Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বর্ষায় কাঠগোলাপ অথবা মেঘেদের অশ্রু

রোকন রেজা | প্রকাশের সময় : ২ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:০৪ এএম

চারদিকে কেমন অন্ধকার হয়ে আসছে। আকাশের অবস্থা ভালো না। মেঘ জমতে শুরু করেছে। যেকোনো সময় বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি শুরু হবে।
মাথায় একবোঝা নেপিয়ার ঘাস নিয়ে আকাশের দিকে তাকাতে পারছে না দীপু। একটা শীতল ভেজা ভেজা বাতাস তার গায়ে এসে লাগছে। জোরে জোরে পা চালাতে লাগল সে। মানসী এখন কী করছে কে জানে। নিশ্চয় পাকঘরেই বসে আছে। গরু দু’টোকে গোয়ালে নিতে হবে। মানসী উঠবে না। অপূর্বর স্কুল বোধহয় এখনো ছুটি হয়নি। ও থাকলে গরু দু’টোকে নিয়ে আসত। ঘরের টিনগুলো এবারো পাল্টান হলো না। দেয়ালের টিনগুলোও কেমন ঝাঝরা হয়ে গেছে। খসে খসে পড়ছে।
আঁইলের ওপর দিয়ে প্রায় দৌড়াতে লাগল দীপু। রঞ্জিতদের কলাবাগানে বেপরোয়া বাতাস উঠেছে। বাতাসে কলাগাছের পাতা বাউলের মাথার চুলের মতো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আছড়ে আছড়ে পড়ছে। দীপু এবার জাফর শেখের পাঁচ শতক জমিতে কলাবাগান করেছে। সেই কলাগাছগুলোর মাথা ভারী হতে শুরু করেছে। মোচা আসছে কলাগাছে।
রঞ্জিতদের কলাগাছগুলোর দিকে তাকিয়ে দীপুর মনের মধ্যে একটা অজানা সিরসিরানি আতঙ্ক ঢুকে যেতে লাগল। এই বাতাস কী কলাগাছ ফেলে দেবে! যদি দেয় তাহলে তার বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে। বিরাট ক্ষতি। বাড়ির বাইরে গরুদু’টো অবিরাম চিৎকার করে যাচ্ছে। দীপু বাড়ির মধ্যে ঢুকে মাথা থেকে ঘাসের বোঝা ফেলে ছুটল গরুদুটো আনতে। গরু রেখে এসে দীপু দেখল মানসী ভাঙা পাকঘরে একটা কাঠের পিড়ায় চুপচাপ বসে আছে। বাতাসে তার চুলার আগুন নিভে নিভে যাচ্ছে। চুলার ওপর যথানিয়মে একটা এ্যালুমিনিয়ামের পাতিল। দীপু জানে আজও মানসীর পাতিলে জল ছাড়া কিছুই নেই। খালি জলেই প্রতিদিন মানসী ভাত রান্না করে।
মানসীকে একটা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া খুবই প্রয়োজন। একটা ভালো ডাক্তার দেখানো খুবই দরকার। কিন্তু হাতে নগদ টাকা কিছুই নেই। দীপু ভাবল অপূর্বর স্কুলের টাকাটা পেলেই মানসীকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে সে। ছেলেটা অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই স্কুল থেকে ফিরবে। দীপুর নিজের পেটও খিদেয় চোঁ চোঁ করছে। সকালবেলায় রাতের ভেজানো পান্তা খেতে গিয়ে দেখে একটা মরা আরশোলা ভেসে আছে ভাতের পানিতে। রাতে অপূর্ব খেয়ে আর ঢাকা দিয়ে রাখেনি হয়তো বা। সকালে তাই ভাত খাওয়া হলো না। প্লাস্টিকের কৌটার মধ্যে শুকনো মুড়ি ছিল। তাই দু’গাল চিবিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল ।
ছেলেটা স্কুল থেকে এসে আতিপাতি করে খুঁজবে খাবার। ঝড়-জলের যে অবস্থা তাতে রান্না করাও মুশকিল। অন্যদিনের মতো হলে দীপু নিজেই কিছু একটা চড়িয়ে দিত। সাথে আলুছানা, পেঁপেছানা এসব করে নিত। আজ কী হবে সৃষ্টিকর্তাই জানেন!
