হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
কামরুল হাসান দর্পণ : আমাদের দেশে গণতন্ত্র নিয়ে দিবস আছে। তারিখ এক হলেও একেক রাজনৈতিক দলের কাছে দিনটি একেক রকম হয়ে দেখা দেয়। কারো কাছে দিবসটি ‘গণতন্ত্র রক্ষা দিবস’, কারো কাছে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’। গণতন্ত্র নিয়ে এরকম বিপরীতমুখী অবস্থানের দিবস বিশ্বে আর কোথাও আছে কিনা, জানা নেই। তবে বিপরীতমুখী অবস্থান হলেও তাদের মূল সুর একই এবং তারা গণতন্ত্রকে রক্ষা, আদর-যতœ ও লালন করার কথাই বলেন। প্রত্যেকের এই মনোভাব থাকে, তারাই একমাত্র গণতন্ত্র রক্ষার দাবিদার এবং তারাই পারে একে রক্ষা করতে। বলাবাহুল্য, আমাদের দেশের জন্মের মূল ভিত্তিই ছিল গণতন্ত্রকে কেন্দ্র করে। পাকিস্তানিদের অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরশাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এ দেশের মুক্তিকামী মানুষ দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম করে মুক্ত পরিবেশে নিঃশ্বাস নিয়ে কথা বলা ও মত প্রকাশের অধিকার আদায় করেছিল। স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করেছিল। সবাই নিশ্চিন্ত ছিল, স্বাধীন বাংলাদেশে গণতন্ত্র নিয়ে আর কখনো কেউ ছিনিমিনি খেলবে না এবং গণতন্ত্রের গলাটিপে ধরবে না। গণতন্ত্রকে তার শতধারায় প্রবাহিত হতে দেবে। তবে তাদের এ আশা হতাশায় পরিণত হতে খুব বেশি সময় লাগেনি। স্বাধীনতার পাঁচ বছর না যেতেই তাদের মুক্তচিন্তার ছেদ টেনে গণতন্ত্রকে একেবারে হাতের মুঠোয় পুরে ফেলা হয়েছিল। কায়েম করা হয়েছিল এক দলীয় শাসন ব্যবস্থা। স্বাধীন দেশে গণতন্ত্রের ওপর এত বড় আঘাত কেউ কল্পনা করতে না পারলেও তাই হয়েছিল। গণতন্ত্রকে যখন রুদ্ধ করা হয়, তখন অগণতান্ত্রিক অনেক শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সে সময়ও তাই হয়েছিল। রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থান এবং নৃশংস হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে দেশকে এক অনিশ্চয়তা ও অশান্তির দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছিল। অবশেষে ’৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ভিন্ন পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে দেশ শান্ত হয়। সেই সময় থেকে ৭ নভেম্বর জাতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিবস হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। দিনটি সিপাহি-জনতার বিপ্লব বা জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে পালিত হতে থাকে। কেউ কেউ গণতন্ত্রের মুক্তির সোপান হিসেবে দিনটিকে চিহ্নিত করেন। যদিও বছর দুয়েক সামরিক শাসন ছিল, তবে গণতন্ত্রকে এক লহমায় নিঃশেষ করে দেয়ার পর তা মুক্ত হতে যে অনিশ্চিত সময় লাগে, সে সময় তা হয়নি। দ্রুতই সকল রাজনৈতিক দল তাদের কর্মকা- পরিচালনা করতে শুরু করে। ৭ নভেম্বরকে এখন আর জাতীয়ভাবে পালন করা হয় না। তবে এর পক্ষে যেসব দল তারা যথানিয়মে জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে দিবসটি পালন করে থাকে। অন্যদিকে এর বিরুদ্ধবাদীরা দিবসটিকে কালো দিবস হিসেবে গণ্য করে পালন করে না। ’৮২ সালের ২৪ মার্চ একটি গণতান্ত্রিক সরকারকে বন্দুকের মুখে সরিয়ে দিয়ে