শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
বুদ্ধদেব বসুকে (১৯০৮-১৯৭৪) রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল পরবর্তী আধুনিক কবিতার ধাত্রী ও পৃষ্ঠপোষক রূপে গণ্য করা হয়।রবীন্দ্রনাথ আধুনিকতাকে যে রোমান্টিক চোখে দেখেছেন কল্লোল গোষ্ঠী দেখেছে তার চেয়ে ব্যতিক্রমভাবে,বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিতে।বাস্তবতার প্রতি নিরাসক্ত এই দৃষ্টিই কল্লোল গোষ্ঠীর অন্যতম কবি বুদ্ধদেব বসুকে তিরিশের অতি আধুনিক কবিতা সৃষ্টিতে প্রেরণা যোগায়।পঞ্চপাণ্ডব খ্যাত পাঁচ কবির মধ্যে তিনিই ছিলেন মূল সংগঠক ও মধ্যমণি।তিরিশের কবিতা আন্দোলনের প্রেরণা,প্রচার,প্রবন্ধ লিখে তার যুক্তি তুলে ধরা ও বিচার বিশ্লেষণ করা এসবে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তিরিশ প্রণীত এই আধুনিকতাকে রবীন্দ্রনাথ যখন কটাক্ষ করে বলেন আধুনিক সাহিত্য আমার চোখে পড়েনা।দৈবাত কখনও যেটুকু দেখি,দেখতে পাই হঠাৎ কলমের আব্রু ঘুঁচে গেছেগ্ধ তখন বুদ্ধদেব বসু বয়সে অনেক অনুজ হয়েও তার যুক্তিপূর্ণ ও দৃঢ় বিরোধীতা করতে ছাড়েননি।ভদ্রশ্রেণীর মানুষেরা এতদিন উপন্যাসের নায়ক নায়িকা হওয়ার যে সৌভাগ্য অর্জন করেছেন ও নিম্নস্তরের মানুষের মধ্যে সাহিত্যের যে ব্যবধান ছিল তা দূরীভূত হওয়াকেই রবীন্দ্রনাথ আব্রু ঘুঁচে গেছেগ্ধ বলে অভিহিত করেছেন কিনা তা উল্লেখ করে তিনি পাল্টা বাণ নিক্ষেপ করেছেন।তার দৃষ্টি এত বস্তুনিষ্ঠ ও আত্মবিশ্বাস এত গভীর ছিল যে,বলা যায় প্রায় একাই একটা সাহিত্য আন্দোলনকে শৈশব থেকে যৌবন পর্যন্ত নেতৃত্ব দিয়েছেন।
বুদ্ধদেব বসুর জন্মের পরপরই তার মা মারা যান। এই শোকে তার আইনজীবী পিতা সংসার ছেড়ে সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেন। ফলে আজন্ম তিনি একাকীত্বের ভেতর দিয়ে বেড়ে উঠেন। এই নিঃসঙ্গতাই পরবর্তীতে তার সাহিত্যে শৈল্পিক প্রেরণা জুগিয়েছে।একই কারণে তার উপন্যাসগুলোতে কাহিনীর চেয়ে চরিত্রগুলোর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের দিকে বেশি জোর দিতে দেখা যায়।চরিত্রগুলোর কাছে প্রায়ই কোন কাজ না করে,বিশ্বের সকল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে গভীরভাবে নিজের অস্তিত্বকে অনুভব করাও এক বিরাট কাজ বলে মনে হয়।বুদ্ধদেব বসু মূলত কবিতা দিয়েই তার সাহিত্যজীবন শুরু করেন।১৯২৪ সালে মাত্র ষোল বছর বয়সে তার প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‹মর্মবাণী› প্রকাশিত হয়।তার পাঁচ বছর পর প্রকাশিত ‹বন্দীর বন্দনা› কবিতাগ্রন্থ তাকে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসে।রবীন্দ্রনাথ তার উদ্বেলিত প্রশংসা করেন,অপরদিকে স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী শব্দের গন্তব্য না দেখে শুধু তার উপস্থিতির ভিত্তিতেই শনিবারের চিঠির কট্টরপন্থী সজনীকান্ত দাস এই কবিতাকে অশ্লীল বলে উল্লেখ করেন।
