শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
পবিত্র সন্ধ্যায় ফিরেছে বাড়ীর ভেতরটা কেমন অচেনা লাগছে কেন যে একি ব্যাপার আজ।
অনিমেষ আর রিতা বাবাকে বিশাল একটি মালা পড়িয়ে হ্যাপি টোয়েন্টি ফাইভ বাবা। আজ যে পবিত্রর ম্যারেজ ডেট কি আশ্চর্যের দিন তা একই দিনে তার পাশে সঙ্গী আর কর্ম নেই। পবিত্রর চোখে জল শান্তি দেবীর ছবির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, দেখ শান্তি কত শান্তিতে আছি।
এই ভাবে বেশ কবছর চলে গেছে পবিত্র বাবুও আজ নেই, অনিমেষ ভাই বোন দের উচ্চ শিক্ষিত করেছে তাদের মা আর বাবার মত স্নেহের মধ্যে রেখে সংসারে আবদ্ধ করেছে খালি নিজে সারা জীবন একাই কাটিয়ে দিল। রাজ্যের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে উচ্চ পদ নিয়েই চলেছে খাওয়া-দেওয়া অফিসেই সারা হয় আর সবকিছুই সরকারি গ্রুপ ডি কর্মীরা করে দেয়।
কিন্তু আজ অনিমেষ হেড অফিসের কাজে গিয়েছিল নিউ সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিং তাই আসতে একটু দেরিই হয়ে গেলো টেবিলের সামনের চেয়ারে বেশ কিছু লোক বসে আছেন। অনিমেষ অফিসে ঢুকছে সঙ্গে দুটি প্যাকেট নিয়ে এসেছে, শম্ভু টেবিলের পাশে টি টেবিলের উপর রাখল। এত খাবার কিসের জন্য? আজ কি ওনার কোন স্পেশ্যাল দিনের ব্যাপার আছে?
পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই, অবিবাহিত অনিমেষকে আজ পর্যন্ত কেউই খাবার আনতে দেখেনি। সতীর্থদের লাঞ্চের আবেদন হাসিমুখে অগ্রাহ্য করে, নির্বিরোধী মানুষটি চিরকাল ক্যান্টিনের হালকা খাবার দিয়েই পেট ভরিয়েছেন। তাই আজ দুপুরে আচমকা সবার সামনে টিফিনভর্তি খাবার বাটিতে বাটিতে করে বেড় হতেই, অনেকক্ষণ কারো মুখে কোন কথা আজ কারোর মুখে নেই।
জল্পনাটা অবশ্য তখন থেকেই আরম্ভ হয়েছিল। চা দিতে এসে শম্ভু যখন ফিস ফিস করে প্রায় গুপ্তখবর দেওয়ার ভঙ্গিতে বলেছিল, আজ সাহেব মস্ত দুটো ঝোলা এনেছেন”, ডি এল আর ও অফিসের মান্ধাতার আমলের ইঁটগুলোও তখন কান খাড়া করে ছিল। অফিসের বিল্ডিংএর এই ছোট্টো রুমে গুটিকয় স্টাফের মধ্যে খবরটা চাউর হতে সময় লাগেনি। সকলেই ঝোলার ভিতরের অজানা বস্তু দর্শনের উত্তেজনায় ফুটতে শুরু করলেও স্যারের টেবিলের সামনের লোকজন না বেরোনো পর্যন্ত একটু অপেক্ষা করতে লাগল। সবাই সরে যেতেই শম্ভু প্প্যাকেট হাতে যা দেখে সবার যেন খুলতে ইচ্ছে হচ্ছিল।
