ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
মো. তোফাজ্জল বিন আমীন
একটি সমাজ বা রাষ্ট্রে যখন সুশাসন অনুপস্থিত থাকে তখন আর সেখানে মানুষের কল্যাণের কথা কেউ ভাবে না। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পেরিয়ে গেলেও আমরা অর্থবহ স্বাধীনতাকে খুঁজে পাইনি। কেন পাইনি সে ইতিহাস লিখলে সমাপ্তি টানা যাবে না। যে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল সে উদ্দেশ্য আজ সুদূর পরাহত। জাতির অহংকার হিসেবে নতুন প্রজন্মের তরুণদের আখ্যায়িত করা হলেও অধিকাংশ তরুণ আজ বেকারত্বের গøানিতে হাডুবু খাচ্ছে। দিন বদলের শ্লোগান আর ঘরে ঘরে চাকরি দেয়ার প্রতিশ্রæতি বাস্তবায়নের খবর নেই। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যে ক্ষমতাসীনরা যত ফন্দি করে তত ফন্দি যদি রাষ্ট্রের নাগরিকদের কল্যাণের ক্ষেত্রে করতো তাহলে বেকারের সংখ্যা এত বাড়তো না।
সম্প্রতি রাজধানীর আগাওগাঁওয়ে পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ত্রৈমাসিক শ্রম শক্তি জরিপ ২০১৫-১৬ সাংবাদিকদের সামনে উপস্থাপন করেন পরিচালক কবির উদ্দিন আহমেদ। তার ভাষ্যমতে, দেশে মোট বেকারের সংখ্যা মাত্র ২৬ লাখ। যদিও বেসরকারি পরিসংখ্যান বলছে, দেশে মোট বেকারের সংখ্যা ৪ কোটি ৪৬ লাখ। সরকার আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)’র সংজ্ঞা ব্যবহার করে ২৬ লাখের সংখ্যাকে জায়েজ করার চেষ্টা করছে। জনগণের ভোটের অধিকারকে তোয়াক্কা না করেই যারা ক্ষমতায় আসীন হয়েছেন তারা তো টিকে থাকার প্রশ্নে চাতুরিপূর্ণ কৌশল গ্রহণ করবেন এটাই তো স্বাভাবিক! আইএলও বেকারের যে সংজ্ঞা দিয়েছে তা ব্রিটেন, ফ্রান্স ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশগুলোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে। কারণ ওইসব দেশের সরকার বেকারদের জন্য বেকার ভাতার পদ্ধতি চালু রেখেছেন। সে কারণে অনেকে চাকরি পেলেও ইচ্ছা করে বেকার থাকেন। আমাদের দেশে যদি বেকার ভাতার ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয়ভাবে থাকতো তাহলে আইএলওর সংজ্ঞা নিয়ে বির্তকের সৃষ্টি হতো না। এটা সরকারকে অনুধাবন করতে হবে। আর আমাদের মতো অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে আইএলওর সংজ্ঞা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
দেশে বেকার তথা চাকরিহীন মানুষের সংখ্যা নিয়ে বির্তকটা অনেক পুরনো। কিন্তু এবারের বিতর্কটা উসকে দিয়েছে খোদ সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরো বিবিএস, তারা বলেছে দেশে বেকারের সংখ্যা মাত্র ২৬ লাখ। যদিও দেশে বেকারের সংখ্যা ৪ কোটি ৪৬ লাখ। ২০১৩ সালের জরিপেও বেকারের সংখ্যা একই ছিল। দেশের অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের অনেকেই জরিপের এই ফলাফল মেনে নিতে পারেননি। তারা বলছেন, এই জরিপ আসলে জনগণের সাথে ধোঁকার শামিল। শুধু তা-ই নয়, বিবিএস আরো দাবি করেছে, গত দেড় বছরে দেশে নাকি ১৪ লাখ নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে। অর্থাৎ সরকার ১৪ লাখ বেকারের জন্য চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করেছে। বিশিষ্টি অর্থনীতিবিদরা বিবিএস তথা সরকারের পরিসংখ্যানকে অসত্য ও বিভ্রান্তিকর হিসিবে অভিহিত করেছেন। তারা বলেছেন, যেখানে দেশে একটি পিয়ন পদে চাকরির জন্য কয়েক হাজার আবেদন জমা পড়ে, সেখানে মাত্র ২৬ লাখ বেকারের তথ্যটা ভিত্তিহীন এবং মানুষকে বোকা বানানোর কৌশল ছাড়া আর কিছুই নয়। উদাহরণ দিয়ে তারা বলেন, ভারতে সম্প্রতি চতুর্থ শ্রেণির গ্রেডে ৬ হাজার পদের বিপরীতে ২৫ লাখ আবেদন পড়েছিল। আর