Inqilab Logo

রোববার ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ১৮ কার্তিক ১৪৩১, ৩০ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনার সাথে জড়িতদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে

রিন্টু আনোয়ার | প্রকাশের সময় : ১২ অক্টোবর, ২০২২, ১২:০০ এএম

একদিকে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি অন্যদিকে হু হু করে বাড়ছে প্রতিটি পণ্যের দাম। বাজারে চাল, ডাল, পেঁয়াজ, চিনি, আটা, আদা, রসুন, এলাচ, শুকনা মরিচ, ভোজ্যতেলসহ প্রায় প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে। মৌসুমে সব ধরনের সবজির সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেও দাম চাড়া। এতে ভোক্তাদের দুর্ভোগ দিন দিন বাড়ছে। তারা বলছে, বাজারে খাদ্যপণ্য পাওয়া গেলেও চাহিদা অনুযায়ী কিনতে পারছে না। দাম অনেক বেশি।

বাজার তদারকি করার যেসব সংস্থা রয়েছে তারা কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না। তারা দেখেও না দেখার ভান করছে। কেন তারা দাম কমাতে পদক্ষেপ নিচ্ছে না? কেনই বা তারা দর্শকের ভ‚মিকা পালন করছে? এসব প্রশ্নের উত্তর নেই। প্রতিদিন সাধারণ মানুষকে খাবার কিনতে বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে। ব্যয় সামলাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, চালের দাম আর বাড়বে না, মন্ত্রীর এমন আশ্বাসের পরই বেড়ে যায় চালের দাম। তেল, ডাল, ডিমসহ প্রায় সব নিত্যপণ্য নিয়েও একই পরিস্থিতি। গত কয়েক বছরে মানুষও এখন বুঝে গেছে, মন্ত্রী বা সরকারি উচ্চপর্যায় থেকে কোনো কিছুর দাম কমার আশ্বাস বা সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি মানেই নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির আগাম বার্তা।

দ্রব্যমূল্য নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর আশ্বাসের প্রভাব এখন পড়েছে শিক্ষা ব্যবস্থা তথা পাবলিক পরীক্ষায়। কিছু দিন ধরে শিক্ষামন্ত্রী প্রশ্নফাঁস না হওায়া নিয়ে বেশ গর্ব করছিলেন। বলছিলেন, এখন আর প্রশ্নফাঁস হয় না। তারপরও কেউ প্রশ্ন ফাঁস করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তার হুঁশিয়ারির পর বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। এক-দুটি নয়, স¤প্রতি শেষ হওয়া এসএসসি পরীক্ষায় ফাঁস হয়েছে ৬টি বিষয়ের প্রশ্ন। ঘটনাকে ‘বিচ্ছিন্ন’ বলে চালিয়ে দেয়া হয়েছে। একে মোটেই বিচ্ছিন্নতার মধ্যে ফেলা যায় না। এসএসসি পরীক্ষা মোটেই কোনো বিচ্ছিন্ন পরীক্ষা নয়। দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ড পাড়া-মহল্লার যেনতেন বিচ্ছিন্ন কোনো বোর্ড বা সভা নয়। দিনাজপুরে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের শেষ হওয়া এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা খুবই উদ্বেগজনক বার্তা দিয়েছে। ঘটনা ধরা পড়ার পর গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, কৃষিশিক্ষা ও রসায়নের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। একসঙ্গে ৬টি বিষয়ের প্রশ্নফাঁস রেকর্ড গড়া ঘটনা। একজন কেন্দ্রসচিবের একার পক্ষে কি এমন ঘটনা ঘটানো সম্ভব?

গত বছর কয়েক ধরে অবিরাম প্রশ্নফাঁস হচ্ছে। একদিকে বলা হচ্ছে, এ ব্যাপারে জিরো টলারেন্সের কথা, কাউকে ছাড় না দেওয়া, ধরা পড়লে কঠোর শাস্তির হুমকি, অন্যদিকে পাবলিক পরীক্ষার পাশাপাশি বিসিএস, মেডিক্যাল, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পর্যন্ত প্রশ্নফাঁসের ঘটনা ঘটছে। তা গড়িয়েছে ব্যাংকসহ বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায়ও। নার্স নিয়োগের পরীক্ষাও প্রশ্নফাঁসের কলঙ্ক থেকে বাদ পড়েনি। এসব পরীক্ষা পাবলিক পরীক্ষার সমত্য্যু।


