Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চোখের পানিতে সমাহিত রানী এলিজাবেথ

রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় দুই সহস্রাধিক বিদেশীসহ হাজারো মানুষ : পথে পথে অশ্রুসজল শোকার্তর ঢল

মুহাম্মদ সানাউল্লাহ | প্রকাশের সময় : ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

ব্যাপক ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশের মধ্য দিয়ে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথকে চিরবিদায় জানালো ব্রিটিশরা। ওয়েস্ট মিনিস্টার অ্যাবেতে রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পর রানীর পতাকাযুক্ত কফিন ইম্পেরিয়াল স্টেট ক্রাউন উইন্ডসর ক্যাসেলে নিয়ে যাওয়া হয়। তাকে তার বাবা রাজা ষষ্ঠ জর্জ, তার মা রানী এলিজাবেথ এবং বোন রাজকুমারী মার্গারেটের সমাধির পাশে বরাবর সমাহিত করা হয়েছে। তার স্বামী প্রিন্স ফিলিপের কফিন যিনি গত বছর ৯৯ বছর বয়সে মারা গেছেন সেটি তার সমাধির পাশে স্থানান্তর করা হবে। সমাহিত করার আগে সেখানে শেষ বারের মতো প্রার্থনা পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার হলে কয়েকদিন ধরে শায়িত থাকার পর স্থানীয় সময় গতকাল সোমবার ভোর থেকে প্রয়াত রানীকে চিরবিদায় দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। বিশ্ব নেতাদের পাশাপাশি ব্রিটিশ রাজপরিবারের সদস্য, দেশটির রাজনৈতিক অভিজাত, সামরিক, বিচার বিভাগ ও দাতব্য সংস্থাগুলোর সদস্যরা এতে অংশ নিয়েছেন।
এর আগে রানীর কফিন রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য ওয়েস্টমিনস্টার হল থেকে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সহস্রাধিক মানুষের উপস্থিতিতে ধর্মীয় প্রার্থনার পর লাশ নেওয়া হয় সমাধির জন্য নির্ধারিত উইন্ডসর ক্যাসেলে। স্থানীয় সময় বেলা ১২টার পর ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে থেকে শোভাযাত্রা সহকারে কফিনটি ওয়েলিংটন আর্চের উদ্দেশে নেওয়া হয়। রাজা এবং রাজপরিবারের সদস্যরা কফিনের পেছনে শোভাযাত্রায় অংশ নেন। গাড়িতে করে লাশ বহনকারী কফিনটি অনুসরণ করেন কুইন কনসোর্ট ক্যামেলিয়া, উইলিয়াম, হ্যারি, প্রিন্স এডওয়ার্ডের স্ত্রী কেট, মেগান, সোফি। ওয়েলিংটন আর্চ থেকে কফিন উইন্ডসর প্রাসাদে নেওয়া হয়। এসময় শববাহী গাড়ি যাত্রা শুরু করলে রাজকীয় স্যালুটের পাশাপাশি বাজানো হয় জাতীয় সঙ্গীত। গাড়িযোগে উইন্ডসর প্রাসাদে পৌঁছান রাজপরিবারের সদস্যরা। সেখান থেকে কফিনটি উইন্ডসরে নিয়ে যাওয়া হয়। উইন্ডসরে শবযাত্রা শুরু হয় স্থানীয় সময় বিকাল ৩টা ১০ মিনিট থেকে। রাজা ও রাজপরিবারের অন্যান্য সদস্যরা এতে অংশ নেন বিকাল ৩টা ৪০ মিনিটে। তিন মাইল (পাঁচ কিলোমিটার) এলাকাজুড়ে পুরো গমনপথজুড়ে সারিবদ্ধভাবে অবস্থান করবেন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা। বিগ বেন ঘণ্টাধ্বনি বাজতে থাকে শবযাত্রার পুরো সময় ধরে। রানীর লাশ বহনকারী কফিন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল পার হওয়ার সময় রাজকীয় স্যালুট দেওয়া হয়। বাকিংহাম প্যালেসের সামনে রাজার রক্ষীরা এই স্যালুট দেন।