ভারতের মতো দেশে এ অবস্থা হলে বাংলাদেশের অবস্থা তো আরও করুণ। সেখানে মাত্র ২৬ লাখ বেকার কীভাবে হয়। তারা আরো বলেন, এ বিষয়ে বাস্তব চিত্র পেতে বেশি দূর যাওয়া লাগবে না। একটি গ্রাম ঘুরে জরিপ করলেই জানা যাবে, কতজন দক্ষ ও অদক্ষ বেকার বসে আছে। সময়মতো কাজ কিংবা চাকরি না পেয়ে অনেক শিক্ষিত বেকার হতাশায় নেশাগ্রস্থ হয়ে গেছে। এছাড়া অর্ধশিক্ষিত ও কমবেশি শিক্ষিত দক্ষ-অদক্ষ বেকার তো প্রতি বাড়িতেই কমপক্ষে দু’ এক জন পাওয়া যাবে। সরকার চায় না, জনগণ প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে জানার সুযোগ পাক। কারণ তাহলে সরকারের ব্যর্থতার চিত্রটা জাতির সামনে উন্মোচন হয়ে যাবে।
ক্ষমতাসীনরা তো বলেন, দেশে যত উন্নয়ন হয়েছে তার সিংহভাগই এই সরকারের অবদান। তর্কের খাতিরে না হয় ধরে নিলাম উন্নয়নের পেছনে লীগ সরকারের অবদান অস্বীকার করার সুযোগ নেই। উন্নয়নের সবটুকু অবদান যদি সরকারেই হয় তাহলে বেকারত্বের দায়টাও সরকারকে নিতে হবে। উন্নয়নের মাপকাঠি পরিমাপ করার জন্যে দাঁড়িপাল্লার প্রয়োজন নেই। দেশের সামগ্রিক চিত্র বিশ্লেষণ করলেই সহজে উত্তরটা পাওয়া যাবে। কালভার্ট আর ফ্লাইওভার নির্মাণ করলেই যদি দেশ উন্নত হতো তাহলে তো বেকারের সংখ্যা কমে যেত। সরকারের আজ্ঞাবহরা যতই উন্নয়নের ফানুস উড়িয়ে হাততালি দিক আর চটকদার কথা বলুক, যদি বেকারত্বের অবসান করতে না পারে তাহলে এ উন্নয়নের কোন মানে হয় না। যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী সাময়িকী ইকোনমিস্টের বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়ছে, বর্তমানে বালাদেশে ৪৭ শতাংশ ¯œাতক ডিগ্রিধারী শিক্ষার্থী বেকার। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুসারে বাংলাদেশের বেকারত্বের হার ১৪ দশমিক ২ শতাংশ। এ হিসাবে ২ কোটির উপর লোক বেকার। বাংলাদেশে চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে কি না সে বিষয়টি অনুধাবন করার জন্য মহাপÐিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। সে সম্পর্কে সহজে ধারণা পাওয়ার জন্য বিনিয়োগের দিকে দৃষ্টিপাত করা যেতে পারে। সরকার বলছে, বিনিয়োগ বাড়ছে। অথচ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মারাত্মক স্থবিরতা লক্ষ করা গেছে। দেশি পুঁজিপতি বা শিল্প মালিকরা কোনো কারখানায় বিনিয়োগ করার পরিবর্তে বিদেশে টাকা পাচার করে দিচ্ছে। অন্যদিকে দেশে বিনিয়োগ হচ্ছে না বলে বিদেশিরাও বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আসছে না। তারা বাংলাদেশের জন্য নিয়ে আসা অর্থ দিয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতে বা এশিয়ার অন্য কোনো দেশে শিল্প কারখানা গড়ে তুলেছে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি এম মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, দেশের অর্থনীতিতে প্রতিষ্ঠিত সত্য হল, বিনিয়োগ বাড়েনি। উন্নয়নের একটি প্রধান শর্ত হচ্ছে কর্মসংস্থান। আর এই কর্মসংস্থানের জন্য প্রয়োজন দেশে শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বৃদ্ধি। বিগত বছরগুলোতে দেশে অবকাঠামো উন্নয়নের নামে যে লুটপাট আর বিদেশে টাকা পাচার হয়েছে তা অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। বেকারত্বের অভিশাপ থেকে জাতিকে মুক্তি দিতে হলে সবার আগে প্রয়োজন দেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতির পরিবেশ সৃষ্টি করা। আমরা সরকারের কাছে শুধু উন্নয়ন চাই না, উন্নয়নের পাশাপাশি বেকারত্বের নাগপাশ থেকে মুক্তি চাই।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।