অফিসে এখন দুপুরের টিফিন টাইম। ভিজিটাররা সবাই বেরিয়ে যেতেই স্টফেরা অনিমেষকে ঘিরে ধরলো। সবাই বলে উঠল স্যার এবার টিফিন হউক। অবশ্যই হবে শম্ভুকে বলুন টিফিন বক্সের খাবারগুলো টেবিলে নিয়ে আসতে। টেবিল ছেড়ে উঠল অনিমেষ। হ্যান্ড ওয়াশ করে আসছি। শম্ভু সব খাবার ভাগ করে দাও। যে যার টেবিলে বসে শম্ভু এক এক জনকে খাবার বাড়িয়ে দিচ্ছে।
আহা বহুদিন পর এমন মুড়িঘন্ট খেলাম, মায়ের রান্না মনে পড়ে গেল!” হাত চাটতে-চাটতে বললেন হেড ক্লার্ক পার্থ বসু।আচ্ছা স্যার এতসব কি কোন ক্যাটারার সাপ্লাই করেছে বেশ্ ঘরের মত রান্না।
কেন, প্রতিটি খাবার আর সর্ষে দিয়ে পার্শে মাছের ঝালটা! কাঁটাগুলো অব্দি খেয়ে ফেললেন তো পার্থ বাবু।” সুমিত্রাদির কথায় হেসে উঠল সবাই। অনিমেষের সাদাকালো গোঁফে লজ্জা আর গর্বমেশানো হাসি ফুটেছে । অনিমেষ অল্পই খেল। এরপর রোজই টিফিনে রকমারি সুস্বাদু পদ আসতে লাগল। স্বাদের নেশায় প্রথম কদিন সবাই মাতোয়ারা ছিল, প্রশ্নটা প্রথম তুললেন সিনিয়র ক্লার্ক পার্থ বসু।
খেতে তো ভালই লাগছে দাদা, তবে রান্নাটা কার হাতের? আপনি তো আর রোজ বানিয়ে আনছেন না?” ক্যাটারার কে? প্রশ্নটা প্রথমদিকে মৃদু হেসে এড়িয়ে যাচ্ছিল অনিমেষ। কিন্তু একটা সময়ের পর সকলের চাপে উত্তর অনিবার্য হয়ে উঠল অনিমেষের জন্য।
অনিমেষ বলবো সময় হলে আপনারা এত চিন্তিত কেন? এত বছরের ডইঈঝ ঙভভরপবৎ অভিজ্ঞতা তো কম নয় আপনাদের চোখ মুখের ভাব আর গসিপি সবই আমার চেনা। বেচেলার তো অনেক পাঁক মাথায় খাচ্চে তাইতো।
আমাদের দোকানের পাশেই থাকত মদনদা। একটা ছোট কচুরী আর তেলেভাজার দোকান ছিল। খুব বেশি চলত না, তবে মদনদা আর মা-মরা মেয়ে প্রতিমার বেশ কেটে যাচ্ছিল। এবারে বাড়িতে গিয়ে শুনলাম, মদনদা করোনায় মারা গেছেন। প্রতিম ওখানের স্কুল থেকেই হায়ার সেকেন্ডারি দিয়েছে সদ্য। বাবা মারা যাওয়ার পর দোকানটা চায়ের দোকান করে চালাবার চেষ্টাও করছিল, কিন্তু ঝামেলা হলো পাশের পার্টি অফিসটা থাকায়। দিনভর সেখান থেকে চ্যাংড়া ছেলেরা চা-টায়ের অর্ডার নিয়ে আসত। চায়ের থেকে আড্ডার টান ছিল বেশি। ওর মাসী সব দেখেশুনে.. লোকাল কমিশনারকে জানান ওকে একটা কাজ যদি দেয়া যায় তাহলে অনাথ মেয়েটি বাঁচে। শুনলাম ওর মাসী ভারতী সিঁথির মোড়ে যে সপ্ত কন্যার গন বিবাহ হয়,সেখানে নাম লিখিয়েছে,তাতে মেয়েটির আপত্তি আছে। ও জেদ ধরেছে আরো পড়াশুনা করবে পলিটেকনিক পরীক্ষায় সে পাশ করলেই সে বিয়ে করবে!!