মাঝেমধ্যে প্রশ্নফাঁস চক্রের হোতা ধরার খবর আসে। র‌্যাব, গোয়েন্দাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চাঞ্চল্যকর অভিযানে প্রশ্নফাঁসে জড়িতদের স¤পর্কে জানানো হয়। নানা ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রশ্নফাঁস কর্মটি ২-৪ জনের পক্ষে সম্ভব নয়। প্রশ্ন প্রণয়ন থেকে শুরু করে সরকারি প্রেসে ছাপা, কেন্দ্রে বিতরণ পর্যন্ত প্রত্যেক ধাপে রয়েছে অনেকের সংশ্লিষ্টতা। ঘটনাচক্রে কখনো কোনো ঘটনা ধরা পড়ে। কিন্তু প্রায়ই পুরো সত্য প্রকাশ না করে আংশিক প্রকাশ বা কাউকে রেহাই দিতে সত্য আড়াল হয়ে যাচ্ছে। এতে নেপথ্যের প্রশ্নফাঁসকারী চক্রের জন্য উৎসাহ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে ঘটছে প্রশ্নফাঁসের একটির পর আরেকটি ঘটনা। স্থানীয়, জাতীয় যেকোনো পর্যায়ে প্রশ্নফাঁস রোধের প্রধানত দায়িত্ব সরকারের। সেই দায়িত্ব না নিয়ে সবাইকে সচেতন হওয়ার আহŸান একেবারেই গৎবাঁধা বাতকেবাত কাজ। দায়িত্ব খেলাপও বলা যায়। এখন আর প্রশ্ন ফাঁস হয় না, কাউকে ক্ষমা করা হবে না, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে, এসব কথাবার্তা কথার কথায় পরিণত হয়েছে। এমনিতেই বিনাভোটে জয় ও বিনাপরীক্ষায় পাস করার বিষয়টি অনেকটা স্বাভাবিক করে ফেলা হয়েছে। সেইসঙ্গে সুষ্ঠু ভোটের ওয়াদা করে জালিয়াতি-কারচুপি, ন্যায্যমূল্যের আশ্বাসের পর দাম বাড়ানোর মতো প্রবণতা পরীক্ষার প্রশ্নপত্র নিয়েও শুরু হয়েছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে মামলা, কিছু ধরপাকড় আর গরম কথা মোটেই সমাধান নয়। দিনাজপুরের ঘটনায়ও ভুরুঙ্গামারী থানায় মামলা হয়েছে। কয়েকজন শিক্ষক-কর্মচারীকে ধরে জেলে পাঠানো হয়েছে। ভুল করে অন্য বিষয়ের প্রশ্ন পরীক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণের ঘটনাও ঘটেছে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট পরীক্ষা বাতিল করতে হয়েছে। এটা মোটেই সমাধান নয়।

স¤প্রতি শেষ হওয়া মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস প্রমাণের বহু খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন বোর্ডের অধীন কিছু কেন্দ্রে দেখাদেখির পরিবেশে পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। পরীক্ষার্থীর উত্তরপত্র শিক্ষকের লিখে দেওয়ার লজ্জাজনক খবরও পাওয়া গেছে। এমন একটি ঘটনায় পটুয়াখালীতে মামলাও হয়েছে। মাঝে কিছুদিন প্রশ্নফাঁস কিছুটা কমেছিল। এখন আবার কেন তা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেটি ভাবার মূল দায়িত্ব সরকারের। দায়িত্বের দ্বিতীয় অবস্থানে আছেন অভিভাবকরা। দুঃখজনকভাবে কোথাও কোথাও এ অনৈতিকতায় অভিভাবকদেরও জড়িয়ে পড়ার খবর মিলছে। ফাঁস হওয়া প্রশ্ন পেতে মা-বাবাও দৌড়ান। সন্তানও মা-বাবাকে দ্বিধাহীনভাবে বলছে, ফাঁস হওয়া প্রশ্ন যোগাড় করে দিতে। যে মা-বাবার সন্তানকে নৈতিকতা শিক্ষা দেবেন, তারাই সন্তানকে অনৈতিক সুবিধা দিতে কাজ করলে সমাজ নৈতিকতা শিখবে কিভাবে, কোত্থেকে? এ প্রবণতা জাতির জন্য চরম বিপজ্জনক।