দীপু ভেজা গামছা দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে পাকঘরে এসে মানসীকে লক্ষ্য করে তীক্ষè কন্ঠে বলল, দেখি ওঠো দেখি। ঘরে যাও। তারপর দীপু চুলার আগুন আস্তে করে নিভিয়ে দিয়ে মানসীর কাছে এসে দাঁড়াল।
মানসী তবুও কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে থাকল সেখানে। হঠাৎ করেই মুখটা হাসি হাসি করে সে বলল, কোথায় তোমার ঘর! তোমার ঘরে তো জলের বাণ ডাকে। তারপর মুখটা অদ্ভুতভারে বিকৃত করে টেনে টেনে বলল, ঐ আবার ঘর!
দীপু রাগতে গিয়েও রাগল না। হিতে বিপরীত হতে পারে। এতদিন যখন ধৈর্য ধরেছে আর ক’টাদিন ধরা যাক। মানসী পাকঘর থেকে নেমে উঠানে এসে দাঁড়াল। ভিজতে লাগল বৃষ্টিতে।
দীপুর নিজের কোনো জমি-জমা নেই। অন্যের জমি লিজ বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করে। নিজের কাজ গুছিয়ে মাঝে মধ্যে অন্যের জমিতেও যায়। চারটে ছাগল আর দু’টো গরু আছে তার। একসময় কিছু হাঁস-মুরগিও ছিল। মানসী ঠিকমতো ঘরে তুলত না। তাই হারাতে হারাতে এখন আর অবশিষ্ঠ নেই।
দীপু দেখল মানসী উঠানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছে। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা তার গা’য়ে এসে লাগছে। সে দু’হাত প্রসারিত করে বৃষ্টির ফোঁটা ধরবার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। ওর চুল চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে বৃষ্টির জল। ওকে দেখে মনে হচ্ছে বৃষ্টির এই জলে ও যেন কতকাল ভেজেনি।
দীপু ঘরের মধ্যে উঠে গেল। টিনের ফাঁক গলে দুড়দাড় জল ঢুকে যাচ্ছে। দু’টো মাটির মালসা আর একটা টিনের বালতি এনে নিচে রাখল। চৌকির ওপর কাঁথা-বালিশ জড়ো করল এককোণে। অপূর্বর একটা জামা আর মানসীর একটা হলুদ রঙের শাড়ি বাঁশের আড়া থেকে নামিয়ে বড় একটা পলিথিনের মধ্যে ঢুকাতে গিয়ে কেমন যেন বুকের মধ্যে তীব্র একটা চাপা কষ্ট অনুভব করল। কাঠের চৌকির ওপর ধপ করে বসে পড়ল সে। নিজের জীবনের ব্যর্থতার যন্ত্রণা হঠাৎ করেই দু’চোখ বেয়ে অবিরত ধারায় নেমে আসতে লাগল। ঘোরলাগা মানুষের মতো বেহুশ কিছুক্ষণ বসে থাকল সে। তারপর মাথায় যখন বৃষ্টির জল পড়তে শুরু করল তখন সে উঠে দাঁড়াল। বৃষ্টির জল আর ওর দু’চোখের জল মিলেমিশে এক হয়ে গেল।
দীপুর হঠাৎ মনে হলো তার খুব ক্ষুধা লেগেছে। সে ভাবল বৃষ্টি আর একটু কমে আসলে কিছু চাল ডাল এক জায়গায় পাকিয়ে নেবে। আর তার মধ্যে দু’টো ডিম ছেড়ে দেবে। বৃষ্টির দিনে ডিম-খিচুড়ি খারাপ হবে না। ছেলেটা আরাম করে খাবে। কিন্তু ঘরে কি ডিম আছে? কে জানে! না থাকলেও অসুবিধা নেই। অপূর্বকে কালুর দোকানে পাঠিয়ে ডিম আনিয়ে নিতে হবে। কালুর দোকানেও বেশ কিছু টাকা বাকি পড়ে গিয়েছে। দীপুর মনের মধ্যে তাই একটু সংশয় জাগল বৃষ্টির এইদিনে কালু বাকিতে ডিম দেবে তো!
