শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
ব্রিটিশ তাড়ানো আন্দোলন চলছে। ঠিক সেই সময় ব্রিটিশের কূট কৌশলে জাতি দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পরে। শুরু হয় জ্বালাও পোড়াও আন্দোলনের নামে নর হত্যাযজ্ঞ। দেশের বড় বড় শহর এলাকায় রক্তের বন্যা বয়ে যায়। প্রাণ ভয়ে অনেকেই নিরাপদ আশ্রয় নেয়। প্রাণহানী নিরসনের দাবীতে মহাত্মা গান্ধী অনশন ব্রত পালন করেন। দাঙ্গা বন্ধে সোহরাওয়ার্দী, এ কে ফজলুল হক সহ বেশ কিছু শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের প্রশংসিত উদ্যোগ ছিলো। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান ১৫ আগস্ট ভারতকে স্বাধীন ঘোষনা করতে এক পর্যায়ে বাধ্য হয় ব্রিটিশ সরকার। পাকিস্তান-ভারত স্বাধীনতা লাভ করে ঠিকই কিন্তু ভাই ভাই যেন হয়ে যায়। মাঝখানে পরে কাঁটা তারের বেড়া। কেউ কারও মুখ দেখার উপায় নেই। হিন্দুদের জন্য হিন্দুস্থান আর মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান সৃষ্টি হলো সত্য। কিন্তু অনেকেই জন্মস্থান ত্যাগ করে যায়নি। বাপ-দাদার তিন পুরুষের ভিটা বাড়ি ছেড়ে কে যেতে চায়? গ্রামের সহজ-সরল মধ্যবৃত্ত ও নিম্ন মধ্যবৃত্ত পরিবার এদেশে (পূর্ব পাকিস্তানে) থেকে যায়। অনেকে অভাবের তাড়নায় নিজের জন্মভূমি ছেড়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে আশ্রয় নেয়। আশ্রয় নিয়ে অনেকেই স্থায়ীভাবে বসবাস করে। দুই দেশের বর্ডার পাড় হয়ে একে অপরের সাথে দেখা ব্যয় সাধ্য দূরহ ব্যাপার। এদেশের উচ্চবৃত্ত পরিবারের লোকজন দেশের হালচাল লক্ষ্য করে পূর্ব থেকেই ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও কলকাতা অথবা শহরতলী এলাকায় বসবাস করে।
নিম্ন মধ্যবৃত্ত পরিবারের সদস্য পূর্নচন্দ্র ভারতের নদীয়া জেলার মায়াপুর ভাগিরতী নদীর তীরে ঠাঁই নেয়। তেমন লেখাপড়া না জানা এবং আত্মীয়স্বজন না থাকায় কষ্টের মধ্য দিয়ে দিন যাপন করে। স্থানীয় পূর্নিমা নামে এক সুন্দরী মেয়েকে বিবাহ করে পূর্নচন্দ্র। স্বামী-স্ত্রী মিলে ভালই চলছে। তাদের দাম্পত্য জীবন। দেশ ভাগ হওয়ার পর এদেশের জ্ঞাতি গুষ্ঠির সাথে কারো দেখা সাক্ষাৎ নাই। একটি মাত্র মামা গয়ারাম বাবু তিনি পূর্ব পাকিস্তানের টাঙ্গাইল শহরতলী থাকেন।
এই মামাই পূর্নচন্দ্রের বাপ-মা মারা যাওয়ার পর কোলে কাঁখে করে মানুষ করেন। কিন্তু তার সাথেও দেখা সাক্ষাৎ নেই। দৈবাৎ বিশেষ বিশেষ দিনে প্রয়োজনে পত্রের মাধ্যমে কুশল বিনিময় হতো। স্বজনবিহীন প্রবাস জীবন কি বেদনার সে কথা প্রবাসীরাই জানে। পূর্নচন্দ্র নববধূ নিয়ে যদিও খেয়ে পড়ে সুখে রয়েছে। কিন্তু যেকোন উৎসব আনন্দ দিনে আপনজনের অভাব তার হৃদয়কে বেদনার্থ করে তুলে। মামাকে চিঠি দিয়ে তার দুঃখের