সেন্ট জর্জ চ্যাপেলের নিচে শবযাত্রা থামে স্থানীয় সময় বিকাল ৩টা ৫৩ মিনিটে। রানীকে চূড়ান্তভাবে শেষ বিদায় জানানো শুরু হয় বিকাল ৪টায়। প্রার্থনা পরিচালনা করেন রানীর বিভিন্ন বাসস্থান সংলগ্ন গির্জাগুলোর যাজকরা। রানীর ব্যক্তিগত কর্মীরা এ প্রার্থনায় অংশ নেন। এছাড়া রানী যেসব দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন সেসব দেশের প্রতিনিধিরাও এ ধর্মসভায় অংশগ্রহণ করেন।
১৯৪৭ সালে তৎকালীন প্রিন্সেস এলিজাবেথ এবং প্রয়াত প্রিন্স ফিলিপ মাউন্টব্যাটেনের বিয়ের অনুষ্ঠানে যে স্তবগান করা হয়েছিল, শেষকৃত্যানুষ্ঠানে সেটি গাওয়া হয়। রানী তার প্রিয় স্বামীকে হারান গত বছরের এপ্রিলে। তারা ৭০ বছর ধরে বিবাহিত ছিলেন।
এর আগে রানীর জন্য ধর্মগ্রন্থ থেকে বাণী পাঠ করে শোনান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস এবং কমনওয়েলথের সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারনেস স্কটল্যান্ড। কফিন থেকে রাজমুকুট, রাজদণ্ড ও রাজকীয় গোলক সরিয়ে নেওয়া হয়। শেষ স্তোত্র পাঠের আগেই এগুলো বেদিতে রাখা হয়।
পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে স্থানীয় সময় সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে ষষ্ঠ জর্জ মেমোরিয়াল চ্যাপেলে স্বামী প্রিন্স ফিলিপের সঙ্গে রানীকে চিরদিনের জন্য সমাহিত করা হয়। তার সমাধিতে লেখা থাকবে ‘দ্বিতীয় এলিজাবেথ ১৯২৬-২০২২।
ব্রিটিশ ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় দেশ শাসনকারী রানী গত ৮ সেপ্টেম্বর বালমোরালে ৯৬ বছর বয়সে মারা যান। ব্রিটেনে শেষ রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৬৫ সালে যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল মারা যাওয়ার পর। টেমস নদী দিয়ে রানীর কফিনটি বহন করার সময় তাকে সম্মান জানাতে ক্রেনগুলোকে নত করা হয়। অনেক সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রীয় অন্তেষ্টিক্রিয়ায় প্রত্যক্ষ করতে এবং তাদের শেষ শ্রদ্ধা জানাতে গত কয়েক দিন ধরে অপেক্ষা করেছেন।
গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, জাপানের সম্রাট নারুহিতো, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানেজ, নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্নসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানসহ দুই হাজারের বেশি মানুষ ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে যোগ দেন।
সারা বিশ্ব হতে প্রায় পাঁচশো রাষ্ট্রনেতা এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিসহ দুই হাজারের বেশি অতিথি ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে শেষকৃত্যানুষ্ঠান যোগ দেন। বিভিন্ন দেশের রাজপরিবারের সদস্যরা অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ রাজপরিবারের সদস্যদের কাছাকাছি বসেন। ডেনমার্কের রানী দ্বিতীয় মার্গারিট বসেন ঠিক রাজা চার্লসের উল্টোদিকে। রানী মার্গারিট এবং রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ পরস্পরকে খুব পছন্দ করতেন। ডেনমার্কের রানী এবছর তার সিংহাসনে আরোহনের সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছেন। অন্য যেসব বিদেশি রাজন্যবর্গ উপস্থিত ছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন ভুটান, জাপান, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস এবং স্পেনের রাজা এবং রানী।
