছর কষ্টার্জিত আয়ের বড় অংশ তারা রমজান ও ঈদের সময়ই প্রেরণ করেন। নিজ নিজ এলাকার দরিদ্র জনগোষ্ঠি যাতে রোজা ও ঈদ পালন করতে পারে এরজন্য পরিবারের কাছে বাড়তি অর্থ পাঠান। ব্যাংকারদের সূত্র জানায়, বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহে গত এপ্রিল-মে মাস থেকে চলতি জুন পর্যন্ত অন্যান্য মাসের তুলনায় প্রধানত মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী বাংলাদেশীদের পাঠানো রেমিটেন্সের বিরাট প্রবাহ আসা অব্যাহত আছে। এর উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে প্রবাসী পরিবারগুলোতে রোজা ও ঈদের খরচের অর্থ প্রেরণের পাশাপাশি নিজেদের এলাকায় গরীব-দুঃস্থদের জন্য যাকাত ছাড়াও দান-খয়রাতের বড়সড় বাজেট। ফলে তাদের দান-খয়রাতে অবদান রয়েছে বেশ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চট্টগ্রাম

৩০ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