শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
শেখ আল মামুন
মোড়ে চায়ের দোকান দিয়েছে কাশেম চাচা। গ্রামের বৃদ্ধরা সন্ধ্যার পর ভালোই আসর জামায়। দোকানে নতুন টিভি কেনা হয়েছে। খবরের নাম করে বসে থাকে বৃদ্ধরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা। হিন্দি সিনেমা দেখে দাঁত কেলিয়ে হাসে তারা। হিন্দি কথা বুঝতে কষ্ট হয় না কারো। টিভি নেই এমন ঘর একালে কমই আছে। ঘরে বসে মুখে পাকা দাড়ি নিয়ে ছেলের বৌদের সাথে টিভি দেখবে এটা কারো পক্ষে সম্ভব না। এখন সবার কাছে ভালো সাজার উত্তম তরিকা হলো টিভি দেখা থেকে বিরত থাকতে বলা। টিভি দেখলে গুনাহ হয়। পরকালে শাস্তি হবে। বড় পাপ হয়। এসব কথা শুনাতে হয় বৌ ছেলেদের। নিজের বেলায় কথাগুলো প্রযোজ্য না! কাশেমের দোকানে গিয়ে উঁচু গলায় বলে, ‘ও কাশেম, হিন্দি সিনাল ধর বাংলা আর ভাল্লাগেনা!’ টিভি থাকাতে সুবিধে হয়েছে কাশেম চাচার। না হয় সময়-অসময় তেমন কাস্টমার হতো না। এখন রাতদুপুরেও কাস্টমারে ভরা থাকে কাশেম হল। সিনেমার লোভে এক ঘণ্টায় তিন-চারটা চা খায় সবাই। টিভি থাকলে লাভ! টিভি চললে লাভ!
দুই
ফুলির মা। বয়স ত্রিশ হবে। তার নাম আজ অব্দি কেউ জানে না। সবাই তাকে এক নামে ফুলির মা বলে ডাকে। তাকে একবার নাম জিজ্ঞাস করা হলে সে বলে ‘গরিব মাইনষের গো আবার নাম অয় নাকি? তাগোরে একেকজন একেক নামে ডাকে। ছেমরি কইয়া ডাকে আরে কত ভাবে...!’ ফুলির মা দেখতে সুন্দর। স্বাস্থ্যও ভালো। যে কারো নজরে বাধে। স্বামী মারা গেছে বছর তিনেক হল। একটা মেয়ে ছিল ‘ফুলি’। পাঁচ বছর বয়স সেও মারা গেল। স্বামী মৃত্যুর পর আর বিয়ে করেনি। এলাকার মহিলাদের সাথে ফুলির মার ভালো খাতির। ভালো খাতিরের পেছনে অবশ্য কিছু কারণও আছে, মহিলাদের একান্ত কিছু কাজ থাকে যা সবার সামনে সবার কাছে বলা যায় না। দোকানে গিয়ে নিজের প্রয়োজনীয় পণ্যটির নাম বলতে পারে না। লজ্জায় লাল হয়ে যায় এমনও কেউ আছে। বিশেষ করে কিশোরীদের এমনটি হয়ে থাকে। তখন সবার উপকারে আসে ফুলির মা। এ কাজগুলো করাতে অনেকে অনেক রকম সহযোগিতা করে তাকে। ঈদে চাঁদে তার জন্য কাপড় পাঠায় মহিলারা। টাকা দেয়। দাওয়াত করে। ফুলির মার একটি ভালো গুণ হলো সে ধাত্রীর কাজ জানে। দাত্রীর কাজ জানে বলে সবাই তাকে বিঘœ বিপন্ন অবস্থায় ডাকে। কাউকে নাখোশ করে না। রাতদুপুরে ছুটে যায় মানুষের উপকারার্থে। এখন আর আগের মত কেউ তার খোঁজে আসে না। কিছু হলেই ছুটে যায় শহরে। ক্লিনিকে। মানুষ আর আগের মত নেই। এখন টাকা হয়েছে সবার কাছে। হাসপাতাল থেকে নার্স এনে কাজ করায়। ধাত্রীর চল উঠে গেছে। এভাবে ফুলির মার আয়রোজগার কমতে থাকে দিনদিন। কিছু করার থাকে না তার। এখন সাচ্ছন্দ্যে চলার একমাত্র উপায় করে নিয়েছে গ্রামের মধ্যবয়সী পুরুষ মানুষকে একান্ত কিছু সময় দিয়ে।