বেশ কিছুক্ষণ বৃষ্টি থেমেছে। দীপু ঘর থেকে বেরুতে গিয়ে হঠাৎ দেখল দু’জন অপরিচিত তরুণ-তরুণী তার উঠানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। ঝলমলে শহুরে চেহারা তাদের। তারা কাঠগোলাপ গাছটার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। এই বর্ষায় গাছটাতে ফুলও এসেছে প্রচুর। পাঁচ পাপড়ীর সাদা সাদা ফুলের মাঝখানে মনোমুগ্ধকর গোলাপি রঙের আভা। বৃষ্টির জলে ধুয়ে ফুলগুলো চকচক করছে রুপোর পয়সার মতো। মেয়েটার মাথায় রঙিন ফোল্ডিং ছাতা। ছেলেটা মোবাইল ফোনে ফুলগুলোর অনেকগুলো ছবি তুলল। তারপর ছেলেটা গাছটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। মেয়েটা অনুশোচনার ভঙ্গিতে নিচু কন্ঠে বলল, ঐ টিনের ভাঙা ঘরটা যদি না থাকত!
ছেলেটা বলল, বৃষ্টির দিনে টিনের ঘরই তো সুন্দর। বৃষ্টির রিদম শোনা যায়। রোমান্টিসিজম তৈরি হয়।
মেয়েটা বলল, তুমি ঠিকই বলেছ। বৃষ্টির রিদম আমারও খুব প্রিয়। তারপর মেয়েটা তার রঙিন ছাতা বন্ধ করল। দু’জন কাছাকাছি সরে এলো। মোবাইলটা সামনে নিয়ে সেলফি তুলতে লাগল।
দীপু বুঝতে পারল না সে ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে কিনা। সে এটাও জানে না যে এই অপরিচিত দু’জন কারা!
দীপুর মনের মধ্যে যখন একরাশ দ্বিধা সংশয় খেলা করছে ঠিক সেইসময় অপূর্বর বন্ধু অমিত এসে খবর দিল অপূর্ব স্কুলে জসিমের সঙ্গে মারামারি করে হাত ভেঙে ফেলেছে।
দীপু আচমকা ঘর থেকে বেরিয়ে উবিগ্ন হয়ে পড়ল। উঠানের দু’জন মানুষকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ব্যস্ত চোখে মানসীকে এদিক-ওদিক খুঁজতে লাগল। কিন্তু মানসী ধারে কাছে কোথাও নেই। দীপু আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। জোরে পা টেনে হাঁটতে লাগল স্কুল পানে। পথের মধ্যে রঞ্জিতদের বাড়ির সামনে মানসীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল দীপুর। মানসীর ডান হাতে পলিথিনের মধ্যে একটা রসগোল্লা। দীপুকে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটতে দেখে মানসী বলল, এই অবেলায় কোথায় যাচ্ছ তুমি?
স্কুলে।
এখন স্কুলে কেন? এ প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে দীপু জিঞ্জেস করল, তুমি রসগোল্লা কোথায় পেলে?
কাকিমা দিল। একটু থেমে মানসী আনন্দিত কন্ঠে বলল, কাকিমার ভাইয়ের মেয়ে-জামাই এসেছে। কী সুন্দর গো তারা! তারা গ্রাম দেখতে বেরিয়েছে।
কিছু বলতে গিয়েও বলল না দীপু। কথা গিলে নিলো। কৃষ্ণ আর রাধা তাহলে এতক্ষণ তার উঠানেই ছিল!



