পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বিলম্বে হলেও ইসলামি সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি) রোহিঙ্গাদের প্রতি সহিংসতা ও বঞ্চনা বন্ধে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। ৫৭টি মুসলিম দেশ নিয়ে গঠিত এই জোটের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বিশেষ বৈঠক শেষে প্রচারিত ১০ দফা ইশতেহারে এই আহ্বান জানানো হয়েছে। মিয়ানমারের ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনে পরিবর্তন এনে রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিতে দেশটির কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করা হয়েছে। মিয়ানমার বিষয়ক ওআইসি’র বিশেষ দূত সৈয়দ হামিদ আলবার বৈঠকে রোহিঙ্গাদের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। প্রতিবেদনে তিনি রোহিঙ্গাদের উপর গণহত্যা, ব্যাপক হারে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সহিংসতার মাধ্যমে ‘শাস্তি’ দেয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন। রোহিঙ্গা সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক আইন, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ও মানবাধিকার বিষয়ক সনদের বাধ্যবাধকতা মেনে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা মুসলমানদের প্রতি সহিংসতা ও বঞ্চনা রোধে সব পদক্ষেপ নেয়ার পাশাপাশি তাদের সংস্কৃতি-পরিচয় অস্বীকারের অব্যাহত চেষ্টা বন্ধের আহ্বানও জানানো হয়েছে। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের জন্য ওআইসি এর মূলে যাওয়ার কথা বলেছে। ওআইসি মহাসচিব ইউসুফ বিন আহমেদ আর-ওথাইমান রাখাইনে রোহিঙ্গাদের মানবিক ত্রাণসহায়তা বিলির অনুমতি দিতে এবং রোহিঙ্গাদের উপর সহিংসতা তদন্তের জন্য মিয়ানমারকে অনুরোধ জানিয়েছেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেছেন, অবিলম্বে রাখাইন রাজ্যে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে এনে এবং পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন করতে হবে। সমস্যার টেকসই সমাধানের জন্য তিনি রাখাইনের মুসলমানদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার উপর জোর দেন। ওআইসি’র এই আহ্বান ও অনুরোধ মিয়ানমার সরকার কতটা আমলে নেবে এবং এ অনুযায়ী কার্যকর পদক্ষেপ নেবে, তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ থাকলেও, তার উপর যে এক ধরনের চাপ সৃষ্টি হবে, তা আশা করা যায়।
প্রায় চার মাস ধরে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর যে নিপীড়ন, নির্যাতন, গণহত্যা, ধর্ষণ ও জ্বালাও-পোড়াও চলছেÑ এ ধরনের বর্বরতা পৃথিবীর ইতিহাসে খুব কমই দৃষ্ট হয়। নিরীহ ও নিরস্ত্র মানুষকে পাখির মতো গুলি করে হত্যার এমন উন্মাদনার নজির আর একটিও নেই। রোহিঙ্গাদের উপর এমন কাঠামোগত হত্যাযজ্ঞ ও উৎসাদন প্রক্রিয়া দেখেও তা থামানোর কোনো উদ্যোগ বিশ্বের মোড়ল রাষ্ট্রগুলোর পক্ষ থেকে নেয়া হয়নি। তারা দুয়েকটি বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েই ক্ষান্ত হয়েছে। এমনকি মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থা ওআইসিসহ আরব লীগের কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। একমাত্র মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া এ ব্যাপারে কঠোর প্রতিবাদ করে আসছে। মালয়েশিয়া রাখাইন থেকে বিতাড়িত প্রায় ৫৬ হাজার রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে। চীন ও থাইল্যান্ডও এর সাথে শামিল হয়েছে। বাংলাদেশ তার সীমিত সামর্থ্যরে মধ্যে থেকেও মানবিক হয়ে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছে এবং প্রতিবাদ করেছে। অথচ ওআইসি কোনো টুঁ শব্দ করেনি। আগুনে