শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
শামসুর রাহমান। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে আধুনিক কবি হিসেবে বাংলা সাহিত্যে আবির্ভূত হন এবং দুই বাংলায় খুব অল্প সময়েই জনপ্রিয়তা লাভ করেন। তাঁর জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবির মর্যাদা পান।
নবম শ্রেণির ছাত্রাবস্থায় শামসুর রাহমানের স্বাধীনতা তুমি কবিতার মাধ্যমে তাঁর লেখার সাথে আমার পরিচয় ঘটে। এরপর হাতে পাই তাঁর কবিতার বই যে অন্ধ সুন্দরী কাঁদে।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে শামসুর রাহমানের কবিতা প্রেরণাদায়ী ভূমিকা পালন করে। তাঁর তুমি বলেছিলে শিরোনামের কবিতাটিতে নিপুণভাবে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের পলায়নপর মানুষের চিত্র আঁকেন --
মৌচাকে আগুন দিলে যেমন সশব্দে/সাধের আশ্রয় ত্যাগী হয়
মৌমাছির ঝাঁক,/তেমনি সবাই
পালাচ্ছে শহর ছেড়ে দিগ্বিদিক। নবজাতককে
বুকে নিয়ে উদ্ভ্রান্ত জননী
বনপোড়া হরিণীর মত যাচ্ছে ছুটে।/স্বাধীনতা প্রত্যাশী স্বাপ্নিক কবি তাঁর বন্দী শিবির থেকে কবিতায় আক্ষেপের সুরে উচ্চারণ করেন --
শহরের আনাচে কানাচে/প্রতিটি রাস্তায়
অলিতে গলিতে/রঙিন সাইনবোর্ডে, প্রত্যেক বাড়িতে
স্বাধীনতা নামক শব্দটি/লিখে দিতে চাই
বিশাল অক্ষরে/স্বাধীনতা শব্দ এত প্রিয় যে আমার
কখনো জানি নি আগে । উঁচিয়ে বন্দুক
স্বাধীনতা, বাংলা দেশ—- এই মতো শব্দ থেকে ওরা
আমাকে বিচ্ছিন্ন ক’রে রাখছে সর্বদা।
শামসুর রাহমান আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের স্বাধীনতা নিয়ে লিখেছেন প্রচুর। তাঁর কবিতা মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমাদেরকে সাহস দিয়েছে, প্রেরণার যোগান দিয়েছে। বাঙালির উপর অকথ্য নির্যাতনের প্রতিবাদে তাঁর অভিশাপ দিচ্ছি কবিতায় লিখেছেন --
আমাদের বুকের ভেতর যারা ভয়ানক কৃষ্ণপক্ষ দিয়েছিলো সেঁটে
মগজের কোষে কোষে যারা পুঁতেছিল
আমাদেরই আপন জনেরই লাশ দগ্ধ, রক্তাপ্লুত
যারা গণহত্যা করেছে শহরে গ্রামে টিলায় নদীতে ক্ষেত ও খামারে
আমি অভিশাপ দিচ্ছি নেকড়ের চেয়েও অধিক পশু সেই সব পশুদের।
কবি মুক্তিযুদ্ধের সময়ের বর্বরতা চাক্ষুষ করেছেন, মর্মাহত হয়েছেন। তাই তাঁর কলম থেকে বেরিয়ে আসে ্র তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা ্র এর মতো অবিনাশী কবিতা। তিনি লিখেছেন --
তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা,
তোমাকে পাওয়ার জন্যে/আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায় ?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন ?
আমাদের করুণ চিত্র আঁকার এক বড়ো শিল্পীর নাম শামসুর রাহমান। তিনি কী মর্মন্তুদ ভাষায় লিখেন--
তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিলো পিতামাতার লাশের উপর।
১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট পৃথিবীর ইতিহাসে কালো দাগে চিহ্নিত একটি দিন। এই দিনে সপরিবারে হত্যা করা হয় জাতির পিতাকে। মর্মাহত কবি লিখেন এ লাশ আমরা রাখবো কোথায় ?
