পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
নিজের জীবনকে নিজেই শেষ করে দেয়ার নিষ্ঠুর নিয়মকেই বলে আত্মহত্যা বা আত্মহনন। ইদানিং আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে আশঙ্কাজনকহারে। বিশেষ করে, তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ক্রমেই আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। এদের একটি বড় অংশ শিক্ষার্থী। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তো আছেই, বাদ নেই স্কুলের শিক্ষার্থীও। আঁচল ফাউন্ডেশনের এক তথ্য বলছে, চলতি বছরের প্রথম আট মাসে ৩৬৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। অর্থাৎ এ সময়ের মধ্যে প্রতিমাসে গড়ে ৪৫ জনের বেশি শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। আত্মহত্যাকারীদের ৫৩ শতাংশই স্কুলের শিক্ষার্থী, সংখ্যায় যা ১৯৪ জন। আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি দেখা গেছে ১৩ থেকে ২০ বছর বয়সীদের মধ্যে, শতকরা হারে যা ৭৮.৬ শতাংশ। এর মাঝে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছে ১৪ থেকে ১৬ বছর বয়সীরা, যার সংখ্যা ১৬০ জন। ২০২০ সালের জুন থেকে ২০২১ সালের জুলাই পর্যন্ত ১৩ মাসে গণমাধ্যমে ১৫১ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার খবর প্রকাশিত হয়েছিল। এ বছরের আট মাসে তা দ্বিগুণের বেশি।
একটি জাতি বা সমাজের জন্য আত্মহত্যা অনাকাক্সিক্ষত হলেও সা¤প্রতিক বছরগুলোতে যে হারে আত্মহত্যার সংখ্যা বাড়ছে, তা সত্যিই ভীতিজাগানিয়া। বিশেষ করে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার যে প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে তা রীতিমত ভাবিয়ে তুলছে। আত্মহত্যার এই উল্লম্ফন আমাদের ক্ষয়িষ্ণু সমাজের নিদারুণ প্রতিচ্ছবি। প্রযুক্তিনির্ভর সমাজে আমরা যে দিন দিন ধৈর্যহীন ও অসহিষ্ণু হয়ে জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে উঠছি, ক্রমবর্ধন আত্মহত্যা বৃদ্ধি সেটাই নির্দেশ করে। জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ মানুষের আত্মহননের পথ বেছে নেয়া সচারাচর নির্জলা স্বেচ্ছায় নয়। এর পেছনে আছে মনো-সামাজিক নানাবিধ কারণ। তবে অধিকাংশ আত্মহত্যার কারণ মানসিক। আর আত্মহত্যার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ মানসিক রোগটি হচ্ছে বিষণœতা। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিষণœতা রোগমুক্ত ব্যক্তির তুলনায় আক্রান্ত ব্যক্তির আত্মহত্যায় মৃত্যুঝুঁকি ২০ গুণ বেশি। এছাড়াও একাকিত্ব, বিবাহবিচ্ছেদ বা সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া, প্রিয়জনের মৃত্যু, শিক্ষা বা পেশাগত ক্ষেত্রে ব্যর্থতা, আর্থিক সংকট, ঋণগ্রস্ততা, বেকারত্ব, যেকোনো দ্ব›দ্ব, বীভৎসতা, দুর্যোগ, বিপর্যয়, ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি, বিয়েতে প্রত্যাখ্যাত, স্বামী পছন্দ না হওয়া, মাদকাসক্তি, দীর্ঘমেয়াদি বা ক্যান্সারের মতো দুরারোগ্য শারীরিক রোগ ইত্যাদি আত্মহত্যার জন্য দায়ী। শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার পিছনে আচঁল ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণে উঠে আসা কারণগুলোর মধ্যে পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া, পড়াশোনার চাপ, সেশনজট, অভিমান, প্রেম-ভালোবাসাঘটিত বিষয়, পরিবার থেকে কিছু চেয়ে না পাওয়া, পারিবারিক কলহ, চুরি বা মিথ্যা অপবাদ, মোটর বাইক কিনে না দেয়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