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বর্ষায় কাঠগোলাপ অথবা মেঘেদের অশ্রু
আরও পড়ুন
function like(cid) { var xmlhttp; if (window.XMLHttpRequest) {// code for IE7+, Firefox, Chrome, Opera, Safari xmlhttp=new XMLHttpRequest(); } else {// code for IE6, IE5 xmlhttp=new ActiveXObject("Microsoft.XMLHTTP"); } xmlhttp.onreadystatechange=function() { if (xmlhttp.readyState==4 && xmlhttp.status==200) { var divname = "clike_"+cid; //alert(xmlhttp.responseText); document.getElementById(divname).innerHTML=xmlhttp.responseText; } } var url = "https://old.dailyinqilab.com/api/insert_comment_like.php?cid="+cid; xmlhttp.open("GET",url,true); xmlhttp.send(); } function dislike(cid) { var xmlhttp; if (window.XMLHttpRequest) {// code for IE7+, Firefox, Chrome, Opera, Safari xmlhttp=new XMLHttpRequest(); } else {// code for IE6, IE5 xmlhttp=new ActiveXObject("Microsoft.XMLHTTP"); } xmlhttp.onreadystatechange=function() { if (xmlhttp.readyState==4 && xmlhttp.status==200) { var divname = "cdislike_"+cid; document.getElementById(divname).innerHTML=xmlhttp.responseText; } } var url = "https://old.dailyinqilab.com/api/insert_comment_dislike.php?cid="+cid; xmlhttp.open("GET",url,true); xmlhttp.send(); } function rlike(rid) { //alert(rid); var xmlhttp; if (window.XMLHttpRequest) {// code for IE7+, Firefox, Chrome, Opera, Safari xmlhttp=new XMLHttpRequest(); } else {// code for IE6, IE5 xmlhttp=new ActiveXObject("Microsoft.XMLHTTP"); } xmlhttp.onreadystatechange=function() { if (xmlhttp.readyState==4 && xmlhttp.status==200) { var divname = "rlike_"+rid; //alert(xmlhttp.responseText); document.getElementById(divname).innerHTML=xmlhttp.responseText; } } var url = "https://old.dailyinqilab.com/api/insert_reply_like.php?rid="+rid; //alert(url); xmlhttp.open("GET",url,true); xmlhttp.send(); } function rdislike(rid){ var xmlhttp; if (window.XMLHttpRequest) {// code for IE7+, Firefox, Chrome, Opera, Safari xmlhttp=new XMLHttpRequest(); } else {// code for IE6, IE5 xmlhttp=new ActiveXObject("Microsoft.XMLHTTP"); } xmlhttp.onreadystatechange=function() { if (xmlhttp.readyState==4 && xmlhttp.status==200) { var divname = "rdislike_"+rid; //alert(xmlhttp.responseText); document.getElementById(divname).innerHTML=xmlhttp.responseText; } } var url = "https://old.dailyinqilab.com/api/insert_reply_dislike.php?rid="+rid; xmlhttp.open("GET",url,true); xmlhttp.send(); } function nclike(nid){ var xmlhttp; if (window.XMLHttpRequest) {// code for IE7+, Firefox, Chrome, Opera, Safari xmlhttp=new XMLHttpRequest(); } else {// code for IE6, IE5 xmlhttp=new ActiveXObject("Microsoft.XMLHTTP"); } xmlhttp.onreadystatechange=function() { if (xmlhttp.readyState==4 && xmlhttp.status==200) { var divname = "nlike"; document.getElementById(divname).innerHTML=xmlhttp.responseText; } } var url = "https://old.dailyinqilab.com//api/insert_news_comment_like.php?nid="+nid; xmlhttp.open("GET",url,true); xmlhttp.send(); } $("#ar_news_content img").each(function() { var imageCaption = $(this).attr("alt"); if (imageCaption != '') { var imgWidth = $(this).width(); var imgHeight = $(this).height(); var position = $(this).position(); var positionTop = (position.top + imgHeight - 26) /*$("" + imageCaption + "").css({ "position": "absolute", "top": positionTop + "px", "left": "0", "width": imgWidth + "px" }).insertAfter(this); */ $("" + imageCaption + "").css({ "margin-bottom": "10px" }).insertAfter(this); } }); -->