গণতন্ত্রকে আবারও রুদ্ধ করে দেন সে সময়ের সেনাবাহিনী প্রধান লে. জে. হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তিনি দীর্ঘ ৯ বছর গণতন্ত্রকে বুটের তলায় পিষ্ট করে রেখেছিলেন। সে সময়ে প্রায় সব বিরোধী দল জনগণের সমর্থনে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে আন্দোলন-সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সবার একই স্লোগান ছিল, ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক’। এই আন্দোলন করতে গিয়ে বিরোধী দলগুলোর অনেক নেতাকর্মী নির্যাতিত ও নিহত হয়। এর মধ্যে আলোচিত ঘটনা ছিল, বুকে-পিঠে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ লিখে নূর হোসেন নামে এক যুবকের গুলিতে শহীদ হওয়া। তাকে স্বৈরাচারী সরকারের বাহিনী গুলি করে হত্যা করে। সে সময় থেকে নূর হোসেন দিবস নামে একটি দিবস পালন করা হয়। এ দিবসটিও গণতন্ত্র মুক্তির দিবস হিসেবে পালিত হয়। তারপর জেহাদ দিবস, ডা. মিলন দিবসও পালন করা হয়। এসব দিবসের ক্ষেত্রে অবশ্য কোনো দলেরই পারস্পরিক বিরোধিতা নেই। ’৮৯ সালের ৬ ডিসেম্বর যখন এরশাদের পতন হয়, তখন এ দিবসটিকে পরিপূর্ণভাবে গণতন্ত্র মুক্তি দিবস হিসেবে এক সময় দলমত নির্বিশেষে পালন করা হতো। এর একমাত্র বিরোধী ছিল এরশাদের জাতীয় পার্টি। তার যুক্তি, তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করে গণতন্ত্র রক্ষা করেছেন। তার অর্থ হচ্ছে, দীর্ঘ ৯ বছর বিরোধী দলগুলো যে তার কবল থেকে গণতন্ত্র উদ্ধার করার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম ও রক্ত দিয়েছে, তার কোনো মূল্যই নেই! এরশাদ এ কথা বলতেই পারেন। পরাজয় মেনে নেয়া কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। তারপরও গণতন্ত্র মুক্তি দিবস হিসেবে দিবসটি পালন করা হতো। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে এবং রাজনীতির কূটকৌশলের কারণে দিবসটি দলমত নির্বিশেষে পালনের কথা থাকলেও কেউ কেউ তা পালন থেকে নীরব থাকে। সময়ের বিবর্তনে অনেক কিছুই বদলে যায়। শত্রুও কখনো কখনো আপন হয়ে ওঠে স্বার্থের কারণে তাকে কোলে তুলে নিতেও দ্বিধা করা হয় না। এর ফলে শত্রুর কৃতকর্ম এবং তার প্রতিবাদকারী ও সংগ্রামীদের রক্ত-ঘাম অদৃশ্য হয়ে পড়ে। স্বৈরাচারকে পরাজিত করার দিবসটিও তুচ্ছ হয়ে যায়। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, গণতন্ত্র হত্যা করে যে ব্যক্তি দীর্ঘ ৯ বছর দেশ শাসন করলেন, বহু নির্যাতন করলেন, স্বৈরাচার হিসেবে পরিচিতি পেলেন, তিনি এখন ক্ষমতার অংশীদার! তার বিচার হওয়া দূরে থাক, এখন তিনিই হয়ে উঠেছেন গণতন্ত্রের অন্যতম সবকদার এবং ক্ষমতায় যাওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। ৬ ডিসেম্বর তারিখটি এখন এরশাদের দলের কাছে গণতন্ত্র রক্ষা দিবস হিসেবে পরিগণিত। অন্যদিকে যারা আপস করতে পারেনি, তারা এখনও দিবসটিকে গণতন্ত্র হত্যা দিবস বা স্বৈরাচার পতন দিবস হিসেবে পালন করে। যারা আপস করেছে, তারা নিশ্চুপ থাকছে। এই যে স্বাধীন বাংলাদেশে দীর্ঘ ৯টি বছর স্বৈরশাসনের কবল থেকে মুক্ত হয়ে গণতন্ত্র মুক্তির তারিখ ৬ ডিসেম্বর চলে গেল, তা কি দেশের মানুষ খুব একটা জেনেছে বা তাদের জানানোর মতো কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়েছে? হয়নি।
দুই.