তিন
হিন্দুপাড়ায় পুকুর নেই। তাই হিন্দুরা গোসল করতে আসে মুসলমানের পুকুরে। বড় পুকুর। পাকাঘাট করা। গত ইলেকশনে চেয়ারম্যান পাশা কথা দিয়েছিল পুকুরে ঘাট আর গাইডওয়াল করে দেবে। চেয়ারম্যান তার দেয়া প্রতিশ্রুতি পালন করেছে। ঘাট করেছে বড় করে। চতুর্দিক ওয়াল করেছে আর যাতে না ভাঙে। সবাই নেমে গোসল করে পুরুষ-মহিলা এক সাথে। এতে লজ্জার কিছু মনে করে না তারা। পাহাড়ি গ্রামের কিছু পরিবেশ এমনই। লজ্জা বলতে কিছু নেই তাদের। স্বপন। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। প্রতিদিন একই সময় গোসল করতে আসে সে। ঐ সময় কেউ থাকে না ঘাটে। একা একা গোসল সেরে চলে যায়। একদিন ফুলির মা কি বুঝে স্বপনের পিছুপিছু এসে সেও গোসল করতে নামে। অকারণে মেয়েছেলের দিকে তাকানো তার নিষেধ আছে। সে নিরিবিলি পানিতে নেমে গোসল করে। তার চোখ বন্ধ থাকে। আজো চোখ বন্ধ ছিল। চোখ খুলে তার সামনে ফুলির মাকে দেখতে পেল। তার গা ভেজা। বুক পাতলা কাপড় দিয়ে ঢাকা। লজ্জাহীন কেও দেখলে পলকহীনভাবে তাকিয়ে থাকবে। ফুলির মা স্বপনের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। স্বপন চোখ বন্ধ করে ‘ঈশ্বর রক্ষা কর! রক্ষা কর!’ বলে পানি থেকে উঠে সোজা চলে গেল। ফুলির মা এভাবে প্রতিদিন স্বপনের সামনে এসে ব্লাউজ খুলে পাতলা কাপড়ে বুক ঢেকে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুদিন স্বপন এড়িয়ে যায়। কিন্তু অল্প কদিন পর একটু করে দেখতে দেখতে লোভ জমে ফুলির মার প্রতি। এখন ফুলির মাকে আর সামনে এসে দাঁড়াতে হয় না। দূরে থাকে। স্বপন গীতা পাঠের ফাঁকে একটু করে দেখতে থাকে। দেখে মুগ্ধ হয় বারবার। দুজন চোখাচোখি হলে দুজনের মুখে গোপন হাসি ফুটে ওঠে। চোখের চাহুনিতে থাকে টান। ফুলির মা ভেজা গা নিয়ে সিঁড়িপথে পা বাড়ায়। স্বপন বুকসম পানিতে গলা ভিজিয়ে মুগ্ধ নয়নে তার চলে যাওয়া দেখে। একদিন স্বপন আগবাড়িয় বলল, ‘রাতে ঘরে আর কেও থাকে?’ ফুলির মা কিছু না বলে মাথা নাড়লো!
চার
সন্ধ্যার সময়। আমার ঘরের বাতি নেভানো। দরজা খুলে দেখি খাটে কেউ একজন শুয়ে আছে। অসময় কে আসলো! আলো জালিয়ে দেখি বড় খালু শুয়ে আছে। আমাকে দেখে চোখ বন্ধ রেখেই বলল, ‘এত দেরি করলি কেন।’ মনে হয় যেন আমি প্রতিদিন এ সময় আসি। ‘সে কখন থেকে শুয়ে আছি এখানে, অথচ তোর কোনো পাত্তা নেই।’ তারপর খালুকে বললাম কি মনে করে আসলেন? তিনি মুখ শক্ত করে বলল, ‘তোর খালার উৎপাতে কি আর ঘরে থাকা যায়। প্রতিদিন একটা না একটা নিয়ে কোন্দল পাকিয়ে লেগেই আছে আমার পেছনে। পঁচিশ বছরে একটা মিষ্টি কথাও পেলাম না তার মুখ থেকে। আল্লায় তার মুখে কোনো মিষ্টি দিল না। বদ একটা মহিলা!’
