শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
মালদ্বীপ আমি যাকে বলছি প্রবাল মুক্তোর দেশ,এক সময় শুনেছি এটা হচ্ছে ‘কালাপানির’ দেশ। বৃটিশ্ উপনিবেশ স্থাপনকারী শাসকরা স্বাধীনতা আন্দোলন ও অন্যায়ের প্রতিবাদকারী দেশপ্রেমী কথিত বিদ্রোহীদেরকে এই মহাসমুদ্রে ভাসমান দ্বীপ বা কালাপানিতে নির্বাসন দিত। আন্দামান-নিকোবর আইল্যান্ডের সেলুলার জেলের কথা আমরা জানি– আমাদের স্বাধীনতার অনেক অনেক সংগ্রাম,অনেক অশ্রু,অনেক বেদনার সাক্ষী। কিন্তু মালদ্বীপের এই কালাপানিও যে এক ধরনের সেলুলার জেল-ই ছিল তার খবর আমাদের প্রায় অজানা। সে-সব ইতিহাসবিদগণ খুঁজে বার করবেন। মালদ্বীপ যে ‘কালাপানি’ এ-কথা আমাকে বলেছেন মালে শহর থেকে আশি-নব্বই কিলোমিটার দূরের হালাভেলি (ঐধষধাবষু) আইল্যান্ড রিসোর্টের এক বয়স্ক বাঙলি শ্রমিক যাঁর বাড়ি চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার ভরাঢোল গ্রামে। ভদ্রলোকের ভাষায়– ‘ধুর হালারা জংলী কচ্ছপের জাত!’
মালে এয়ারপোর্ট মূলতঃ আর কিছুই না– একটা ছোটখাটো আস্ত দ্বীপকেই প্রচণ্ড সমুদ্র গর্জনের মাঝে কংক্রিটের ঢালাই বেঁধে বিমান অবতরণের উপযোগী করে বানানো হয়েছে। এখান থেকে মূল মালে সিটিতে যেতে হয় স্পীডবোট,ইঞ্জিনচালিত নৌকা বা ‘ধোনী’-তে করে। সুতরাং এয়ারপোর্ট দেখার সময় আমাদের নাই। আমরা অধীর এবং কিছুটা অস্থিরও– কখন মালে শহরে যাবো। আগে থেকেই পত্র-পত্রিকার পাতায় দেখা সোনালী- ‘স্বর্ণচূড়’ জাতীয় মসজিদের গম্বুজটি দেখে মালে শহরের আইকনিক চিহ্নটি এখন চোখের সামনেই জ্বলজ্বল করছে। এই বিশেষ মসজিদটির ছবি দিয়ে বাংলাদেশের আজাদ প্রোডাক্টস নানা রকম কার্ড-ক্যালেন্ডার তৈরি করেছে। বায়তুল মোকাররমের কাছে সে-সব আগেই অনেক দেখেছি; যদিও সেগুলোর মান খুব একটা উন্নত ছিল না।
ইমেগ্রেশনে তেমন ঝামেলা হল না। প্রথমে একটি লাইন ধরে আগত যাত্রীদের আঙ্গুল থেকে কুট করে একফোঁটা রক্ত কাঁচের স্লাইডে নিয়ে নিল। সম্ভবতঃ এইডস বা ওই জাতীয় কোনো রোগ আছে কি-না তা পরীক্ষা করার জন্য। যখনকার কথা বলছি,তখন কোভিড-১৯ বলে পৃথিবীতে কোনো শব্দের সাথে আমাদের সাধারণ মানুষের কোনো পরিচয় ছিল না। ওরা এইডসের-এর পরীক্ষা করছে,তা করুক গে! ইমেগ্রেশন অফিসারগুলোকে দেখে আমি আর বাসুদেব চট্টোপাধ্যায় নীরবে হেসে যাচ্ছি – এরা যে একেকটা লিলিপুট- এমনই পুঁচকে! পরে জেনেছি,দেখেছিও– এদেশের মানুষের আকার-আকৃতিই এমন– পুঁচকে,দেখতে বাচ্চা বাচ্চা ‘এক কইর্যা’(আঙ্গুলের করাকৃতি!) না । এক পুঁচকে অফিসার আমার হ্যান্ডব্যাগ ভারী মনে করে সন্দেহবশতঃ দেখতে চাইল। কলকাতা থেকে আনা সানন্দা-দেশ পত্রিকা ছাড়া বিশেষ কিছু পেল না। সানন্দা হাতে নিয়ে সেই অফিসার গভীর মনোযোগে বাংলাভাষা পাঠ করছিল! কিন্তু বিশেষ কিছু অনুধাবন করতে না পেরে আবার আমাকে ফেরৎ দিয়ে দিল। সে দৃশ্য মনোরম। স্মরণ করা যেতে পারে– সানন্দায় আমাজন অরণ্যের আদিম নর-নারীদের উপর একটি গবেষণা-নিবন্ধের সঙ্গে কিছু প্রায়োলঙ্গ ছবিও সংযুক্ত ছিল। ওসব ছবির জন্য আবার এদেশে এ্যারেস্ট হওয়ার নিয়ম আছে কি-না কে জানে! তবে আমাকে এ্যারেস্ট করা হল না দেখে স্বস্তি পেলাম।
ইমেগ্রেশনে ১৫০ মার্কিন ডলার শো করলেই মিলে যায় ভিসা! নিয়মটা ভালো লেগেছে। এ নিয়ম এখনও আছে কি-না জানি না। পাসপোর্টে ভিসা স্টিকার লাগার পর, কাঠের ধোনী নৌকায় চেপে প্রচণ্ড ঢেউয়ে ভেসে মাথা-ঘোরানো অবস্থায় নামলাম মালেতে। দেখতে কাছে মনে হলেও,মহাসাগর পেরিয়ে মালেতে পৌঁছতে লাগলো প্রায় চল্লিশ মিনিট। সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল জাগাঙ্গীর হোসেন– আমাদের পূর্ব পরিচিত- সে দু’চারটা দালালী টালালী করে দিবাহী রুপি (মালদ্বীপের মুদ্রার নাম),ডলার-টলার কামায়– এটা শোনা কথা। সে যা-ই হোক, বিদেশ-বিভুঁই-য়ে নিজের দেশের মানুষ পাওয়া যে কী- এটা তারাই বুঝবেন যাঁরা সেই আত্মার আত্মীয় বা ভাষা-তৃষ্ণায় ভুগেছেন কখনও সখনও- নির্জনে,অভিবাসী বা পরিযায়ী ভ্রমণে। সুতরাং মালেতে একজন বাঙালি দেখে এবং পেয়ে আমাদের প্রাণ শীতল হল। আমারা একটি দেশী ‘কাউয়া’ দেখে যারপরনাই খুশি হলাম। তবে দেশী কাউয়াটি কা কা কম করে- স্বলভাষী।
আমাদের ছোট্ট রেন্টাল গাড়িটি বেশ কয়েকটি সুচারু সড়ক পার হয়ে একটি ওয়াচ-টাওয়ারের নিকট থামলো। লক্ষ্য করছি– সড়কের দুপাশের দোকানগুলো সাইনবোর্ডে ও শহর কর্তৃপক্ষের লাগানো চিহ্নে লেখা– ঈযধহফযড়হর গধমঁ, কধৎবহশধ গধমঁ,উরৎধমড় গধমঁ– ‘গধমঁ’ তার মানে হচ্ছে রোড বা সড়ক। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো আমি সংখ্যা গণনা শিখছি না,শিখছি দিবাহী বা মালদ্বীপের ভাষা! যেহেতু আমরা খুব ক্ষুধার্ত– জাহাঙ্গীরের সহায়তায় গেস্টহাউজে লাগেজ-ব্যাগ রেখে দিলাম ছুট– দিবাহী-মালদিভিয়ান খাবার আস্বাদনে।
হোটেলে পাওয়া গেল ‘ভাজিয়া’– আমাদের দেশের সমুচার মতো এক বিশেষ পদ,ভাত– যাকে এরা বলে ৎড়ংযর,আর মাছের তরকারি,গরুর মাংস– যাকে এরা বলে গেরুমাছ এবৎঁসধপয– আমার উচ্চারণ সঠিক কি-না জানি না,তবে এমনই শুনতে-গেরুমাছ! আর কুক্কুড়ু– কঁশশঁৎঁ যাহাকে আমাদের ভাষায় বলি মুরগি!
