শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ আমাদেরকে আবারো নতুন করে ভাবনায় ফেলেছে, বিশেষ করে বাংলাদেশের বর্তমান আর্থসামাজিক প্রেক্ষপটে একথা জোর দিয়েই বলা যায়, বাংলাদেশের দূর্যোগ মোকাবেলা এবং সামাজিক নিরাপত্তার যে দুর্দশাগ্রস্থ চিত্র, তার উন্নয়নে চাই গ্রামের মানবিক উন্নয়ন। চাই গ্রামায়ণ, চাই সত্যিকারের উন্নত গ্রাম বাংলাদেশ। একটি সু সমন্বিত গ্রামায়ণই পারে বাংলাদেশের অস্তিত্বকে বিশ্বে যথাযথভাবে প্রতিনিধিত্ব করতে। ফুলঝুরি উন্নয়ন স্রোতে গ্রামকে সেভাবে তৈরি করতে না পারায় আজআমরা এর প্রভাব হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। এখনই গ্রামায়ণে মনোযোগি না হলে আমাদেরকে এর কুফল ভোগ করতে হবে দীর্ঘদিন। স্বাধীনতার ৫০ বছর হতে চললো অথচ যে মহান আদর্শ এবং লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে এ দেশকে স্বাধীন করতে যে ত্যাগ আর প্রাণের মূল্য দিতে হয়েছিল তার সিকি ভাগও আমরা অর্জন করতে পেরেছি বলে জোর দিয়ে বলা যায় না। সামাজিক সুরক্ষা কাঠামো যথাযথ না থাকায় সরকারি ত্রাণসহ সকল সেবা নিয়ে চলছে হরিলুট। একটি আদর্শ গ্রাম কাঠামো থাকলে আজ এ কথা বলার অবকাশ হয়তো থাকতো না। স্বাধীনতার পরপরই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান যে গ্রামায়ণের উন্নয়ন কাঠামো নির্মানে হাত দিয়েছিলেন তা আজও অধরাই থেকে গেছে। বঙ্গবন্ধু তার বিভিন্ন ভাষণে বরাবরই বাংলাদেশের উন্নয়নে গ্রাম উন্নয়ণ আগে এ কথা জোর দিয়েই বলেছিলেন। তিনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গ্রাম উন্নয়ন কাঠামো ধরেই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গ্রামায়ণের সূচনা করেছিলেন।
এবার প্রসঙ্গ কথায় আসি, বাংলার উন্নয়ন কথা ভারতবর্ষের উন্নয়নে কবি গুরু যে কাঠামোর কথা বলেছেন তা আজও গ্রাম বাংলা তথা বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য সমান প্রযোজ্য। তাঁর বাতলে দেওয়া পথেই বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভব এবং বঙ্গবন্ধুও কবি গুরুর এ দর্শনকে গ্রহন করেছিলেন স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের উন্নয়নে। তাই এ প্রবন্ধে গ্রামায়নের স্বরুপ নিয়ে কিঞ্চিত আলোকপাতের চেষ্টা করা হবে।
তৎকালীন ভারতবর্ষীয় সমাজ ছিল দুটি ভাগে বিভক্ত। একটি ধনিক শ্রেণি, অপরটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠী । রবীন্দ্রনাথ একটি অংশকে পেছনে ফেলে অপরাংশের উন্নয়নের বিপক্ষে ছিলেন। তাঁর মানবিক উন্নয়ন ধারণাটি ছিল মূলত গ্রামীণ উন্নয়ন কেন্দ্রিক। তাঁর গ্রামোন্নয়ন ভাবনাটি ছিল সামগ্রীক উন্নয়ন ভাবনার অংশ। তিনি মনে করতেন, কৃষিভিত্তিক গ্রামের উন্নতি ব্যতিরেকে ভারতবর্ষীয় সমাজের সামগ্রীক উন্নয়ন সম্ভব নয়। যেহেতু আশি শতাংশ মানুষ ছিল কৃষিজীবি। একদিকে কৃষক সমাজের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে শহরের চাকচিক্যময় সমাজ, অপরদিকে প্রান্তিক এই জনগোষ্ঠীর জীবন যাত্রার নিন্মমান ও শিক্ষার আলোবঞ্চিত-চিকিৎসা সুবিধাবঞ্চিত-কুসংস্কারাচ্ছন্নতা ও দারিদ্র্যের চাকায় আষ্টে পৃষ্টে নিষ্পেষিত অমানবিক জীবন যন্ত্রণা জমিদার কবিকে ভাবিয়ে তুলেছিল। এই ভাবনার পেছনে কাজ করেছে তাঁর মানবিক চেতনা। তিনি চির অধিকার বঞ্চিত এই মানুষগুলিকে