এদিকে আমাকে প্রতিমা ছোট থেকেই চেনে জানে কি যুদ্ধের সৈনিক এই আমি অনিমেষ কাকু ওর ইচ্ছে অনিমেষে কাকুর দেখানো চলার পথেই চলবে। আসুক সব ঝড় ঝাপটা,সেই পথেই হাঁটতে যে চায় প্রতিমা।
কাকু এসেছে দেখে ছুটে আসেছে প্রতিমা, বুক ধরফর করছে কি বলবে, ভাবছে যদি কাকু তার ইচ্ছা প্রত্যাখ্যান করেন। কি বলতে চাইছে মেয়েটা আমি ও ভাবছি।
আমি তার দিকে তাকিয়ে মাথায় হাত রেখে বলি কেমন আছিসরে মা, কি পড়ছিস্।
প্রতিমা একটু থেমে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ আমার পা জড়িয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে, ‘কাকু আমায় বাচাঁও কাকু আমি বিয়ে করব না আমি পড়তে চাই বাবার ইচ্ছে ছিল আমি সিভিল ইঞ্জিনিয়র হই আমি পাশ করেছি কাকু তুমি অনেক মহান ব্যাক্তি অনেকের উপকার করেছো তুমি আমাকে একটু সুযোগ দাও! বলেই ধপ করে পড়ে গেল!
ফিট হয়ে গেল নাকি মেয়েটা, আমি নাড়ি টিপে দেখি। বলি এই প্রতিমা তোর কি হল? অবাক নয়নে আমি ওকে দেখে মায়াতে পড়ে গেলাম।একটু জল নি আয় জগা। চোখে মুখে ছেটাতেই জ্ঞান ফিরল। প্রতিমার মাসীও এরই মধ্যে চলে এসেছেন।
আমি মাসীমার অনুমতি নেওয়ার জন্য বললাম, আমি ওকে সাথে নিয়ে যাব ওর পড়াশুনা আর দেখাশুনা আমি করব আপনি অনুমতি দিন।” ওকে আমি নিয়ে এলাম আমার বাংলোয়।
সবার মুখ থেকে ততক্ষণে হাসিঠাট্টার রেশ উড়ে গেছে। হয়তো সম্বিত ফিরলে কেউ আরো কিছু জানতে চাইত,কিন্তু তার আগেই অনিমেষ বাবু ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।
অনিমেষের প্রৌঢ় বয়সের এই কাজে অফিসের লোক দুভাগ হয়ে গেল। একদল লোকের মতে, উনিও তো চ্যাংড়াগুলোর মতোই মেয়েটাকে পাবার ধান্দা করলেন। আবার সুমিত্রাদির মত কেউ কেউ বলল, মন্দ নয়, মানুষটা যদি এই বয়সে এসে ঘর বাঁধতে চায় তাতে ক্ষতি কী! মেয়েটারও তো একটা হিল্লে হল!
কিন্তু কৌতূহল বেড়েই চলেছে। কয়েক দিন পর অফিসের সব স্টাফ বায়না ধরলেন, তারা অনিমেষ বাবুর বাড়ি যেতে চায়, প্রতিমার সাথে দেখা করতে। অনিমেষ কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু সমবেত আবেদনের কাছে শেষপর্যন্ত সাড়া দিতে বাধ্য হলেন, তাঁর মত স্বভাবনম্র মানুষের পক্ষে মুখের ওপর না বলাটা সম্ভব নয়। আর এতো উত্তম প্রস্তাব।অনিমেষ তাতে রাজি কবে যাবেন বলবেন।
দেখার মন নিশ্চিত চিত্ত চঞ্চল,
আর কেন বিলম্ব ভাইসব চল এবার ব্রজে চল।
যদিও কেউ কেউ আগে দুয়েক বার অনিমেষ বাবুর বাড়ি এসেছে, কিন্তু যারা আসেনি তাদেরও মনে হল সদ্য যেন বাড়িটায় প্রাণের ছোঁয়া লেগেছে, চারিদিকে একটা পরিপাটি, গোছানো ভাব।পার্থ বসু আগে একবার এসেছিলেন, কিন্তু আজ সব কিছুই নুতন সাজে সজ্জিত দেখছেন। আমিতো অবাক অনেক পরিবর্তন হয়েছেরে শম্ভু। আস্তে করে নিত্যকে বলেন, সংসার সুখের হয়..রমনীর গুনে.’