খালু ইচ্ছেমত খালার বদনামি করে আমার দিকে ঝুঁকে এসে মুখ স্বাভাবিক করে বলল, ‘তোদের এখানে একজন মহিলা থাকে না রহিমা নামের?’ আমি বললাম কই রহিমা নামের কেওতো এখানে থাকে না। তিনি আরো ঝুঁকে এসে বলল, ‘আরে গাধা ফুলির মা নামের ঐ মহিলা।’ ও তার নাম আবার রহিমা হল কখন? তার নাম ত ফুলির মা। খালু রাগি গলায় বলল, ‘ফুলির মা কারো নাম হয় নাকি? তার নাম রহিমা।’ তুমি কি করে জানলে তার নাম? ‘সে ই তো বলল।’
‘আসার সময় তার সাথে দেখা হয়েছে আমার। সুন্দর মহিলা। স্বাস্থ্যও ভালো। দেখলে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে! আমাকে একটা পান খাওয়ালো নিজেও একটা মুখে দিল। হাত নেড়েনেড়ে কি সুন্দর করেই না কথা বলেছে আমার সাথে। অথচ তোর খালা আমার সাথে অত সুন্দর করে কখনোই কথা বলেনি। ভাবছি তোর খালাকে তালাক দিয়ে ফুলির মাকে বিয়ে করব। তুই কি বলিস?’ আমি বললাম হুঁ তালাক দেয়া দরকার। খালা তোমাকে যথেষ্ট জালাচ্ছে! ‘ফুলির মাকে বিয়ে করলে কেমন হয়?’ ভালোই তোমার সাথে মানাবে ভালো। মহিলা দেখতে খারাপ না। আমার কথা শুনে খালুর চোখমুখ আনন্দে ফুটে উঠেছে। ‘তুই তাহলে প্রস্তাব দে। রাজরানীর মত রাখব তাকে। আমার সব কিছু তার নামে করে দিব। তুই শুধু প্রস্তাব দে!’
বড়খালু আর কিছু বলল না অনন্দিত মুখ নিয়ে বেরিয়ে গেল। অন্ধকারে তার ছায়া দেখা যাচ্ছিল, তিনি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যাচ্ছেন। তার হাঁটার ভঙ্গি আজ অন্যরকম; পঞ্চাশ বছরের কোনো বয়স্ক মানুষ নয় মনে হয় যেন কুড়ি বাইশ বছরের কোনো কিশোর সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছেন! আমি উদগ্রীব ভঙ্গিতে তার চলে যাওয়া দেখছি। তিনি চলে গেছেন। সিঁড়ির ঘরে আর কোনো ছায়া নেই। অন্ধকারে সব কালো হয়ে আছে। বড়খালুর ছায়া অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে। এখন চারদিক শুধুই কালো!
পাঁচ
কিছুক্ষণ পর মাগরিবের আজান হবে। কাশেম চাচার দোকানে এ সময় প্রচুর ভিড় হয়। আজো ভিড়। ফুলির মা প্রতিদিন এ সময় দোকানে আসে। প্রচুর ভিড়েও কাশেম চাচা তাকে ক্যাশবাক্সের পাশে টুল টেনে জায়গা করে দেয়। ‘কাশেম ভাই চা দেও’ বলে সে টিভির দিকে চোখ ফেলে। ফুলির মা আসলে কাশেম অন্যদের দিকে আর কোনো খেয়াল করে না। কে আসলো কেন আসলো কারো দিকে কোনো নজরই নেই। এখন দোকানের সব কাস্টমার হল ফুলির মা! কাশেম দুধ চিনি বাড়িয়ে চা বানায়। কাঁসের পিরিচে করে কয়েকটা পুরি দেয়। ফুলির মা নীরবে বসে খায়। কাশেম চাচা তাকিয়ে ফুলির মার খাওন দেখছে। কি সুন্দর করে চিবাচ্ছে সে! গালের এপাশ ওপাশ থকথক করে নড়ছে! কাশেম চাচা তাকিয়ে আছে তার দিকে। তার কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম দৃশ্যের একটি হল এটি।
নাস্তা খাওয়া শেষ। ফুলির মা এখন চলে যাবে। আগ থেকে তৈরি করা বিশ্রুত হাসি ছুড়ে মারল কাশেম চাচার দিকে। কাশেম চাচা মুগ্ধ হয়ে নিজেও ক্ষণিক হাসল। এ হল গোপন হাসি যা কারো মনের গহীন থেকে আসে আর কারো ঠোঁটের কোন থেকে। কাশেম চাচার মন থেকে আসল ‘দুষ্ট’ হাসি আর ফুলির মার ঠোটের কোন থেকে ‘চামড়া’র লালিত হাসি। এ সত্যি রহস্য। কিছু মানুষ আছে প্রতিনিয়ত এমন হাজারো রহস্য তৈরি করে। রহস্যের স্রষ্টা তারা! আমরা তাদের তৈরি করা রহস্য বুঝি না। কিংবা বুঝেও না বোঝার ভান করি!