ভাজিয়া,ভাত আর গেরুমাছ খেয়ে নিয়ে,দারুণ এককাপ রঙ চা খেলাম। এরা রঙ চা-ই খায়। চায়ের এমন উজ্জ্বল রঙ আমি আর কোথায়ও দেখিনি। কিন্তু ভাতে ও ভাজিয়াতে এরা কি মিশিয়েছে– কে জানে,আমরা যে-ক’জন নতুন গেলাম এবং খেলাম সবারই পেট ভুটভুট পুটপুট শুরু হয়ে মহাপ্রলয় শুরু হয়ে গেছে। গেস্টরুমে ঢুকে আমরা বিছনানায় নয়,আশ্রয় নিলাম বাথরুমে! সেখানে,মহা দুর্গন্ধযুক্ত ভাজিয়া আর গেরুমাছের ঝোল বের হচ্ছে! পরে দেখেছি,এরা তরকারি ও ভাতে এক বিশেষ ধরনের কারিপাতা ব্যবহার করে যার গন্ধ আমাদের দেশের গন্ধভেদুলি পাতার দুর্গন্ধের মতো এবং এটা আমাদের পেট কাহিল করে দিয়েছে। পরে অবশ্য অন্য সকলের মতোই অভ্যস্থ হতে সময় লাগেনি। কারণ ওদের রান্না করা ‘গারুধিয়া’ তো আমার দারুণ লেগেছে। ‘গারুধিয়া’ অতি জনপ্রিয় খাবার এখানে– অতি সাধারণ– এর রন্ধন প্রণালী। সামুদ্রিক ট্যুনা জাতীয় মাছকে শুধু মাত্র পানি,লবণ দিয়ে সেদ্ধ করা তরকারি। সঙ্গে একটু লেবু,কিছু পিঁয়াজ-কুঁচি,কাঁচা মরিচ আর কারিপাতার ডেকোরেশন। এঁদের বিয়ে-শাদি,ছেলে শিশুদের মুসলমানী বা ঈদে,জাতীয় অনুষ্ঠানে– গারুধিয়া বা “গাড়ু” সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার। পরিবেশিত হয় ট্রেডিশনাল ভাতের সঙ্গে। সে যা-ই হোক,কারিপাতার গন্ধে আমাদের যখন টয়লেট আর বেডরুমে কুস্তিদৌড়,তখন আগে থেকে এসব জংলী খাবারে অভ্যস্থ– মি.জাহাঙ্গীর হোসেন সরু গোঁফের তল দিয়ে তার নাদুস নুদুস ভোটকা ফোটকা গালটি ব্যাদান করে হাসছে!
গেস্টহাউজ ভরা ইন্ডিয়ান আর লংকান চাষা-টাইপ গেস্ট-এ। পরে জেনেছি উহারা নিজ নিজ দেশ থেকে নানান সব্জি ও মশলা– কাঁচা মরিচ,লেবু,লবঙ্গ,দারুচিনি,এলাচি,হলুদ বা লুংগি জাতীয় সুতিপণ্য কেরালার তিরুভুরুপুরম বা শ্রীলঙ্কার কলম্বো থেকে অর্ধনগ্ন পোষাক তাঁদের- প্লেনে উড়াল দিয়ে মালেতে আসে। বেচা-বিক্রি শেষে আবার প্লেনে করেই চলে যায়। অনেকটা আমাদের শনি-রবি-মঙ্গলবারে সাপ্তাহিক হাঁটের মতোই!
আমার দেশের কৃষক-চাষারা প্লেনে করে উড়তে পারে না। এঁদের সৌভাগ্য-বিলাস দেখে মনে মনে কিঞ্চিৎ মন খারাপ হতেই পারে আমার। আরও একটা কারণে মন খারাপ হয়েছে– সেটা হল এই কালাপানির দেশেও আমার দেশের টগবগে যুকবরা দেশে জমি-জমা বিক্রি করে কালাপানির দেশে এসে,মহাসমুদ্রে এবং প্রায় কারাগারতুল্য বিচ্ছিন্ন ‘শঙ্খনীল দ্বীপে’ সাধারণ শ্রমিকের কাজ করছে। কেউ কেউ বৈধ,বেশির ভাগই দালালবাহিত অবৈধ! (চলবে..)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।