পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আমাদের দেশে বেকার সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। সন্তোষজনক চাকরি পাওয়া নিয়ে উচ্চ শিক্ষিত তরুণদে মধ্যে ক্রমেই হতাশা বাড়ছে। কেউ চাকরি না পেলে আমরা ভেবে নিচ্ছি, তার যোগ্যতার ঘাটতি রয়েছে। আবার যারা চাহিদা অনুযায়ী বেতন পাচ্ছেন না, তাদের বলা হচ্ছে, যোগ্যতা ও দক্ষতার অভাবে তারা বেতন কম পাচ্ছে। আসলেই কি তাই? দেশে বেসরকারিখাত কাক্সিক্ষত মানে বাড়ছে না। তাই কর্মসংস্থানও বাড়ছে না। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন স্নাতকপাস ৬৬ শতাংশ শিক্ষার্থী বেকার থাকছে। মূলত তিনটি কারণে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। প্রথমত, চাকরির বাজারের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে বড় ধরনের সমন্বয়হীনতা রয়েছে। চাকরির বাজারে যে ধরনের লোকের চাহিদা রয়েছে আমরা সে ধরনের লোক তৈরি করতে পারছি না। আবার প্রতি বছর যেসব শিক্ষিত লোক চাকরির বাজারে যুক্ত হচ্ছে, তাদের উপযোগী চাকরি নেই। গত ১০ বছরে দেশে স্নাতক পাস শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। কারণ, দেশে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ছে। ১০ বছর আগেও বছরে ২ থেকে আড়াই লাখ শিক্ষার্থী স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পাস করে চাকরির বাজারে যুক্ত হতো। এখন সেই সংখ্যা বেড়ে চার-পাঁচ লাখে উন্নীত হয়েছে। আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে বেশির ভাগ শিক্ষিত চাকরি প্রার্থী শোভন কাজ করতে চান, কিন্তু শহরে সে পরিমাণ চাকরির সুযোগ তৈরি হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, দেশে বর্তমানে চাকরির সুযোগ বাড়ছে উৎপাদশীল ও কৃষিখাতে। এ দুটি খাতে আবার স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পাস তরুণদের কাজের সুযোগ কম। এ দু’টি খাতে দক্ষ লোকের চাহিদা বেশি। শিক্ষিত যুবক যারা চাকরির বাজারে রয়েছে, তারা এসব কাজে নিজেদের যুক্ত করতে চায় না। এ ছাড়া করোনার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে যেসব শিক্ষিত যুবক ছোটখাট ব্যবসার মাধ্যমে স্বকর্মসংস্থানে যুক্ত ছিল, তারাও বেকার হয়ে পড়েছে। এসব ছোট ছোট উদ্যোক্তার হাতে সরকারি অর্থও খুব একটা পৌঁছায়নি। ফলে বাধ্য হয়ে অনেকে ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছে। এতেও শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়ে গেছে। দেশে শিক্ষিত বেকার বেড়ে যাওয়ার তৃতীয় কারণ। সরকারি চাকরিতে যেভাবে সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হয়েছে, বেসরকারি খাত সেভাবে এগোয়নি। এখন মেধাবী ও শিক্ষিত তরুণেরা বেসরকারি চাকরির বদলে সরকারি চাকরিতে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এ জন্য আলাদাভাবে প্রস্তুতি নেয় তারা। আর এ সময়াটতে তারা স্বেচ্ছায় বেকার থাকার পথ বেছে নেয়।
বিবিএসের জরিপে জানা যায়, দেশে উচ্চ শিক্ষিত বেকার বিপুল। সরকারি খাতের চাকরির বেতন বাড়ছে বলে তরুণেরা হন্যে হয়ে সরকারি চাকরির পিছনে ছুটছে। সরকারি চাকরির বেতন সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি এবং সামাজিক প্রতিপত্তি ও মর্যাদার বিষয় থাকলেও আরেকটি কারণ আছে, যার দিকে আমরা নজর দিচ্ছি না। সেটা হলো, বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কাক্সিক্ষত হারে না বাড়া। রাষ্ট্রের তো নাগরিকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার কথা। কিন্তু সেটি আমরা ভুলতে বসেছি। আমরা খুব স্বাভাবিকভাবে মেনে নিচ্ছি এখানে রাষ্ট্রের ভূমিকা নেই। তাই বলে এটা বলছি না, রাষ্ট্র সবাইকে চাকরি দেবে। সব মানুষ যাতে কাজ পায় সেটা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
আমাদের দেশে সব চাইতে বড় সমস্যা সুশাসনের অভাব। এটা না থাকায় কাক্সিক্ষত হারে বিনিয়োগ বাড়ছে না। অন্যদিকে বিদেশি বিনিয়োগ আসার অনেক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সুশাসনের অভাবের জন্য তা আসছে না। সুশাসন নিশ্চিত করতে পারে সরকার। সরকার যদি বিনিয়োগ বাড়ার পরিবেশ তৈরি করতে পারে, তাহলে বেকার সমস্যা এমনিতেই ঘুচে যাবে। এটাই এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি। অন্যদিকে আমাদের মধ্যবিত্তের মানসিকতায় পরিবর্তন আনা জরুরি। শুধু চাকরি করাটাই জীবনের লক্ষ্য হতে পারে না। আমাদের উদ্যোগী হওয়ার মানসিকতা অর্জন করা জরুরি। উদ্যোক্তা হওয়াটা অনেক কঠিন কাজ। দেশে এখন ব্যাংকঋণ থেকে শুরু করে অবকাঠামো ও উপকরণজনিত সুবিধা পাওয়া হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো ব্যাপার। অথচ, খেলাপি ঋণের পরিমাণ অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। যারা ঋণ ফেরত দেবে না, তাদের ঋণ দেয়া হচ্ছে। এতে প্রকৃত উদ্যোক্তারা ঋণ পাচ্ছে না। এটা আর্থিক খাতের সুশাসনজনিত সমস্যা, যার সমাধান করতে পারে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও সরকার। বড় শিল্পে সব মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত হবে না। গ্রাম-গঞ্জে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প। জার্মানির মতো উন্নত দেশও এখন মাঝারি উদ্যোগের উপর জোর দেয়া হচ্ছে। এর গুরুত্ব আমরা বুঝতে পারছি না। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) উপাত্ত মতে, বাংলাদেশে শ্রমশক্তি বছরে গড়ে ২ শতাংশ হারে বাড়ছে। এক হাজার শূন্য পদের বিপরীতে এক লাখ মানুষের আবেদন পড়লেও তা কাজের কথা নয়। সরকারের ভূমিকা ছাড়া বিপুল মানুষের কর্মসংস্থান সম্ভব নয়। এর জন্য দরকার রাষ্ট্রীয় নীতি। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র শুধু বিশেষ গোষ্ঠির স্বার্থ দেখবে না। সবারটা দেখতে হবে। বেকারত্ব অর্জন বা নিজেকে বেকার বলে পরিচয় দেওয়া দেশে যেন রীতি হয়ে গেছে। এই বেকারত্বে সময়সীমা অনেক দীর্ঘ। দিনের পর দিন গেলেও অনেক উচ্চ শিক্ষিত বেকার থেকে যায়। পত্রিকান্তরে গত বছরের ২ মার্চ ‘উচ্চ শিক্ষিতদের অর্ধেক বেকার’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, কাজের বাজারের চাহিদার সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থা সংগতিপূর্ণ না হওয়ায় দেশে শিক্ষিত বেকারসংখ্যা বেড়ে চলেছে। প্রতিবছর উচ্চশিক্ষা নিয়ে বাজারে আসা শিক্ষার্থীদের অর্ধেক বেকার থাকছে, অথবা যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পাচ্ছে না। একইদিনে ‘লক্ষ্যহীন উচ্চ শিক্ষা, কর্মহীন স্নাতকেরা’ শিরোনামের আর একটি প্রতিবেদনে ব্রিটিশ সাময়িকী দি ইকোনমিস্ট-এর বরাত দিয়ে বলা হয়, স্নাতকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা আর কাজের বাজারের মধ্যে বিশাল ফারাক থাকায় শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। একই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, শ্রম বাজার ও সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সমম্বয় নেই। জাতীয় সংসদের অধিবেশনে বীরেন শিকদার জানান, বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ অনুসারে দেশে বেকারের সংখ্যা ৩ কোটি ৩৯ লাখ ৮৭ হাজার, এর মধ্যে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ১৯ লাখ ৫১ হাজার। এর দায় কার? শিক্ষার্থীদের কী দোষ? শিক্ষার্থী তো সিলেবাস, শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত ফসল। শিক্ষার্থীদের বার বার বিভিন্ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করতে হয়। আর স্নাতক, স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা একজন শিক্ষার্থীকে কীভাবে কর্মবাজারে অযোগ্য বলা হয়? রাষ্ট্রের কাঠামোই এমন যে, এখানে কিছু নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষই কাজ পাবে। এর বাইরে কারো কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। একদিকে যেমন প্রযোজনীয় কারিগরি জ্ঞানের অভাব রয়েছে। আরেকদিকে অনেকের কাজের ক্ষেত্রও নেই। এত বিশাল বেকারের পাহাড় নিয়ে দেশ সফলভাবে এগিয়ে যেতে পারে না। এত মানুষ বেকার যে, শুধু দুঃখের জাল বুনে দায়িত্ব পালন করা যায় না। এ অমূল্য মেধা-সম্পদ অপচয় হচ্ছে বলে কারো দুশ্চিন্তা আছে বলে মনে হয় না। তবু আমরা আশাবাদী, সরকার বেকার সমস্যা নিরসনে সুষ্ঠু পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়নে দ্রুত পদক্ষেপ নেবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, দেশে কর্মক্ষম ২৬ লাখ ৩০ হাজার মানুষ বেকার। এর মধ্যে পুরুষ ১৪ লাখ, নারী ১২ লাখ ৩০ হাজার, যা মোট শ্রম শক্তির সাড়ে ৪ শতাংশ। তিন বছর আগে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৫ লাখ ৯০ হাজার। এক বছর আগে ছিল ২০ লাখ।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুরের অভিমত, প্রকৃত বেকার আরো বেশি। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে ৫ শতাংশের বেশি বেকার, সেখানে বাংলাদেশে ৪ শতাংশ বলা হচ্ছে। এটি গ্রহণযোগ্য নয়। তার মতে, বর্তমান চাকরির বাজারের চাহিদার সঙ্গে শিক্ষা ব্যবস্থা সঙ্গতিপূর্ণ না হওয়ায় শিক্ষিত বেকার বেড়েই চলেছে। এ দিকে বিশ্বব্যাংক মনে করে, সরকার কম দেখালেও প্রকৃত পক্ষে বাংলাদেশে বেকারত্বের হার ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ। এর ওপর প্রতিবছর নতুন করে ১৩ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে যোগ হচ্ছে। সুতারাং নতুন করে কর্মসংস্থান তৈরির চাপ রয়েছে অর্থনীতির ওপর। সংস্থাটির মতে, বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের হার ২ শতাংশ বাড়ানো গেলে প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশ উন্নীত হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।