ফুলির মা ঠোঁটের কোনে অস্পষ্ট হাসি নিয়ে ‘সময় করে আইসেন’ বলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। কাশেম খুশি হয়ে মাথা ঝাঁকে। ফুলির মা চলে গেছে অনেক দূরে। কাশেম এখনো তাকিয়ে আছে, দূরের অনেক দূরের একজন নর্তকীকে দেখছে। যার উদাহরণ ‘একচিমটি গুড়!’ কাশেমের চোখের পলক পড়ছে না পলক দুটো খোসে গেছে মাছের মত। সে তাকিয়ে আছে পলকহীন ভাবো।
শেষ
ফুলির মার কোলে ফুটফুটে একটা মেয়ে বাচ্চা। দেখতে সুন্দর। সুন্দর হলেও তার উপাধি ‘জারজ’। সে এ পদবি নিয়েই দুনিয়ার বুকে বেঁচে থাকবে নির্দিষ্ট সময়। ফুলির বাবা মরেছে চার বছরে পড়ল। চার বছর পর এ বাচ্চা কোথায় থেকে আসলো? এ প্রশ্ন আমরা কেও করি না। এ সমাজে ব্যভিচারের কোনো বিচার নেই। এটাকেও কি রহস্য বলবো? না এতো রহস্য না। এ হল সমাজের উচ্চশ্রেণী (বিচারক)-দের তৈরি করা রহস্য। আমরা তাদের তৈরি করা রহস্য বুঝি না। কিংবা বুঝেও না বোঝার ছল করি! তারা চলুক তাদের মত করে। দেহই তো-যা ‘চামড়া’র তৈরি! বিচারকরাও সে একি দেহ ভোক্তা! তাদের মনেও এখনো ভোগতৃষ্ণা! আমরা এড়িয়ে যাই এসব পরিস্থিতি। ভুলে যাই তখন ইসলামের কথা। ভুলে যাই ইসলাম কতো কঠোর ব্যভিচার/ব্যভিচারিণীদের বিরুদ্ধে। নবীজী (সাঃ) তো পাথর নিক্ষেপ করে ব্যভিচারিণী, নারী সম্ভোগকারীদের বিচার করেছেন। আমরা কেন পারি না। আমরা এড়িয়ে যাই ইসলামকে। প্রয়োজন মনে করি না ইসলামী সমাজব্যবস্থার। ভুলে যাই ইসলামী রাষ্ট্রের স্বপ্ন। ভুলে যাই নিজেদের নৈতিক দায়িত্ব।
পুনশ্চ # ১
ফুলির মা দোকানে বসে এখনো চা খায়। হিন্দু পাড়ায়ও যায়। অন্ধকার রাতে তার ঘরে এখনো দরজার কড়া নড়ে খটখট শব্দে।
পুনশ্চ # ২
ফুলির বাবার মৃত্যুর চার বছর পর জন্ম নেয়া বাচ্চাটি এখন হাঁটতে পারে। তার মা আছে, বাবা নেই! তার মা আগের মত এদিক ওদিক যেতে পারে না। শরীর ভারি হয়ে আছে। হাত-পায়ে পানি জমেছে!
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।