স্বাধীন বাংলাদেশে গণতন্ত্র পদে পদে হোঁচট খাবে, তা জনগণ কল্পনা না করলেও বারবার তাই ঘটেছে। সর্বশেষ ২০১৪ সালের নব্য সংস্করণ হিসেবে ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র নতুন করে হোঁচট খেয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। নির্বাচন বর্জনকারী দলগুলো এ দিবসটিকে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে আখ্যায়িত করছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দল ও তার জোট ‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’ হিসেবে মনে করে এবং পালনও করে। দিবসটি নিয়ে কে সঠিক আর কে বেঠিক, তা নিয়ে বিতর্ক চলছে, ভবিষ্যতেও চলবে। তবে এ কথা ঠিক, নির্মোহভাবে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে বিশ্লেষণ করলে, তা যে গণতান্ত্রিক রীতিনীতির পরিপন্থী ছিল, তা তো সন্দেহের অবকাশ নেই। যে নির্বাচনে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য ১৫১ আসন প্রয়োজন, সে জায়গায় ১৫৩ আসন বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়ে যায়, তা কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক তত্ত্বে পড়ে না। গণতন্ত্রের স্বাভাবিক নিয়ম হচ্ছে, অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে ভোটারদের স্বতঃস্ফূর্ত ও প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হওয়া। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে যে এর ব্যত্যয় ঘটেছে, তা সকলেই একবাক্যে বলবেন। এ নির্বাচন নিয়ে সংবিধান ও গণতান্ত্রিক ধারাকে মুখোমুখি করা হয়। সংবিধান আগে না গণতন্ত্র আগেÑ এমন একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ক্ষমতাসীন দল সংবিধানকেই প্রায়োরিটি দেয়। এটা এক অর্থে সঠিক হলেও গণতান্ত্রিক রীতিনীতি অনুযায়ী সঠিক নয়। সঠিক হতো সংবিধান ও গণতন্ত্রকে একসঙ্গে প্রতিপালন করা হলে। সেটাই হতো গণতন্ত্রের প্রতি সুবিচার। গণতন্ত্রকে খ--বিখ- করে বা আধাখেচড়াভাবে উপস্থাপন করা অনেকটা উপহাসের শামিল। একে গণতন্ত্রের ‘বিকৃতি’ও বলা হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, গণতন্ত্র ছাড়া কি কোনো দেশ চলে না? নিশ্চয়ই চলে। তবে তা পরিষ্কারভাবে বলতে হয়। বলতে হয়, গণতান্ত্রিকভাবে দেশ পরিচালনা করা হবে না বা হচ্ছে না। আমাদের দেশেও এমন নজির রয়েছে। আমরা গণতন্ত্রহীনভাবে এরশাদের স্বৈরতন্ত্রের শাসন দেখেছি। তখনও দেশ চলেছে। বিষয়টি হচ্ছে জনগণের মানা, না মানা নিয়ে। জনগণ যদি মানে, তবে এ নিয়ে কোনো তর্ক চলে না। যাদের এ ধরনের শাসন ব্যবস্থা পছন্দ হবে না, তারা হয় চুপ করে থাকবে, নতুবা গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে মরিয়া হয়ে আন্দোলন করবে। পছন্দ হলে তো কথাই নেই। যদি এমন হয়, গণতন্ত্রের নামে বা তার মোড়কে দেশ পরিচালিত হচ্ছে, তবে তা জনগণের সাথে চূড়ান্ত চাতুরি ছাড়া কিছুই নয়। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের প্রেক্ষাপট যদি বিবেচনা করা হয়, বলতে হবে, এ নির্বাচন যে দাবি নিয়ে যেসব দল বর্জন করেছে এবং প্রতিহত করার আন্দোলন করেছে, তা সফল হয়নি। তারা নির্বাচনও প্রতিহত করতে পারেনি আবার আন্দোলনেও সফল হয়নি, উভয় ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছে। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, এ নির্বাচনে সে সময়ের প্রধান বিরোধী দলসহ নিবন্ধিত ৪০টি দলের মধ্যে ২৮টি দল অংশগ্রহণ করেনি। মাত্র ১২টি দল অংশগ্রহণ করেছিল। নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করা বিরোধী দলের মধ্যে ভয়াবহ আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে মাত্র প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও তার জোটের একটি দল। বাকি যে ২৮টি দল ছিল তারা কেবল নির্বাচন বর্জন করেই বসেছিল, আন্দোলন দূরে থাক, একটি মিছিলও করেনি। ফলে ক্ষমতাসীন দলের সব রোষ গিয়ে পড়ে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও তার জোটের ওপর। আন্দোলনে গুম, খুন, গুলি, নিপীড়ন, নির্যাতনের বেশি শিকারও হয় এ দল এবং তার জোট মিত্রদের এখনও তাদের সেই রেশ টেনে চলতে হচ্ছে। পরিতাপের বিষয়, বিএনপি ও তার জোট বাদে অন্য যেসব দল নির্বাচন বর্জন করেছিল তারা বেশ সহিসালামতে রয়েছে। তাদের ওপর ফুলের টোকাও পড়েনি। জেল-জুলুম তো পরের কথা। বরং তারা বেশ গলা চড়িয়ে টিভি টকশোতে বড় বড় কথা বলে চলেছে। এমনকি বিএনপির সমালোচনা ও তুলাধোনা করতেও ছাড়ছে না। অথচ তারাও নির্বাচন বর্জন করেছিল। তাদের তো উচিত ছিল আন্দোলন করতে না পারুক, অন্তত লিপ সার্ভিস দিয়ে প্রতিবাদ অব্যাহত রাখা। নির্বাচনটি যে গ্রহণযোগ্য হয়নি, তার বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টির মতো কর্মসূচি দেয়া। নিদেনপক্ষে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন কেন তারা বর্জন করেছিল, তার ক্রমাগত ব্যাখ্যা জনগণের সামনে তুলে ধরা এবং এ দিবসটি পালনে কর্মসূচি নেয়া। কেবল বিএনপি ও তার জোটকেই কেন দিবসটি পালন করতে হবে? ৫ জানুয়ারি নির্বাচন বর্জন করে প্রকারান্তরে তারাও কি বিএনপির বর্জনের সিদ্ধান্তের সাথে একমত হয়নি? একমত না হয়ে বর্জন না করলেও তাদের যুক্তি অনুযায়ী বর্জনের কারণ তুলে ধরে কি দিবসটি পালন করা উচিত নয়?
তিন.
ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে ‘উইনার টেকস অল’। অন্যভাবে বলা যায়, ইতিহাস বিজয়ীকেই মনে রাখে। তবে যে বিজয় ন্যায়সঙ্গত ও নৈতিকভাবে হয় না, তা আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন জনগণের মধ্যে বিষময় বিজয় হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে থাকে। তা না হলে যে হিটলার জার্মানির হয়ে প্রায় পুরো ইউরোপ বিজয় করে ফেলেছিলেন, তিনি জার্মানদের কাছে আজ পূজনীয় হয়ে থাকতেন। তার পরিবর্তে জার্মান জাতি তাকে ঘৃণার চোখেই দেখে। তাকে নিয়ে জাতীয়ভাবে কোনো আয়োজন করা হয় না। অথচ হিটলার যা করেছিলেন, তা জার্মানির হয়েই করেছিলেন, সেটা যত অন্যায়ভাবেই হোক। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল যেভাবেই হোক তার বিজয় সুসংহত করেছে। তবে এ বিজয় নিয়ে দলের লোকজনের মধ্যে সে সময় কিছুটা হলেও আত্মগ্লানি পরিলক্ষিত হয়েছিল। কারণ যে দল দীর্ঘদিন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করেছে, সে দলের এমন বিজয় সচেতন মানুষ আশা করেনি। ফলে সে সময় দলটির এ মনোভাব দেখা গেছে, অল্প সময়ের মধ্যেই সবার অংশগ্রহণে আরেকটি নির্বাচন দেয়ার। ‘টাইম ইজ দ্য বেস্ট হিলার’ বা সময় বড় উপশমকারী। সময় যতই গড়িয়েছে, ক্ষমতাসীন দলের গ্লানির বিষয়টি ততই অপসৃত হয়েছে। ঘটনা যত খারাপ হোক একসময় তা গা-সহা হয়ে যায়। ৫ জানুয়ারির লজ্জাজনক নির্বাচনটিও সময়ের সাথে সাথে সরকার এবং তাদের সমর্থকদের গা-সহা হয়ে গেছে। আত্মগ্লানি বা অসম্মানজনক যত বড়ই হোক, তা তারা হজম করে পাল্টা যুক্তি দেয়া শুরু করে। আত্মসম্মানবোধ নয়, ক্ষমতাবোধই তাদের কাছে মুখ্য হয়ে ওঠে। এ মনোভাবই এখন পর্যন্ত টিকিয়ে রেখেছে। কখনো কখনো দাম্ভিকতাও প্রকাশ করছে। ক্ষমতা তাদের হাতে, কাজেই যেভাবে ছড়ি ঘুরাবে সেভাবেই সবকিছু ঘুরবেÑ এ নীতি