বুদ্ধদেব বসু কবিতা ও উপন্যাসে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল হলেও তিনি সবচেয়ে বিখ্যাত তার সমালোচনা সাহিত্য এবং তিরিশ ও তিরশোত্তর বাংলা কবিতার পথ প্রদর্শনের জন্য।সাহিত্যপত্রিকা সম্পাদনার ক্ষেত্রে তিনি এক প্রবাদপুরুষ।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় পুরানা পল্টনে থাকাকালীন কয়েকজন বন্ধু মিলে চাঁদা ধার্য করে অজিত দত্তের সহযোগিতায় তিনি প্রকাশ করেন ‹প্রগতি› পত্রিকা।এই পত্রিকায় জীবনানন্দের ১৪ টি কবিতা প্রকাশিত হয়।এছাড়াও সেখানে অন্যান্য উদীয়মান অনেক কবির লেখা প্রকাশিত হয় যারা তাদের শিল্পসাধনার জন্য পরবর্তীতে বিখ্যাত হন।বুদ্ধদেব বসু সবচেয়ে বিখ্যাত তার ত্রৈমাসিক ‹কবিতা› পত্রিকার জন্য।১৯৩৫ সালে শুরু হয়ে সুদীর্ঘ ২৬ বছরে এর ১০৪ টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়।প্রথমদিকে সহযোগী সম্পাদক হিসেবে প্রেমেন্দ্র মিত্র,তারপর তৃতীয় বর্ষ থেকে সমরসেন থাকলেও ষষ্ঠ বর্ষ থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি একাই তার সম্পাদনা করেন।সেই সময় ‹কবিতা› পত্রিকায় লেখা ছাপা হওয়াকে তরুণ প্রজন্মের কবিরা নিজেদের কবিকৃতির স্বীকৃতি মনে করতেন।এছাড়া তিনি ‹বৈশাখী› ও ‹চতুরঙ্গ› নামে আরও দু›টি সাহিত্যপত্রিকা সম্পাদনা করেন।
কবিতা পত্রিকা সম্পাদনা করতে গিয়ে বুদ্ধদেব বসু অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন।তিনি নিজেই কবিতা নির্বাচন করতেন ও প্রূফ দেখে দিতেন।শুধু কবিতা নয়,কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধও প্রকাশিত হত ‹কবিতা› পত্রিকায়।অনেক সময় পাঠকদের সাথে সেই সময়ের আধুনিক কবিতার পরিচয় করিয়ে দিতে তিনি নিজেই কলম ধরতেন।বিশেষ করে জীবনানন্দের মত কবি যাকে তিনি ‹নির্জনতম কবি› বলে আখ্যা দিয়েছিলেন,চারপাশের আক্রমণ থেকে একপ্রকার একাই তাকে আগলে রেখেছিলেন।জীবনানন্দের স্বীকৃতি ও প্রকাশের সবচেয়ে বড় মাধ্যমও ছিল বুদ্ধদেব বসু ও তার ‹কবিতা› পত্রিকা।জীবনানন্দের জীবদ্দশায় সব পত্রিকা মিলিয়ে সর্বমোট ১৬২ টি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল,যার মধ্যে ১৪২ টিই প্রকাশিত হয় বুদ্ধদেব বসুর হাতে!বুঝাই যাচ্ছে বুদ্ধদেব বসুর বাইরে জীবনানন্দের প্রকাশের পথ ছিল কত রুদ্ধ ও অমসৃন।যখন সবাই জীবনানন্দের অদ্ভূত শব্দবিন্যাস ও বাক্যের ব্যবহার নিয়ে হাস্যরসে মত্ত ছিল তখন তার দুঃসময়ে অসীম প্রজ্ঞার বলেই বুদ্ধদেব বসু জীবনানন্দের কবি প্রতিভাকে সনাক্ত করতে সক্ষম হন।তার পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে হয়তো জীবনানন্দকে আবিষ্কারে আমাদের আরও অনেকদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হত।তিনি জীবনানন্দের জন্য শুধু সমকালীন কবিতায় আসন নির্মাণ করেই ক্ষান্ত হননি,তার কবিতার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে শনিবারের চিঠি ও অন্যান্য বিরোধীপক্ষের শিল্পসঙ্গত জবাবও দিয়েছেন।
