Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কী হবে এলিজাবেথের পর?

যুগ-যুগান্তরের রানির শাসনাবসান

ডানা ইশরাত | প্রকাশের সময় : ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

রানী এলিজাবেথের মৃত্যুকালে তিনি যুক্তরাজ্যের বাইরে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং অন্যান্য ১১টি কমনওয়েলথ রাজ্যের প্রধান রাষ্ট্রের প্রধান ছিলেন। তিনি ১৫ জন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর শাসনকাল অবলোকন করেছেন। তিনি সর্বশেষ ১৪ মার্কিন প্রেসিডেন্টের মধ্যে ১৩ জনের সাথে সাক্ষাত করেছেন। মার্গারেট থ্যাচার ছিলেন তার প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী। ব্রিটিশ রাষ্ট্রের জীবন্ত কিংবদন্তী হিসাবে রানী এলিজাবেথ সংসদীয় বিলে স্বাক্ষর করেছেন, অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রদূতদের গ্রহণ করেছেন এবং সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের ব্রিটিশ রাজমুকুটের প্রতি তাদের ব্যক্তিগত আনুগত্যের শপথ করিয়েছেন। তিনি ক্ষমতাবলে ইংল্যান্ডের চার্চের প্রধানও ছিলেন।

যদিও এলিজাবেথকে ঘিরে থাকা সমস্ত জাঁকজমক ও আনুষ্ঠানিকতার বাইরে তার কোনো আনুষ্ঠানিক ক্ষমতা ছিল না, তবুও যুক্তরাজ্যের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ ছিলেন স্থিরতার মডেল। তিনি কর্তব্যের প্রতি তার অদম্য নিষ্ঠার জন্য রাজতন্ত্রবাদী এবং গণতন্ত্রবাদীদের কাছে একইভাবে প্রশংসিত ছিলেন। তিনি তার আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব পালনকালে স্মৃতিস্তম্ভ উন্মোচন, পদক প্রদান এবং বিদেশী বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আতিথেয়তা করেছেন, যাদেরকে তার সরকার খুশি করতে চেয়েছিল। রাজতন্ত্রের প্রথা ভেঙে তিনি ব্রিটিশ জনগণের সাথে একটি বন্ধন তৈরি করেছিলেন। তাই যখন তার প্রিয় ঘোড়াগুলি বিশেষ করে রয়্যাল অ্যাসকোটে রেস জিতেছে, তখন ভিড় থেকে বিশেষ উল্লাস ভেসে এসেছে। রানী এলিজাবেথের অদম্য প্রকৃতি এবং সিংহাসন ধরে রাখার সংকল্প তাকে রাজতন্ত্রের রহস্য বজায় রাখতে এবং এক ধরনের নৈতিক কর্তৃত্ব প্রয়োগ করতে সক্ষম করেছিল। যখন তার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন তাকে ২০১৪ সালের স্কটিশ স্বাধীনতা সংক্রান্ত গণভোটের সময় স্কটদের যুক্তরাজ্যের অংশ থাকতে উৎসাহিত করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন, তখন তার একমাত্র প্রতিক্রিয়া ছিল চার্চের বাইরে জনসাধারণের একজন সদস্যকে বলা যে, ভোটের বিষয়ে জনগণের উচিত ‘খুব সাবধানে চিন্তা’ করা। ব্রেক্সিট বিতর্কে উভয় পক্ষই দাবি করার জন্য মরিয়া হয়ে চেয়েছিল যে, রানী ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকা বা ছেড়ে যাওয়ার বিষয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষে। কিন্তু কোন দলই বিশ্বাসযোগ্যভাবে তার সমর্থন দাবি করতে পারেনি। যে বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছে, তা হ’ল, তিনি দেশব্যাপী বিদ্বেষ ও বিভক্তিকে ঘৃণা করেন।