রানীর বড় ছেলে এবং উত্তরসূরি রাজা তৃতীয় চার্লস (৭৩) শোক যাত্রায় নেতৃত্ব দেন। তার তিন ভাইবোন এবং তার উত্তরাধিকারী প্রিন্স উইলিয়াম, রাজার ছোট ছেলে হ্যারি তাদের সাথে যোগ দেন। গত রোববার চার্লস বলেছেন, তিনি এবং তার স্ত্রী কুইন কনসর্ট ক্যামিলা সমবেদনা এবং শোক বার্তা পেয়ে ‘গভীরভাবে অভিভূত’। তিনি আরো বলেন, আমরা সবাই আমাদের শেষ বিদায় জানাতে প্রস্তুত। আমি কেবল সকলকে ধন্যবাদ দিতে চাই।
রানীর মৃত্যুর পর রাজ পরিবারের দুই সদস্য রানীর দ্বিতীয় ছেলে প্রিন্স অ্যান্ড্রু এবং চার্লসের ছোট ছেলে প্রিন্স হ্যারি সাময়িকভাবে রাজকীয় আনুষ্ঠানিকতায় ফিরে এসেছেন। রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসও ছিলেন, যাকে রানী তার মৃত্যুর মাত্র দুই দিন আগে ১৫তম ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন।
ট্রাসের পূর্বসূরি এবং তার সমকক্ষরা এবং ব্রিটেনের বাইরে ১৪টি কমনওয়েলথ দেশের প্রতিনিধিরা যেখানে যোগ দেন।
রানীর মৃত্যুতে তার ৭০ বছরের রাজত্বকালে ব্রিটেনে তার রাজত্ব এবং অতীতের উত্তরাধিকার, এর বর্তমান অবস্থা এবং ভবিষ্যতে কী হতে পারে সেইসাথে আজীবন সেবা ও কর্তব্যের মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটেছে। প্রায় ৬ হাজার সামরিক কর্মী এ গৌরবময় রাষ্ট্রীয় অন্তেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নেন।
ব্রিটেনের সর্বোচ্চ পদমর্যাদার সামরিক কর্মকর্তা, চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ অ্যাডমিরাল টনি রাদাকিন, এটিকে ‘রানীর জন্য আমাদের শেষ কর্তব্য’ বলে অভিহিত করেন।
স্থানীয় সময় সকাল ১১টায় শুরু হওয়া রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া লন্ডনের সর্বকালের সবচেয়ে কড়া পুলিশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার অধীনে সংঘটিত হয়েছে। দুই মিনিট নীরবতা পালন এবং জাতীয় সঙ্গীত ‘গড সেভ দ্য কিং’ বাজানোর আগে প্রায় এক ঘণ্টা লাস্ট পোস্ট পরিবেশন করা হয়। ইয়র্কের প্রাক্তন আর্চবিশপ জন সেন্টামু বলেন, ১৬ শতকে রাজা হেনরি অষ্টম দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ইংল্যান্ডের প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চের প্রধান রানী সাদামাটা বিদায় চাননি। যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের ওয়েস্টমিনস্টার হলের দরজাগুলো সকাল সাড়ে ৬টার কিছু পরে বন্ধ করে দেওয়া হয়। কফিনটি রয়্যাল নেভির সদস্যরা অ্যাবেতে নিয়ে যায়।
পার্লামেন্টের হাউসের প্রান্তে এলিজাবেথ টাওয়ারের শীর্ষে বিগ বেন ঘণ্টা বাজায় এবং তোপধ্বনি করা হয়। বিবিসি, সিএএন, আল-জাজিরাসহ আন্তর্জাতিক টেলিভিশনগুলোয় বিপুল সংখ্যক দর্শক বিশ্বব্যাপী শেষকৃত্য অনুষ্ঠান দেখেছে। সূত্র : বিবিসি বাংলা, এএফপি, এপি, রয়টার্স ও ডেইলি মেইল।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