পুড়ে যখন সবকিছু ছাই হওয়ার পথে তখন সংস্থাটি মুখ খুলেছে। তাও আবার বক্তব্য-বিবৃতি এবং অনুরোধের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছে। এটা পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোর মতো লিপ সার্ভিস ছাড়া কিছুই নয়। মুসলমানদের রক্ষায় তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ এবং কঠোর হুঁশিয়ারি ও পদক্ষেপ গ্রহণের যে প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল, সে সময়টিতে সংস্থাটি কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো তাদের বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে যখন চুপ মেরে গেছে, তখন ওআইসি অনেকটা তাদের মতোই বক্তব্য দিচ্ছে। মুসলমানদের ঐক্য ও তাদের পাশে দাঁড়ানোর লক্ষ্যে যে সংস্থা গঠিত হয়েছে, তা যদি সময় মতো কার্যকর না হয়, তখন তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। বিলম্বে হলেও সংস্থাটি যে বিশেষ বৈঠক করেছে, তাতে প্রস্তাব ও আহ্বান জানানো ছাড়া মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জোরালো কোনো অবস্থান নিতে পারেনি। দেখা যাবে, অতীতের মতোই এ ধরনের অভিযোগ ও আহ্বান মিয়ানমার সরকার অস্বীকার করে বসবে। ইতোমধ্যে আমরা লক্ষ্য করেছি, যারাই রোহিঙ্গাদের উপর অত্যাচার-নির্যাতনের অভিযোগ এবং তা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে, মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সুচি তাদের এক হাত নিয়েছেন। তিনি চরম বিরক্তি প্রকাশ করে বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। এমনকি জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে যে তদন্ত কমিটি মিয়ানমারে গিয়েছিল, তাকে রাখাইনে ঢুকতেই দেয়া হয়নি। কমিটিকে বিফল মনোরথ হয়ে ফিরতে হয়েছে। অন্যদিকে নিজেদের মুখ রক্ষার জন্য সরকারি বাহিনীকে বিরত রেখে অন্য পন্থায় রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে মিয়ানমার। স্থানীয় সন্ত্রাসীদের দিয়ে নতুন সংগঠন তৈরি করে রোহিঙ্গা হত্যাকা- চালানো হচ্ছে।
আমরা মনে করি, রোহিঙ্গা মুসলমান নিধন বন্ধে ওআইসি মিয়ানমার সরকারকে যে আহ্বান ও অনুরোধ করেছে, তা কোনোভাবেই যথেষ্ট নয়। এগুলো কাগুজে কথাবর্তা হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে। রোহিঙ্গা উচ্ছেদের বিষয়টি যে এখন আর মিয়ানমারের আভ্যন্তরীণ বিষয় নয়, এটা বৈশ্বিক, তা মিয়ানমার বিষয়ক ওআইসির বিশেষ দূত ড. হামিদ আলবার বলেছেন। আমরাও মনে করি, এ সমস্যা এখন আর মিয়ানমারের আভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। একটি দেশ থেকে একটি আদি জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করা কোনো আভ্যন্তরীণ বিষয় হতে পারে না। এটিকে বৈশ্বিক উদ্বেগ হিসেবে দেখতে হবে। এ ব্যাপারে মুসলিম বিশ্ব ওআইসিকে কঠোর অবস্থানে দেখতে চায়। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপর চলমান গণহত্যা বন্ধে ওআইসিকে জাতিসংঘকে হস্তক্ষেপের আহ্বান জানাতে হবে। মিয়ানমারকে বিনীতভাবে আর অনুরোধ ও আহ্বান জানানোর সুযোগ নেই। ইতোমধ্যে মিয়ানমার যে এসব অনুরোধ ও আহ্বানে কোনো সাড়া দেয়নি, তা বিশ্ব দেখেছে। মিয়ানমারের এই উপেক্ষার জবাব দিতে এখন লিপ সার্ভিসে কাজ হবে না, তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিকভাবে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। গণহত্যার অপরাধে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা আশা করব, ওআইসি, জাতিসংঘকে নিয়ে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপর চলমান গণহত্যা বন্ধ এবং তাদের নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাস্তবানুগ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।