সময়ের সাথে সাথে রানীকে রাজতন্ত্রের আধুনিকীকরণের জন্য ক্রমবর্ধমান চাপের সাথে বসবাস করতে হয়েছে। বৃহত্তর রাজকীয় পরিবার টিকিয়ে রাখার জন্য এর খরচের ক্রমবর্ধমান সমালোচনার সাথেও তাকে বিরোধিতা করতে হয়েছে। ২০২১ সালের হিসাবে রাজপরিবারের জন্য ব্রিটিশ করদাতাদের বছরে প্রায় ৮৭.৫ মিলিয়ন পাউন্ড (১০০.৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) খরচ করতে হয়েছে (রাজতন্ত্রের রক্ষকরা যুক্তি দেন যে, রাজকীয়রা পর্যটন শিল্পকে উৎসাহিত করে)। সম্ভবত এলিজাবেথের শাসনামলের সবচেয়ে বিপজ্জনক মুহূর্ত ছিল, বিশেষ করে প্রজাদের সাথে রানীর সম্পর্কের ক্ষেত্রে ১৯৯৭ সালে প্রিন্সেস ডায়ানার মৃত্যু।

মিডিয়া আইকন হয়ে ওঠা রাজকুমারী ডায়ানার মৃত্যুতে বিশ্বের শোকাহত অবস্থা থেকে, রানী কিছুটা দূরে ছিলেন। তিনি প্রিন্স চার্লস, ডায়ানার পুত্রদ্বয় প্রিন্স উইলিয়াম ও প্রিন্স হ্যারির সাথে বালমোরালে ছুটিতে ছিলেন এবং জনসাধারণের শোকের অংশীদার হতে লন্ডনে যাওয়ার চেষ্টা করেননি এবং পতাকা অর্ধনমিত করারও নির্দেশ দেননি। কিন্তু ডাউনিং স্ট্রিট থেকে অনেক সমালোচনা ও চাপের পর তিনি বালমোরাল থেকে ডায়ানার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে লন্ডনে যান এবং শেস পর্যন্ত ব্রিটিশ পতাকা অর্ধেক নমিত করেন।

পরিবর্তিত বিশ্বের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য রানী এবং রাজপরিবার যে সংগ্রাম করেছিল তা প্রায়শই নিজেদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। রানীর তিনটি সন্তানের বিবাহ বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে, যার মধ্যে চার্লস এবং ডায়ানার প্রকাশ্য বিচ্ছেদও ছিল। অনিবার্যভাবে, রাজতন্ত্রের জৌলুস কলঙ্কিত হয়েছিল। সেই অবনতি অব্যাহত রয়ে গেছে। হ্যারি ও তার স্ত্রী সাসেক্সের ডাচেস মেগান, শুধুমাত্র তাদের রাজকীয় দায়িত্ব থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্তই নেননি, উপরন্তু একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে এই জুটি বলেন যে, তাদের ছেলে আর্চির সম্ভাব্য গায়ের রঙ নিয়ে রাজপরিবারে ‘উদ্বেগ এবং আলোচনা’ ছিল। শিশু নির্যাতনের জন্য দোষী সাব্যস্ত জেফরি এপস্টাইনের সাথে প্রিন্স অ্যান্ড্রুর যোগসাজশের কারণে রাজপরিবারের আরও ক্ষতি হয়।

এখন প্রশ্ন হল, ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের জন্য তার রানী এলিজাবেথের শাসনাবসানের পর কী হবে? কিছু রাজতন্ত্রপন্থী আশঙ্কা করছেন যে, এটি নজিরবিহীন আক্রমণের শিকার হতে পারে। যে বিষয়গুলো রানীর প্রতি ব্যক্তিগত সম্মানের কারণে বছরের পর বছর ধরে স্থগিত রাখা হয়েছিল, সেগুলো এখন আবার উচ্চারিত হবে। অনেক ব্রিটিশ নাগরিক এবং প্রজা, যারা রাণীকে শ্রদ্ধা করেন, তারা তার ছেলে চার্লসের প্রতি সেই অনুরাগ স্থানান্তর করবেন, সেই সম্ভাবনা কম।

অস্ট্রেলিয়াতে ব্রিটিশ মুকুটের সাথে তাদের সম্পর্কটি ভাঙ্গার জন্য একটি নতুন প্রচেষ্টা ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। রানী কমনওয়েলথ দেশগুলিকে এই ধারণাটি গ্রহণ করতে রাজি করানোর চেষ্টা করেছিলেন যে, কমনওয়েল্থ প্রধান হিসাবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চার্লসের তার স্থলাভিষিক্ত হওয়া উচিত। কিন্তু সংস্থাটির বেশ কয়েকজন নেতা মনে করেন যে, পদটি বংশগত হওয়া উচিত নয়। এদিকে, স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি রানীকে একটি স্বাধীন স্কটল্যান্ডের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে রাখার প্রস্তাব দিয়ে ইতিমধ্যেই আলাদা হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে।

