মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় দেউলিয়া হলো যুক্তরাষ্ট্রের ২য় বৃহত্তম ব্যাংক
চলতি সপ্তাহের বুধবারও আর দশটি সাধারণ ব্যাংকের মতো বাণিজ্যিক ও আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিপি), যা দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক ব্যাংক
রাশিয়ার অর্থনীতিকে ধ্বংস করার মার্কিন প্রচেষ্টা হিসেবে ইউক্রেন যুদ্ধ ক্রমেই বদলে দিচ্ছে বহু ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণ। রাশিয়ার বিরুদ্ধে স্বার্থবাদী পশ্চিমা আধিপত্যের যুদ্ধ থেকে ধীরে ধীরে সরে দাঁড়াচ্ছে বিশ্ব। ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি, জ¦ালানি ও খাদ্য ঘাটতির মতো বেশ কিছু বিপর্যয়ের পাশাপাশি জাতীয় নিরাপত্তা মোকাবেলা করার জন্য জন্য বহু ইউরোপীয় দেশসহ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোও নিরপেক্ষ থাকার এবং সব পক্ষের সাথে সম্পর্ক সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে একটি শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের আহ্বান জানাতে শুরু করেছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো বরাবরই তাদের প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানির জন্য মূলত রাশিয়ার ওপর নির্ভর করে। দেশগুলোর প্রয়োজনের ৪১ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করা হয় রাশিয়া থেকেই। রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার অর্থ দেশটি থেকে জ্বালানি সরবরাহ কমানো, যা আসন্ন শীতে ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেবে সমগ্র ইউরোপকে। গেরহার্ড শ্রোয়েডার, জেরেমি করবিন, মেরিন লা পেন এবং ভিক্টর অরবানের মতো ইউরোপীয় নীতি নির্ধারকরা অনুভব করছেন যে, এই সঙ্ঘাতে জড়িয়ে তাদের ছিটেফোঁটাও লাভ নেই, বরং রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ তাদের জন্য বুমেরাংয়ে পরিণত হয়েছে।
সাবেক জার্মান চ্যান্সেলর গেহার্ড শ্রোয়েডার বলেছেন যে, এই শীতে জ্বালানি সঙ্কট এড়াতে জার্মানিকে পুতিনের সাথে একটি চুক্তি করতে হবে এবং ইউক্রেনের উচিত ক্রিমিয়ার উপর তার দাবি ছেড়ে দেয়া। তিনি বলেন, ‘ইউক্রেনের উচিত ক্রিমিয়ার ওপর দাবি ত্যাগ করা এবং পুতিনের সঙ্গে আলোচনা করা। নির্ধারিত শান্তি হিসাবে সম্ভাব্য ছাড়গুলিকে প্রত্যাখ্যান করা ইউক্রেনের একটি বড় ভুল হবে’। শ্রোয়েডার বলেন, ‘ইউক্রেনের জন্য ন্যাটো সদস্য পদের বিকল্প হিসেবে নিরপেক্ষতার মর্যাদার ভিত্তিতে অস্ট্রিয়-ধরনের এবং একটি সুইস ক্যান্টন ধরনের সমঝোতার মাধ্যমে দনবাস অঞ্চলের সমস্যাগুলি সমাধান করা যেতে পারে।
ব্রিটেনের সাবেক লেবার নেতা জেরেমি করবিন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সরকারকে ক্রেমলিনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র করার ক্ষেত্রে পশ্চিমের ভূমিকার সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘অস্ত্র ঢেলে দিয়ে কোনো সমাধান আসবে না, এটি যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করবে এবং অতিসজ্জিত করবে।’ করবিন বলেন, ‘আমরা হয়তো ইউক্রেনে বছরের পর বছর ধরে যুদ্ধের মধ্যে থাকব। আমি যা হতাশাজনক বলে মনে করি তা হ’ল, বিশ্বের নেতাদের মধ্যে খুব কমই শান্তি শব্দটি ব্যবহার করেন; তারা সর্বদা আরও যুদ্ধের ভাষা ব্যবহার করেন, এবং আরও যুদ্ধংদেহী। এই যুদ্ধ ইউক্রেনের জনগণের জন্য, রাশিয়ার জনগণের জন্য এবং সমগ্র বিশ্বের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার জন্য বিপর্যয়কর এবং তাই শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আরও অনেক প্রচেষ্টা করতে হবে’।
রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা অন্যান্য সব পরিণতির পাশাপাশি ইইউ সমর্থিত মার্কিন নেতৃত্বাধীন যুদ্ধোত্তর বৈশ্বিকব্যবস্থাকে আরও ভেঙে দিয়ে ব্যাপক বিভাজনের পথে হাঁটছে। এবং জ্বালানি বিক্রি বেড়েছে রাশিয়ায়। বেসরকারি অর্থনৈতিক নজরদারি সংস্থা ভিজ্যুয়াল ক্যাপিটালিস্ট ডট কমের সাম্প্রতিক সমীক্ষা বলছে যে, অপরিশোধিত তেল উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয় রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে তেল রফতানি করেই সবচেয়ে বেশি আয় করেছে।
রাশিয়ার অন্যান্য জীবাশ্ম জ্বালানির রফতানিও বেড়ে গেছে এবং নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে যে দুই হাজার ৫শ’ কোটি ডলারের গ্যাস রাশিয়া রফতানি করেছে, তার ৮৫ শতাংশ গিয়েছে জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডসের মতো ইউরোপীয় ইউনিয়নের বহু ন্যাটোভুক্ত দেশে এবং যুদ্ধের প্রথম ১শ’ দিনে রাশিয়ার জীবাশ্ম জ্বালানি রফতানি ৬১ শতাংশও হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নেই।
এছাড়া, রাশিয়ার জ্বালানি কিনছে চীন এবং ভারত। গত মে মাসে রাশিয়া থেকে গড়ে প্রতিদিন ২০ লাখ ব্যারেল তেল আমদানি করেছে চীন। যা আগের বছরের তুলনায় ৫৫ শতাংশ বেশি। এদিকে নিষেধাজ্ঞার পর রাশিয়া থেকে সবচেয়ে বেশি আমদানি বাড়িয়েছে ভারত। যুদ্ধের ১শ’ দিনে রাশিয়ার মোট রপ্তানি তেলের ১৮ শতাংশ কিনেছে ভারত।
এ প্রেক্ষিতে, ফ্রান্সের বিরোধীদলীয় নেতা মেরিন লা পেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁর কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন যে, তার দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম ১শ’ দিনে তিনি কার্যত কিছুই অর্জন করতে পারেননি। তিনি রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার অবসানের আহ্বান জানিয়ে বলেছেন যে, ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য মস্কোকে শাস্তি দেওয়ার পদক্ষেপগুলি কোনও কার্যকর উদ্দেশ্য পূরণ করে না এবং ইউরোপীয়দের জন্য দুর্ভোগ সৃষ্টি করছে। মঙ্গলবার একটি সংসদীয় সংবাদ সম্মেলনে লে পেন বলেন, ‘অন্যথায় ইউরোপ অকেজো হওয়ার মুখোমুখি হতে চলেছে, বিশেষত রাশিয়ান গ্যাস আমদানির প্রশ্নে। নিষেধাজ্ঞাগুলি একেবারে অকেজো। সমস্ত চেষ্টাই ইউরোপীয়দের ক্ষতিগ্রস্থ করে। এবং ঘটনাক্রমে ফরাসিরা অন্তর্ভুক্ত।’
লা পেন বলেন, ‘আমাদের সরকারের স্ফীত দাবির বিপরীতে, রাশিয়ার অর্থনীতি যে নতজানু নেই তা বুঝতে আপনার খারাপ বিশ্বাসের একটি বিশাল ডোজ দরকার। তারা দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে নেই। আমরা এই নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ানদের চেয়ে অনেক বেশি ভুগছি। তারা তাদের তেল এবং গ্যাসের জন্য অন্য ক্রেতা খুঁজে পেতে পারে, তারা নিষেধাজ্ঞা অবজ্ঞা করতে পারে’। তিনি আরও বলেন, ‘এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের ধারাবহিক ব্যর্থতার একটি নজির।’
ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো হাঙ্গেরিও রাশিয়ার শক্তির ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল, এর প্রায় ৮০ শতাংশ গ্যাস আসে রাশিয়া থেকে। তাই দেশটি রাশিয়ার গ্যাসের ওপর ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞার কঠোর বিরোধিতা করেছে। হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান শুক্রবার বলেছেন যে, তিনি আগামী মাসে রাশিয়ার সাথে একটি নতুন চুক্তি স্বাক্ষর করবেন, যা দেশটিকে প্রায় এক বিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস সরবরাহ করবে। এর আগে, ২২ জুলাই হাঙ্গেরির পররাষ্ট্রমন্ত্রী পিটার সিজ্জার্তো বলেন, ‘বর্তমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল হাঙ্গেরির জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।›