অবলম্বনের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিএনপি ৫ জানুয়ারি উপলক্ষে প্রতিবাদস্বরূপ তার রাজনৈতিক কর্মসূচি গতবারের মতো এবারও ঘোষণা করে। কর্মসূচির মধ্যে ছিল, সারা দেশে মহানগর-জেলায় কালো পতাকা মিছিল ও কালো ব্যাজ ধারণ এবং ৭ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করা। এখন গণতন্ত্র বিজয় দিবসের নামে ক্ষমতাসীন দল স্পষ্ট করেই বলে দেয়, রাজপথে বিএনপিকে কোনো কর্মসূচি পালন করতে দেয়া হবে না। জনগণ তা করতে দেবে না। বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে, জনগণের ভোটে যে সরকার নির্বাচিত হয়নি, সে সরকার এখন জনগণের কথা বলছে। এর জবাবে বিএনপি বলেছে, তারাও জনগণকে সাথে নিয়ে এ কর্মসূচি পালন করবে। তাহলে কী দাঁড়াল? জনগণ ভার্সেস জনগণ হয়ে গেল। জনগণের মধ্যে একটি গোলমাল সৃষ্টির প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে উঠল। যে জনগণ ভোট দিতে পারল না বা ভোট দিতে যায়নি, সে জনগণ তো প্রকারান্তরে বিরোধী দলের নির্বাচন বর্জনকেই সমর্থন দিয়েছিল। তাহলে জনগণ কার পক্ষে আছে বা নেই, তা বোধকরি পাঠকদের বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না। আর জনগণ কার পক্ষে আছে কি নেই, তা বোঝার জন্য সরকার ও বিরোধী দলের কর্মসূচি সমান অধিকারে পালন করতে দিলেই তো স্পষ্ট হয়ে যাবে। সরকারের এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে অসুবিধা কোথায়? বলাবাহুল্য, সরকার তা করতে দেবে না জনগণের ভয়েই। কারণ ব্যাপক জনগণ যদি বিরোধী দলের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে ফেলে, তবে তার দুর্বলতা প্রকাশ হয়ে পড়বে। এই ভয়েই সরকার বিএনপিকে তার স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকা- হিসেবে সভা-সমাবেশ করার অনুমতি দিতে চায় না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে বা জনগণ করতে দেবে না বলে অজুহাত দেখাচ্ছে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর সরকার বিএনপিকে বিন্দুমাত্র ছাড় না দেয়ার এক ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে। বিএনপি যে একটি রাজনৈতিক দল, তা স্বীকার না করে প্রান্তিক পর্যায়ে ঠেলে দিতে চাইছে। এ ধরনের মনোভাব গণতান্ত্রিক তো নয়ই, স্বৈরতন্ত্রেরই নামান্তর। অথচ আজকের ক্ষমতাসীন দল বহু আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। ’৯৬ সালে নির্বাচন প্রতিহতের নামে ভয়াবহ জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন করেছে। তারপর কি তারা স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করেনি? তাদেরকে কি স্বাধীন দেশে বিএনপির মতো কখনো ঘরবন্দি অবস্থায় থাকতে হয়েছে? দলটি বলতে পারে, জনগণ তাদের সাথে ছিল বলে এবং তাদের আন্দোলনে সাড়া দিয়েছে বলে ঘরবন্দি থাকতে হয়নি। যদি এ কথা বলা হয়, এ সময়ের সরকারের মতো সে সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটার অজুহাতে সরকার তাদের ঘরবন্দি করে রাখার মতো পদক্ষেপ নিত, তবে কি তারা বের হতে পারত? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দলীয় বাহিনীতে পরিণত করে এবং তা ব্যবহার করলে কি তাদের পক্ষে আন্দোলন করা সম্ভব হতো? তাদের কি মিছিল নিয়ে রাস্তায় নামামাত্র টিয়ার শেল বা লাঠিপেটা নয়, গুলির মুখোমুখি হতে হয়েছিল? মিছিল-মিটিং, সমাবেশ করার মতো রাজনৈতিক অধিকার কি কেড়ে নেয়া হয়েছিল? রাজনৈতিক দলই নয় বলে কি অস্বীকার করার প্রবণতা ছিল? ছিল না। এখন তো প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ক্ষেত্রে এর সবই প্রয়োগ করা হচ্ছে।
চার.