রানী এলিজাবেথের মৃত্যু ব্রিটিশ রাজতন্ত্র এবং যুক্তরাজ্যের ভবিষ্যতের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে। ফলে, চারদিক থেকে হবু রাজা চার্লসের উপর চাপ তৈরি হতে পারে। তিনি ইতিমধ্যেই সম্ভবত জনসাধারণের অনুভূতির প্রতি উদ্বেগের কারণে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, তিনি জনগণের পকেট থেকে উপকৃত রাজপরিবারের সদস্য সংখ্যা কমিয়ে আনতে চান। কিন্তু যদি তিনি এটি করেন, তাহলে সম্ভবত তার পরিবারের মধ্যে তাকে সমস্যায় পড়তে হবে। সন্দেহ নেই যে, তার অসাধারণ মায়ের কাছ থেকে দায়িত্ব নেওয়া চার্লস এই সম্পর্কে সচেতন। ব্রিটিশ রাজ্যগুলিকে ধরে রাখতে এবং রাজতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে হলে চার্লসকে ক্রমবর্ধমান সন্দেহপ্রবণ জনসাধারণকে বোঝাতে হবে যে, রাজতন্ত্র এখনও সার্থক এবং প্রাসঙ্গিক। সূত্র: ফরেন পলিসি।



 

Show all comments
  • Minzal Hossain ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ৭:২১ এএম says : 0
    এই রাজতন্ত্র বেশী দিন থাকবে না।
    Total Reply(0) Reply
  • মেহেদী হাসান ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ৫:৩৭ পিএম says : 0
    রানীর দীর্ঘ বয়স, ভুবন ভুলানো হাসি, কথার মাধুর্য, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব,শ্রদ্ধাভাজন অভিভাবক হিসেবে যে ক্ষমতা ছিল তা আর বজায় রাখা পরবর্তী কারও পক্ষে সম্ভব হবেনা।। মহারাণী ভিক্টরিয়া আর জন্মের আগের থেকে রাজপরিবার প্রশ্ন জর্জরিত, সেটা স্বীয় দক্ষতায় এড়াতে পারছিলেন তিনি।। দুটি বিশ্ব যুদ্ধ তার ছেলে নাতি পোপৌত্রের উপর সেই আলোচনা স্থবির করে রেখেছিল।। এরপর রাণী এলিজাবেথ তার পরজ্ঞা দিয়ে ব্রিটিশ অনুভূতি বজায় রেখেছিলেন।। কিন্তু এখন পরিবর্তিত বিশ্ব বিশেষ করে ব্রিটিশ দের আমেরিকানরা এমন ভাবে অনুপ্রাণিত করেছে যা আর রাজতন্ত্রে এদের বেঁধে রাখা অসম্ভব।।
    Total Reply(0) Reply
  • Bablu Rahman ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ৭:১৯ এএম says : 0
    রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ একজনই। জনপ্রিয়তায় তার কাছাকাছি কেউ আর হবে না।
    Total Reply(0) Reply
  • Antara Afrin ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ৭:২০ এএম says : 0
    রাজতন্ত্র কতটা সহজ একজনের বাতি নেবার সাথে সাথেই অন্য জনের বাতি জ্বলে উঠে।
    Total Reply(0) Reply
  • Bulbul Ahmed ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ৭:২১ এএম says : 0
    এতোদিনেও রাজা রানী প্রথা সংরক্ষণ বড্ড বেমানান আধুনিক সভ্যতায়!!
    Total Reply(0) Reply
  • Mohmmed Dolilur ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ৩:৩৪ এএম says : 0
    মানুষ এই কি বলে,রাজতন্ত্রের ঐক্যবদ্ধ,আবার গণতন্ত্র,ডেলের দু পিটে বারি দেওয়া।
    Total Reply(0) Reply
  • Mohmmed Dolilur ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ৩:৩৪ এএম says : 0
    মানুষ এই কি বলে,রাজতন্ত্রের ঐক্যবদ্ধ,আবার গণতন্ত্র,ডেলের দু পিটে বারি দেওয়া।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