আত্মশক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠার অনুকুলে সেচ্চার ছিলেন। স্বদেশী সমাজ গড়ে তোলা, গ্রাম-গ্রামীণ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য তিনি স্কুল নির্মাণ, রাস্তাঘাট নির্মান, সুপেয় জলেরজন্য পুকুর খনন, স্যানিটারির সুব্যবস্থা, স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্র নির্মাণ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করেন। এসবই ছিল তাঁর সমাজনৈতিক ভাবনার অন্তর্গত মানবিক উন্নয়ন ভাবনা। এ প্রসঙ্গে বলা যায়Ñ
‘‘আজ চূড়ান্ত বিচারে মানব উন্নয়ন মানে মানুষের উন্নয়ন, মানুষের জন্য উন্নয়ন এবং মানুষের দ্বারা উন্নয়ন। ‘মানুষের উন্নয়ন‘ বলতে বুঝায় মানব সম্পদ উন্নয়ন, মানব সক্ষমতার বৃদ্ধি ও প্রসার। উন্নয়নের সুফল প্রত্যেক মানুষের জীবনে পৌঁছে দেয়ার অন্য নাম মানুষের জন্য উন্নয়ন। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি থেকে শুরু করে সব রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সুফল সমাজের প্রতিটি মানুষ যেন ভোগ করতে পারে। মানুষের দ্বারা উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণকে বোঝায়। এ অংশগ্রহণ শুধু সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য নয়,বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় যে সব দিক মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে, সে সব দিক নিয়ন্ত্রণ নয় বরং সে দিকগুলোকে প্রয়োজনবোধে প্রভাবিত করার সুযোগ প্রতিটি মানুষের থাকে। তাহলে সে মাত্রিকতাকেই মানুষের দ্বারা উন্নয়ন বলে অভিহিত করা হয়।’’
(বাদলকুমারঘোষ (১৪০৬ বাং)। বিকল্প উন্নয়নদর্র্শন; রবীন্দ্রনাথের অর্থনৈতিক চিন্তার আলোকে। বাংলাদেশ উন্নয়ন সমীক্ষা। ঢাকা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান। বার্ষিক সংখ্যা: পৃঃ১৬৮)
রবীন্দ্রনাথ জোর দিয়ে বলেন, গ্রামীণ দারিদ্র্যের মূল কারণ হলো গ্রামের মানুষের আত্মবিশ্বাসের অভাব যা তাদের সর্বদাই সরকারে মুখাপেক্ষী করে তোলে। তাই ঐক্যের মাধ্যমে গ্রামের মানুষের আত্মশক্তি জাগিয়ে তোলাকে তিনি প্রাথমিক কাজ হিসেবে চিহ্নিত করেন। তিনি কখনো বিশ্বাস করেননি শুধুমাত্র আয়ের অভাবেই দারিদ্র্য সৃষ্টি হয়। তিনি মনে করতেন যে, দারিদ্র্যের ভয় ভূতের ভয়ের মতো। কোনো দেশ ধনী কি দরিদ্র্য তা নির্ভর করে সে দেশে গরিবের অর্থ উপার্জনের উপায় বা রাস্তা আছে কিনা তার ওপর।
এখানে একথা প্রণিধনযোগ্য যে, গ্রামীণ জনগোষ্ঠির ঐক্যই হতে পারে গ্রামীণ জনগোষ্ঠির দারিদ্র্য থেকে মুক্তির অন্যতম পথ। এজন্য গ্রামকে উন্নয়নের প্রথম সোপান বা ইউনিট হিসেবে ধরেই পরিকল্পনা প্রণয়ন করা উচিত। বর্তমান সরকার গ্রামকে শহর করার যে শ্লোগানে মুখরিত করছে সেটা নিছকই রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা বলেই ধরে নেওয়া যায়। শহরায়ণের কুফল আমরা জানি, তাই গ্রামকে শহর না করে গ্রামে শহরের সুবিধা নিশ্চিত করতে পারলেই গ্রামায়ণ সম্ভব। সম্ভব প্রকৃত উন্নয়নের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন। ৬৮,০০০ গ্রামের উন্নয়ন হলেই বাংলাদেশ উন্নত হয়ে যাবে। এখানে গ্রামের উন্নয়ন বলতে গ্রামের মানবিক উন্নয়নকেই বোঝানো হয়েছে। (অসমাপ্ত)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।