প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি কেবল সরকার বা শিক্ষা মন্ত্রণালয় নয়, সবার জন্য ভাবনার। প্রশ্ন ফাঁসের কারণে একদিকে দুর্বল মেধার শিক্ষার্থীরা এগিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে প্রকৃত মেধাবিরা পিছিয়ে যাচ্ছে। প্রশ্নফাঁসের ঘটনার সঙ্গে আমাদের নৈতিক বিষয়টি জড়িত। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পরীক্ষার আগের রাতে মোটা অংকের টাকায় প্রশ্নপত্র কেনা-বেচা হয়। একটি অসাধু মহল ওইসব পরীক্ষা আয়োজনকারী কিংবা দায়িত্বপালনকারীদের সঙ্গে যোগসাজগে আগেই প্রশ্ন পেয়ে যায়। পরে সতর্কতার সঙ্গে চাকরি প্রার্থী কিংবা পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। কোনো কোনো সময় একটি নির্দিষ্ট স্থানে পরীক্ষার্থীদেরকে রেখে প্রশ্ন ও উত্তর দিয়ে দেওয়া হয়। চাকরি প্রার্থীরা ওই স্থানে রাতযাপন করে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন ও সমাধান থেকে প্রস্তুতি নিয়ে পরদিন পরীক্ষায় অংশ নেন। কখনো কখনো টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন সরাসরি নির্দিষ্ট কিছু পরীক্ষার্থীর হাতে পৌঁছে যায়। তাদের মধ্যে অনেকে সেই প্রশ্নের স্ক্যানড কপি মুঠোফোনে থাকা ইন্টারনেট ব্যবহার করে ফেসবুকে ছড়িয়ে দেন। পুরো বিষয়টি সমাজে অনৈতিকতার ভয়াবহতা ইঙ্গিত করে।

এসএসসি ও এইচএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষা এবং বিশ্ববিদ্যালয়, বিসিএস, ব্যাংকসহ বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় মামলা হলেও জড়িতদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করা যাচ্ছে না বলে জানায় কর্তৃপক্ষ। ২০০৯ সাল থেকে এই ১৪ বছরে ঢাকা মহানগর এলাকায় প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় হয়েছে দুই শতাধিক মামলা। তবে এগুলোর মধ্যে নি®পত্তি হয়েছে শুধু ৪৫টির। মাত্র একটি মামলায় এক আসামির অর্থদÐ হয়েছে ৫ হাজার টাকা। সংবাদমাধ্যমের তথ্যানুযায়ী, পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় বেশি জড়িত শিক্ষক ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা। সে জন্যই শিক্ষাসচিবের অসহায় উচ্চারণ, ‘কাকে বিশ্বাস করব?’ প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্বাস করার মতো মানুষকে তারা যথাস্থানে বসাচ্ছেন কিনা? বর্তমানে আমরা যে চর্চা দেখছি, তাতে অনেক সময় যোগ্য বিকল্প থাকা সত্তে¡ও অযোগ্যরা চেয়ারে বসছে। যখন যোগ্যদের বাদ দিয়ে অযোগ্যদের দায়িত্বশীল পদে বসানো হয়, তখন আক্ষেপ না করে সে মেকানিজমে পরিবর্তন আনা দরকার।

শিক্ষাকে রাজনৈতিক আর পরীক্ষাকে নির্বাচনের মতো বিষয়াদিতে মিলিয়ে ফেললে এর ভয়াবহতা দিন দিন আরও তীব্র হবে। প্রশ্ন ফাঁসের মতো ভয়াবহ অপরাধের সঙ্গে যাঁরা জড়িত তাদের কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া উচিত নয়। রাজনৈতিক বা অন্য কোনো প্রভাবশালী কেউ জড়িত থাকলেও যেন ছাড় না পায়। পুরো চক্রটিকে বিচারের আওতায় আনা জরুরি। এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া উচিত, যাতে দ্বিতীয়বার কেউ প্রশ্ন ফাঁস করতে সাহস না পায়।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: প্রশ্নপত্র


আরও
আরও পড়ুন