আমাদের অভিভাবকদের মধ্যে এখন অত্যুঙ্গ প্রত্যাশা। তারা সন্তানদের উপর চাপিয়ে দেন জিপিএ ফাইভ বা ভালো রেজাল্টের বাড়তি বোঝা। জিপিএ ফাইভ পাওয়াই যেন জীবনের সফলতার মূল কথা। সন্তানরাও তাই যতটা না নিজের জন্য তার চেয়ে বেশি বাবা-মার প্রত্যাশা পূরণে ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্লাসে ফার্স্ট হতে, জিপিএ ফাইভ অর্জনে। আর এটা করবেই না বা কেন। যেখানে জিপিএ ফাইভ মেধার মূল্যায়নের অন্যতম মাপকাঠি হয়ে দাঁড়ায়, বুয়েট, মেডিকেল কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার অন্যতম নিয়ামক হিসেবে গণ্য হয়, সেখানে শিক্ষার্থীরা তো মরণপণ চেষ্টা করবেই। তা সে পারুক বা না পারুক। কিন্তু বাস্তবতা হলো অনেকে সেই কাক্সিক্ষত ফল অর্জন করতে পারে না। তখন নিজের এই অকৃতকার্য হওয়াকে জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা মনে করে সে। ব্যর্থতার এই গøানি থেকে মুক্তির চটজলদি সমাধান হিসেবে আত্মহত্যাকেই তার কাছে শ্রেয় মনে হয়। আমাদের ধারণা, বর্তমান সময়ে খুব কম অভিভাবকই চান তাদের সন্তান মানবিক মানুষ হোক; বাস্তবতার নিরিখে শিখুক, জানুক। জিপিএ ফাইভ পাওয়াই যে সফলতার একমাত্র মূলমন্ত্র নয়, আমাদের অভিভাবকরা তা মানতে নারাজ। ভালো রেজাল্টের চেয়েও যে আদর্শ ও নৈতিকতাবোধসম্পন্ন মানুষ হওয়া জরুরি, সেটা আমরা দিন দিন ভুলে যাচ্ছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার একটি বড় কারণ হতাশা। শিক্ষা জীবন শেষ করে কাঙ্ক্ষিত চাকরি না পেয়ে বেকারত্বের গøানি বইতে বইতে তাদের মগজে-মস্তিষ্কে আস্তানা গাড়ে হতাশা। একসময় আত্মহত্যাকেই হতাশার গøানি থেকে মুক্তির একমাত্র পথ বলে মনে করে তারা। আর বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়াদের কাক্সিক্ষত চাকরি বলতে বিসিএস; কিংবা নিদেনপক্ষে একটা সরকারি চাকরি। এটা ছাড়া তারা যেন কিছু ভাবতেই পারে না। সামাজিক মর্যাদা, সরকারি নানা সুযোগ-সুবিধা, বিয়ের বাজারে পাত্রীপক্ষের কাছে বিসিএস বা সরকারি চাকরিজীবী পাত্রের আকাশচুম্বী চাহিদা ইত্যাদি তরুণ প্রজন্মের কাছে বিসিএস বা সরকারি চাকরিকে সোনার হরিণে পরিণত করেছে। বিসিএস বা সরকারি চাকরির অতিমাত্রায় প্রত্যাশা আমাদেরকে একটি হতাশাপ্রবণ তরুণ প্রজন্ম উপহার দিচ্ছে। কিন্তু বিসিএস বা সরকারি চাকরি-ই কি সব? কেন আমরা অন্য চাকরি খুঁজি না। কেন উদ্যোক্তা হয় না। বিসিএস বা অন্য সরকারি চাকরি পাওয়ার চেয়ে অন্য চাকরি বা নিজে কিছু করে জীবন উপভোগ করা সমীচীন নয় কি! বিসিএস বা অন্য সরকারি চাকরির প্রতি এই বিকারগস্ত উন্মাদনা আমাদেরকে বিসিএসপ্রতিবন্ধী প্রজন্ম উপহার দিচ্ছে। তাই বাস্তবতার দৃষ্টিতে বিবেচনা করে আমাদের মন-মানসিকতায় পরিবর্তন আনা জরুরি।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হতে হবে শিক্ষার্থীবান্ধব। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য দেখভালের জন্য অন্তত একজন করে স্থায়ী ‘মেন্টাল কাউন্সিলর’ নিয়োগ দেয়ার বিষয়টি ভেবে দেখা যেতে পারে। অভিভাবকদের আরো সচেতন হতে হবে এবং সন্তানদর যথেষ্ট সময় দিতে হবে। তাদের পাশ-ফেলনির্ভর শিক্ষা নয়, বরং মানবিক ও আদর্শ মানুষ হওয়ার শিক্ষা দিতে হবে। তাদেরকে অতি আদরে ননীর পুতুল না বানিয়ে বাস্তবতাকে মেনে বড় হওয়ার শিক্ষা দিতে হবে। ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। পরনির্ভরশীল নয় বরং ছোট থেকেই তাদেরকে ছোট-খাটো দায়িত্ব দিয়ে আস্তে আস্তে আত্মনির্ভরশীল হয়ে কিভাবে পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে হয় সে শিক্ষা দিতে হবে। অভিভাবক হিসেবে প্রতিটি বাবা-মায়ের এটা নৈতিক দায়িত্ব। সন্তানকে অতি আদরে বাস্তবতা বিবর্জিত ঘরকুনো করে বড় করা অতি ভালোবাসা নয়। বরং এটি তাকে বিপদে ফেলে দেয়া। সন্তানকে যেমন ভালোবাসতে হবে, তেমনি তাকে জীবনের উত্থান-পতন, ঘাত-প্রতিঘাত সম্পর্কে জাগতিক শিক্ষা দিতে হবে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় আবারও বলতে হয়, ‘পুণ্যে পাপে দুঃখে সুখে, পতনে উত্থানে/মানুষ হইতে দাও তোমার সন্তানে.../পদে পদে ছোটো ছোটো নিষেধের ডোরে/বেঁধে বেঁধে রাখিয়ো না ভালোছেলে করে।/প্রাণ দিয়ে, দুঃখ স’য়ে, আপনার হাতে/সংগ্রাম করিতে দাও ভালোমন্দ-সাথে।’ এই পৃথিবীটা একটা দুঃখ-সুখের লীলাভূমি। প্রতিনিয়তই এখানে আমাদেরকে যুদ্ধ করে বাঁচতে হয় দুঃখ-যাতনা ও নানা প্রতিক‚লতার বিরুদ্ধে। কারণ এই পৃথিবী ফুলশয্যা নয়। এখানে প্রতিক্ষণে সামনে আসে হাজারো দুর্বিষহ দুঃখ, দুর্দশা, যন্ত্রণা, দুর্যোগ-দুর্ঘটনা। এগুলোকে মোকাবেলা করেই বাঁচতে হবে।
লেখক: সমাজকর্মী ও প্রভাষক, সমাজকর্ম বিভাগ, সাভার সরকারি কলেজ, সাভার, ঢাকা
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।