কথা জানায়। মামা আপনি একবার আসেন। কাজ শেষে বাড়ি এসে পূর্নচন্দ্র তার স্ত্রীর কাছে প্রায়ই অতীত দিনের দুঃখের কথাগুলো গল্পকারে বলতো। তার মামা যে তাকে সন্তানের ন্যায় লালন-পালন করেছে কথাগুলো ভুলেনি সে। পূর্নচন্দ্রের এ কথাগুলো পূর্নিমা শুনে তার অদেখা মামার প্রতি মনে মনে শ্রদ্ধায় প্রনাম জানায়। বিয়ের তিন বছর হয়ে গেল। ইতিমধ্যে তাদের কোলে এক ছেলে সন্তান হয়েছে। তার নাম রেখেছে ‘উদয়’। উদয়ের বয়স মাত্র তিন মাস। সংসারে নতুন অতিথি আসায় পূর্নচন্দ্র তার ছেলের ও স্ত্রীর বরাদ দিয়ে মামাকে পত্রে আসার অনুরোধ জানায়। এভাবে অনেকবার অনুরোধ জানিয়েছে। পূর্নচন্দ্রের বিয়েতেও পত্রে নিমন্ত্রন জানায়। কিন্তু গয়ারামের আসা হয়নি।
পূর্নচন্দ্রের বিয়ের পর তার ঘরে চাঁদের ন্যায় ফুটফুটে ছেলের জন্ম। নাতি, ভাগ্নে বউ ও ভাগ্নেকে দেখার জন্য গয়ারাম মায়াপুর যায়। মামা গয়ারামের আগমনে পূর্ন ও তার স্ত্রী খুব খুশি হয়। ভাগ্নে বউ হাটু ভেঙ্গে মাটিতে মাথা রেখে প্রনাম জানায় গল্পের এই মামা শ্বশুরকে। যে মামা-মামীর আদর যত্মে তার পরম গুরু স্বামীর আজ এই অবস্থান। ভাগ্নে এবং ভাগ্নের বউয়ের সুন্দর অবস্থান স্বচক্ষে দেখে ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায় গয়ারাম। জয় বাংলা থেকে বহুদিন পর এই প্রথম মামা শ্বশুর বাসায় আসায় ভাগ্নে বউ যথেষ্ট সেবা যত্ন করছে। ঘরে তিন মাসের ছোট্ট শিশু। বসত ঘরের পাশে রান্নাঘরে বসে রান্না করছে ভাগ্নে বউ পূর্নিমা। ছোট্ট টুলে বসে গয়ারাম ভাগ্নে বউয়ের সাথে গল্প করছে। ভাগ্নে বউ পূর্নিমা বলে, মামা আপনার ও মামীর কথা আপনার ভাগ্নের মুখে অনেক শুনেছি। আপনি কেন এতোদিন আসেননি? আপনি অনেক দিন পর আমাদের দেখতে এসেছেন আপনার সাথে মায়াপুর, সোনার গৌরাঙ্গ মন্দির, কৃষ্ণনগর, কলকাতা ঘুরে বেড়াবো। আপনি আমাদের সাথেই থেকে যান, বৃদ্ধ বয়সে আর কোথাও যাওয়ার দরকার নেই আপনার। ভাগ্নে বউয়ের আবদারে মামা গয়ারাম বলে, না বউমা, আমি থাকতে পারবো না। তুমিতো জানো না, বাংলাদেশে কি যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে পাকবাহিনী। তা না দেখলে বিশ্বাস করবে না। কত মায়ের যে বুক খালি হয়েছে, কত নারী যে ধর্ষন হয়েছে তার হিসেব নেই। দীর্ঘ নয়টি মাস পালিয়ে পালিয়ে থেকেছি এক এক গ্রামে। কোন কোন দিন রান্না করা ভাত না খেয়ে, জীবনের ভয়ে দৌড়ে পালিয়েছি। আজ বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। রক্তে কেনা এ দেশটাকে ভালবেসে সাত পুরুষের ভিটায় জীবন নিয়ে বেঁচে আছি মা। কথাগুলো বলতে বলতে গয়ারামের দু’চোখের পাতা ভিজে যায়। চোখের জল মুছতে মুছতে গয়ারাম বলে, বউমা আমার পা দুটো যেন পূর্বদিকে যেতে মরিয়া।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।