যে দলটি তিন-তিনবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছে এবং সংসদে ইতিহাসের বৃহত্তম বিরোধী দল হিসেবে ছিল, সে দলটিকে এখন অস্বীকার করার প্রবণতা বেশ পরিলক্ষিত হচ্ছে। অনেকে বলেন, বিএনপির আন্দোলন-সংগ্রাম করার মুরোদ নেই, দলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে, কোমর ভেঙে গেছে, নেতা-কর্মীরাও সাড়া দেয় না ইত্যাদি। তারা এটা ভাবেন না, যখন একটি এলাকার ওপর দিয়ে ঘূর্ণিঝড় বা টর্নেডো অতিক্রম করে, তখন কোনো কিছুই ঠিক থাকে না। সব তছনছ হয়ে যায়। টর্নেডোর সময় তো গভীর নলকূপ পর্যন্ত উঠে গিয়ে গাছের সাথে পেঁচিয়ে থাকে। এমন শক্তিধর প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার কোনো পদ্ধতি আজ পর্যন্ত মানুষ আবিষ্কার করতে পারেনি। আর যখন রাষ্ট্রশক্তি তার অপছন্দের কোনো গোষ্ঠীর ওপর অপবাদ দিয়ে চড়াও হয়, তখনও কোনো শক্তি তা প্রতিহত করতে পারে না। বিএনপির জায়গায় যদি অন্য কোনো শক্তিধর দল থাকত এবং এমন ঝড় বইয়ে দেয়া হতো, তখনও তার অবস্থা এমনই হতো। এ বিষয়টি অনেকেই চিন্তা করেন না। অর্থাৎ সরকার যদি তার প্রতিপক্ষকে উঠতে-বসতে নির্মূল করতে চায়, তবে সে শক্তির টিকে থাকা কঠিন। বিএনপির অবস্থাও হয়েছে তেমন। বলার অপেক্ষা রাখে না, গণতন্ত্রের লেবাসে থাকা কোনো কোনো সরকারের আচরণ স্বৈরাচারের আচরণকেও হার মানায়। সরকার মুখে যতই গণতন্ত্রের কথা বলুক না কেন, প্রতিপক্ষের প্রতি তার আচরণ দেখেই বোঝা যায়, সে কোন ধরনের সরকার। গণতান্ত্রিক হলে সরকারের যতই অপছন্দ হোক, বিরোধী দলের কর্মসূচি পালন করতে দেবে। দেখা যাচ্ছে, বিএনপি ৫ জানুয়ারি দিবসটিকে তার মতো করে পালন করতে চাইলেও ক্ষমতাসীন দল একবাক্যে বলে দিয়েছে তা করতে দেবে না। এটা অনেকটা জোর যার মুল্লুক তার-এর মতো হয়ে গেছে। কারো মুল্লুকে কেউ অন্য কাউকে প্রবেশ করতে না-ই দিতে পারে। তবে মুল্লুক যদি সবার হয়, তবে যে কারো শান্তিপূর্ণ কর্মকা- পালন করা তার অধিকার। এ কর্মকা- সুশৃঙ্খলভাবে করতে দেয়া মুল্লুক পরিচালকের দায়িত্ব। এখন মুল্লুকের পরিচালক যদি বলে, এখানে কাউকে কর্মকা- করতে দেয়া হবে, কাউকে দেয়া হবে নাÑ তবে কি তা সমান আচরণ হলো? সচেতন মানুষ মাত্রই বলবে, এটা স্বেচ্ছাচারী মনোভাব ছাড়া কিছু নয়। একটি রাজনৈতিক দল তার কর্মসূচি পালন করবে, জনগণ গ্রহণ করবে কী করবে না, তা জনগণের ওপর ছেড়ে দেয়াই গণতান্ত্রিক আচরণ। এক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের বাধা দেয়ার কী আছে? বিএনপিকে যদি তার স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে না-ই দেয়া হয়, তবে দলটি কী করবে? সরকারই বা দলটিকে নিয়ে কী করতে চায়? এসব প্রশ্নের জবাব তো জনগণকে স্পষ্ট করে দিতে হবে। কেবল আচরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিলেই তো হবে না। কারণ বিএনপির মতো একটি দল কোনো খেলার পুতুল নয়, যে যেমন খুশি তেমন খেলবে। বাস্তবতা হচ্ছে, বিএনপি এবং তার মতো কোনো দলকে নিঃশেষ করে দেয়া কোনোকালেই সম্ভব নয়। এ বাস্তবতা মানতে হবে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।