শম্ভু আর নিত্য প্রতিবাদ করে বলছে চুপ করুন আপনার মত কুচুটে আর কিপ্টে মাল দুটো হয় না মশকড়া করছেন। মনে আছে সেই ঘটনা যখন বাস থেকে গালাগাল দিয়ে আপনাকে কলার ধরে নামিয়ে মারছিল শ্যালা যুধীষ্ঠির। রতনে রতন চেনে ভাবনা কি?
কত যে পাপ ঢুকেছে এই মনে। দেখতে চাই তা এই দুনয়নে।। বুঝলে ভাই আমায় চমকে কি হবে। সব আজ ফ্ল্যাস হবে। সিন যে চলছে। মালা বদল হবে এরাতে মালা বদল হবে.....!
সুমিত্রা এর আগে কোলকাতার অফিসে কাজে অনেকবার অনিমেষের সাথে এসেছে। অনিমেষের বাড়িতে এসেছে।কিন্তু আজ কি দেখছি এত সুন্দর ঘরদোর কে গুছিয়েছে তাকে তো একবার দেখতেই চাইছে তার মন। আবার ভাবছে এত দিন কত সময় অনিমেষদার সাথে কথা বলেছি কাজ ছাড়া সাহিত্যচর্চার আলোচনা করেছি। একবার শ্রুতিনাটক করেছি।উনি তো কোন অসংলগ্ন ভাব দেখাননি যা অপরাধ হোতে পারত। তবে এই পরিস্থিতি কেন তবে কি একাকিত্ব গ্রাস করেছে দাদাকে!
প্রতিমা অনিমেষের এই বাগান বাড়িটার খোলনলচে এক্কেবারে পালটিয়ে দিয়েছে।কাজের মেয়েটি পিয়ালীর সাথে সখীর মত সব সময় কাজ আর পড়াশুনায় ব্যস্ত থাকে কাকু আসলে তার দেখভালের অভাব রাখেনা আর কয়েক বছর পর সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে যাবে এই ভেবেই আনন্দে সারাদিন কাজ আর কাজ। ঠাকুর ঘরে গোপাল যেন মাতিয়ে বসে আছেন।
প্রতিমা বাগানে কিছু করছিল, এত লোক দেখে অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। অনিমেষ মিষ্টিস্বরে ডাকলেন, প্রতিমা তাড়াতাড়ি আয়! তারপর অফিসের কলিগদের সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, সবাই বাগানেই বসছি, একটু চা বিস্কুট আর প্লেটে মিষ্টি আর চিপস্ দে
কথার মাঝেই প্রতিমা বলল, আমি সব নিয়ে আসছি। তুমি বাগানের চেয়ারে বসাও।
বুদ্ধিমতী আর লক্ষীমন্ত মেয়েটি যেতে গিয়েও ফিরে দাঁড়াল,সবার মাঝে অনিমেষকে জিজ্ঞেসা করল, তুমিও কি আরেকবার চা খাবে বাবা?”
অনিমেষ আজ এই মুহূর্তে যেন অন্য জগতে “বাবা যে ডাক এই জীবনে কোন দিন শুনতে পারবে ভাবতেই পারেনি কোন দিন।
বাবা বাবা! একি দেখছিরে একি শুনলাম!! মন মাতে যে এই শেষ বিকেলে, তৃপ্ত আমি স্বপ্ন দেখার মাঝে। হারায় নাই সব মান মিছে ভাবের কাজে, বাবার ডাকে ব্যস্ত সবাই মুখ ঢাকছে লাজে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।