সার্বিয়া এবং বেলারুশ হল একমাত্র দুটি ইউরোপীয় দেশ যারা রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে, সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট আলেকসান্ডার ভুচিচাস মস্কোর ক্ষেত্রে একটি সতর্ক নীতি অনুসরণ করেছেন যাতে ক্রেমলিনের সাথে সার্বিয়ার সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। পশ্চিমা নেতাদের ক্ষোভের মুখে ভুসিক মে মাসে রাশিয়ান গ্যাসের জন্য আরো তিন বছরের চুক্তি স্বাক্ষর করেন। যদিও সার্বিয়া ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বকে সমর্থন করে, তবে ভুসিক অরবানের মতো যুক্তি দিয়েছেন যে, তিনি একটি ছোট দেশের নেতা এবং সার্বিয়ার জনগণের চাহিদা মেটাতে হবে, যার মধ্যে জ¦ালানীশক্তির অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সরবরাহের জন্য রাশিয়ার উপর নির্ভর করা অনিবার্য। তিনি বলেন, ‘আমাদের বাঁচতে হবে, এবং আমাদের যুক্তিযুক্তভাবে কাজ করতে হবে’।
জ্বালানি ও খাদ্য সঙ্কুট সাথে ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটি গুরুতর অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে চলেছে, যেখানে ইতিমধ্যেই আগের তুলনায় অনেক বেশি মূল্যস্ফীতি রয়েছে। মার্কিন ডলারের দর এবং সুদের হার বৃদ্ধি বিপরীতে মন্দার ঝুঁকিতে পড়েছে ইইউ।
অতএব, ডলার-প্রধান বিশ^ অর্থব্যবস্থার বিকল্প রাশিয়া, চীন এবং অন্যান্য দেশের জন্য প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে এবং এটি মার্কিন মুদ্রার মূল্যের উপর প্রভাব ফেলতে চলেছে। চীন একটি ইইউ সিবিডিসি (সেন্ট্রাল ব্যাংক ডিজিটাল কারেন্সি) তৈরি করেছে এবং রাশিয়ার সাথে তার বাণিজ্যের পরিমাণ বাড়িয়েছে। চীনের নেতুত্বে ব্রিকস দেশগুলি একটি অভিন্ন মুদ্রা ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করছে, যা বর্তমান মার্কিন ডলার-প্রধান বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থার বিকল্প হবে। মার্কিন ডলার এড়ানোর আগ্রহের আরও একটি কারণ হল যে, যুক্তরাষ্ট্র অন্য দেশগুলিকে তার নীতি অনুসরণে বাধ্য করার জন্য একটি অস্ত্র হিসাবে মার্কিন মুদ্রা এবং আর্থিক শক্তি ব্যবহার করছে।
একটি জিনিস যা বিনিয়োগকারীদের লক্ষ্য করা উচিত তা হল, সউদি আরব কীভাবে তার তেলের জন্য অর্থপ্রদান গ্রহণ করে। পেট্রোল ডলার সিস্টেম দেশটি অর্থপ্রদানের জন্য মার্কিন ডলার দাবি করে তার নিজস্ব নীতির ভিত্তিতে। সউদিরাও যদি ডলারের বিকল্প মুদ্রায় তেলের জন্য লেনদেন শুরু করলে তা বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি নতুন যুগের ইঙ্গিত দেবে। এই খেলায় উত্তর কোরিয়ার সাথে মূল খেলোয়াড় হিসেবে যোহ দেবে চীন, ইরান, রাশিয়া এবং ভেনিজুয়েলা। ডলারের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার একটি বস্তুনিষ্ঠ বিবেচনা এই উপসংহারে নিয়ে যায় যে, বর্তমান পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটবে। আজ হোক বা কাল বিশ^ ব্যবস্থায় মার্কিন ডলারের আধিপত্যের অবসান হতে চলেছে। তথ্য সূত্র : সিকিং আলফা, পলিটিকো, ফরেন পলিসি, ইউরোনিউজ, ন্যাশনাল র্যালি, দ্য গার্ডিয়ান।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।