এ লাশ আমরা রাখবো কোথায় ?
তেমন যোগ্য সমাধি কই ?
মৃত্তিকা বলো, পর্বত বলো
অথবা সুনীল-সাগর-জল-
সব কিছু ছেঁদো, তুচ্ছ শুধুই !
তাইতো রাখিনা এ লাশ আজ
মাটিতে পাহাড়ে কিম্বা সাগরে,
হৃদয়ে হৃদয়ে দিয়েছি ঠাঁই।
শামসুর রহমান আরো লিখেন তিনি এসেছেন ফিরে শিরোনামের কবিতাটি। তাঁর এই কবিতাটিতে বঙ্গবন্ধুর অমরত্বের কথা তুলে ধরেছেন তাঁর নিজস্ব প্রতিবাদী ভাষায়।
ওরা তাঁকে হত্যা ক’রে ভেবেছিল তিনি
সহজে হবেন লুপ্ত উর্ণাজাল আর ধোঁয়াশায়,
মাটি তাঁকে দেবে চাপা বিস্মৃতির জন্মান্ধ পাতালে-
কিন্তু তিনি আজ সগৌরবে
এসেছেন ফিরে দেশপ্রেমিকের দীপ্র উচ্চারণে,
সাধারণ মানুষের প্রখর চৈতন্যে,
শিল্পীর তুলিতে, গায়কের গানে, কবির ছন্দের
আন্দোলনে,
রৌদ্রঝলসিত পথে মহামিছিলের পুরোভাগে।
শামসুর রাহমান আঞ্চলিক শব্দের যাদুকরী মিলনে সৃষ্টি করেন তাঁর এই মাতোয়ালা রাইত। কবিতাটির অংশবিশেষ --
আবে, কোন্ মামদির পো সামনে খাড়ায়? যা কিনার,
দেহস না হপায় রাস্তায় আমি নামছি, লৌড় দে;
না অইলে হোগায় লাথ্থি খাবি, চটকানা গালে।
গতরের বিটায় চেরাগ জ্বলতাছে বেশুমার।
শামসুর রাহমানের স্বাধীনতা তুমি কবিতাটি পাঠ করেননি, এদেশের লেখাপড়া জানা এমন কোনো মানুষ নেই। কবিতাটিতে গভীর ভালোবাসায় তিনি স্বাধীনতাকে তুলে এনেছেন। রবীন্দ্রনাথের কবিতা-গান, নজরুলের বাবরি চুল, শহীদ মিনারের উজ্জ্বল সভা, স্লোগান-মুখর মিছিল, কৃষকের হাসি, গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার, মজুর যুবার রোদে ঝলসিত পেশী, মুক্তিসেনার চোখের ঝিলিক, মেধাবী শিক্ষার্থীর ভাষণ, ঝোড়ো সংলাপ, কালবোশেখীর ঝাপটা, শ্রাবণের মেঘনার বুক, পিতার জায়নামাজের জমিন, মায়ের শুভ্র শাড়ির কাঁপন, বোনের হাতের মেহেদী, বন্ধুর হাতের রঙিন পোস্টার, গৃহিনীর কালো চুল, খোকার রঙিন কোর্তা, খুকীর গালে রৌদ্রের খেলা, বাগানের ঘর, কোকিলের গান, বয়েসী বটের পাতা এবং স্বাধীন ইচ্ছায় লেখার তাঁর কবিতার খাতার সাথে তুলনা করেছেন।
শামসুর রহমান ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ২৩ অক্টোবর ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, স্বাধীনতা পদক, আনন্দ পুরস্কার, আদমজী সাহিত্য পুরস্কার প্রভৃতি অর্জন করেন।
২০০৬ খ্রিস্টাব্দের ১৭ আগস্ট কবি শামসুর রাহমান ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। বিনম্র শ্রদ্ধা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।