আধুনিক কবিতার পথ নির্মাণ,ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ছাড়াও তিনি বিদেশী ভাষার অনেক কবির কবিতা,বিশেষ করে বোদলেয়ার ও রিলকের কবিতা বাংলায় অনুবাদ করেন।ক্লেদ ও কুসুমের ফরাসী কবি বোদলেয়ারকে তিনিই প্রথম বাঙালীর কাছে জনপ্রিয় করে তোলেন। এভাবে বিশ্বসাহিত্যের সাথে তিনি আধুনিক পাঠকের পরিচয় ঘটান।শুধু তাই নয় তিনি কালিদাস রচিত সংস্কৃত ভাষার প্রাচীন কাব্যগ্রন্থ ‹মেঘদূতম› এর প্রাঞ্জল অনুবাদ করেন বাংলায় ‹মেঘদূত› নামে যা তার স্বকীয় প্রতিভাগুণে জনপ্রিয় হয়।তিনি ছিলেন আপকদমস্তক একজন কবিতার মানুষ।তার স্বাক্ষর স্বরূপ কর্মজীবনে কলকাতার যে বাড়িতে তিনি থাকতেন তার নাম দিয়েছিলেন ‹কবিতা ভবন›।সেখানে সেই সময়ের শিল্পী-সাহিত্যিকদের নিয়মিত আড্ডা বসতো।›কবিতা ভবন› নামে তার প্রকাশনীও ছিল যেখান থেকে তিনি আগ্রহ নিয়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায় এর কবিতার বই প্রকাশ করেন এবং প্রশস্তি সহকারে রবীন্দ্রনাথের কাছে এক কপি পাঠান।সেই সময়ের প্রকাশোন্মুখ প্রতিভাবান তরুণ কবিদের তুলে আনতে তিনি নিরলস পরিশ্রম করেন ও তাদের অন্তর্গত প্রেরণাকে সর্বান্তকরণে উৎসাহ দেন।এভাবে ধর্ম-বর্ণ,জৈষ্ঠ্য-কনিষ্ঠ নির্বিশেষে সেই সময়ের সাহিত্যিকদের তিনি কেন্দ্রমুখী করেন ও নতুন যুগের সাহিত্য আন্দোলনকে বেগবান করে তোলেন।
তিনি ১৯৩৪ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত কলকাতার রিপন কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপনা করেন।পরবর্তীতে পরিণত বয়সে তিনি এশিয়া,ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে বক্তৃতা দিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত হন।তিনি ১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ‹পেনসেলভেনিয়া কলেজ ফর উইমেন› এও শিক্ষকতা করেন।কবিতা,গল্প,উপন্যাস ইত্যাদির পরিধি ডিঙিয়ে বুদ্ধদেব বসু মূলত তার নির্মোহ প্রবন্ধের জন্য বাংলা সাহিত্যে আজও কিংবদন্তী হয়ে আছেন। সাহিত্য আলোচনার ক্ষেত্রে তিনি সার্বজনীন বিচার বিশ্লেষণের পরিবর্তে ব্যক্তিগত মনোভঙ্গির প্রকাশকে গুরুত্ব দিয়েছেন। ফলে পূর্বপাঠের অভিজ্ঞতা ছাড়াই পাঠক সহজেই তার আলোচিত বিষয়ের সাথে একাত্মতা অনুভব করতে পারেন।এজন্য প্রমথ চৌধুরির মত বিরল মন্তব্যকারীও তাকে ভিন্নধর্মী প্রবন্ধ রচনা ও পথ নির্মাণের কৃতিত্ব দিয়েছেন। বিশ্বব্যাপি প্রাণঘাতী মহামারি ও যুদ্ধের ফলে পৃথিবীর সর্বস্তরে যে দুর্যোগ নেমে এসেছে তার প্রতিক্রিয়া স্বরূপ মানুষের জীবন-সংগ্রাম ও চিন্তা-চেতনায় বিপুল পরিবর্তন আসছে।ফলে তিরিশের শাখা সন্তান,অন্তর্মুখী ও অলংকার প্রিয় উত্তরাধুনিকতা থেকে কবিতা ক্রমেই একটি ভিন্ন দিকে মোড় নিচ্ছে। শত বছরের পালাবদলে সুনির্দিষ্ট অথচ প্রাচীরভেদী ইশতেহারসহ এসেছে নতুনধারার কবিতা। নতুন যুগের কবিতা আন্দোলন আজ তাই হাতছানি দিয়ে ডাকছে নতুন যুগের বুদ্ধদেব বসুকে।সাধনালব্ধ আত্মপ্রকৃতি ও দূরদৃষ্টির সঞ্চায়নেই একমাত্র সে ডাকে সাড়া দেওয়া সম্ভব।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।