শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার/চরণ-ধূলার তলে।...
বাংলা সাহিত্যের এক আশ্চর্য প্রকাশ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কেবল বহুমুখী সাহিত্য প্রতিভার জন্য শুধু নয়,তাঁর ভাষা,ভাব,বিষয়বস্তুর গভীরতার জন্যও তিনি অনন্য। সত্য, সুন্দর,কল্যাণ এই তিন বিশ্বজনীন বোধের ওপরই তাঁর সমগ্র সৃষ্টিকর্ম প্রতিষ্ঠিত। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ তাঁরই বিরল প্রতিভার সাক্ষ্য বহন করে।
গীতাঞ্জলির তর্জমা শুরু হয়েছিল ১৯১২ সালে শিলাইদহে। কুটিবাড়ীর ছাদে ছোট্ট পড়ার ঘরে রবীন্দ্রনাথ সারাদিন কাটাতেন।এখান থেকে একদিকে দেখতে পেতেন দিগন্ত বিস্তৃত অবারিত মাঠ,গলিত সোনার মতো সর্ষেফুলের সমারোহ,অন্যদিকে ছিলো রাজর্ষি পদ্মার শুকিয়ে যাওয়া শীর্ণ শাখায় কুল ঘেষে ধুধু বালুরচর। কুটি বাড়িতে এক বৈষ্ণবী মাঝে মাঝে কবির সংগে দেখা করতে আসতেন।তাঁরা দুজন জীবন,দর্শন,ধর্ম নিয়ে কথা বলতেন। বাউল দর্শনের মতো বৈষ্ণবী সরলতা কবিকে ব্যাপক প্রভাবিত করেছিলো। কবি পুত্র রথীন্দ্রনাথের মতে সেই সরলা গ্রাম্য বৈষ্ণবীর সঙ্গে কথা বলেই হয়ত ১০টি কাব্যগ্রন্থ খুঁজে খুঁজে বিশেষ কয়েকটি কবিতা বেছে নিয়ে,... ইংরেজিতে নিবেদন করেছিলেন। যা ঝড়হম ঙভভবৎরহমং নামে প্রকাশিত হয়ে নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিলো। Song Offerings এর কবিতাগুলোর উৎস : ১. গীতাঞ্জলি থেকে ৫৩টি। ২.নৈবেদ্য থেকে ১৭টি। ৩.গীতিমালা থেকে ১৫টি। ৪.খেয়া থেকে ১১টি। ৫.শিশু থেকে ৩টি এবং ৬.অচলায়তন, চৈতালি,স্মরণ, কল্পনা ও উৎসর্গ থেকে ১টি করে মোট ১০৪টি কবিতা নিয়ে ইংরেজি গীতাঞ্জলি।)
রবীন্দ্রনাথ ইংরেজি গীতাঞ্জলির পান্ডুলিপি তাঁর বন্ধু চিত্রশিল্পী উইলিয়াম রোদেনস্টাইনকে দেখাবেন বলে, কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পুত্রবধূ প্রতিমাদেবী সহ লন্ডন চলে গেলেন। প্রথম সাক্ষাতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ইংরেজি গীতাঞ্জলির পাণ্ডুলিপি রোদেনস্টাইনের হাতে দিলেন। রোদেনস্টাইন পান্ডুলিপির প্রথম পৃষ্ঠায় মন্তব্য লিখলেন-গীতাঞ্জলির মূল পান্ডুলিপি যা কবি ভারত থেকে নিয়ে আসেন সেটা অকিল পার্কে আমার সাথে প্রথম সাক্ষাতে পড়তে দিলেন। রোদেনস্টাইন খাতা ভরা নতুন কবিতাগুলো পড়ে মুগ্ধ হলেন।
কবিতাগুলো টাইপ করে রোদেনস্টাইন আইরিশ কবি ও নাট্যকার উইলিয়াম বাটলার ইয়েটসের কাছে পাঠালেন। মেইন এন্ড মেমোরি বইতে রোদেনস্টাইন লিখেছেন-ররবীন্দ্রনাথ যেসব বাংলা কবিতা নিজেই তর্জমা করেছিলেন তাঁর খাতাটি আমায় উপহার দিলেন: সেই সন্ধ্যায় আমি কবিতাগুলি পড়ে অপার আনন্দ পেলাম। আমি এই মুক্তারাশির কী মর্ম বুঝব,সেইজন্য এই তদানীন্তন কবিশ্রেষ্ঠ ইয়েটসকে এই রত্নের সন্ধান দিলাম। কবি ইয়েটস এই কবিতাগুলি পাঠ করে এমনই মুগ্ধ হলেন যে, তাঁর পল্লীনিবাস থেকে রবীন্দ্রনাথকে দেখার জন্য লন্ডন ছুটে এলেন। দুই কবির মিলনে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মিলনের বীজ রোপিত হলো। --(রোদেনস্টাইন)। রোদেনস্টাইন এক সন্ধ্যায় তাঁর বাসভবনে গীতাঞ্জলি পাঠের আয়োজন করলেন। এজরা পাউন্ড,মেসিংক্লেয়ার,সি এফ এন্ড্রোজ,আর্নেস্টে রীচ প্রমুখ গুণী কবি উপস্থিত ছিলেন। ইয়েটস আবেশ ভরা সুরেলা গলায় গীতাঞ্জলি থেকে একের পর এক আবৃত্তি করতে লাগলেন।
পরদিন বন্যার মতো প্রসংশা যুক্ত চিঠি আসা শুরু হলো রবীন্দ্রনাথের কাছে। প্রিয় মি.টেগর, চরম উৎকর্ষ ও স্বচ্ছতার সঙ্গে আপনি আমাদের ভাষায় এমন কিছু যোগ করেছেন যা কেবল ইংরেজিতে কেন,কোন পশ্চিমা ভাষায়ই আজ পর্যন্ত দেখা যায়নি। মে সিনক্লেয়ার। কবিতাগুলোর ইংরেজিটা ছিল বড় সহজাত,বড় সুরেলা।শৈশবের সমধুর ধ্বনির মত আমাকে অনেক দূরে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। সি এফ এন্ডুজ। আমাদের সময়ে এমন কাউকে জানি না যিনি ইংরেজি ভাষায় এমন কিছু রচনা করেছেন যার সঙ্গে এই গীতিকবিতা গুলোর তুলনা চলে। উইএলিয়াম বাটলার ইয়েটস।
১৯১২ সালের ১০ জুলাই,বুধবার। লন্ডনের ইন্ডিয়া সোসাইটি অভিজাত রেস্তোরাঁয় এক সংবর্ধনার আয়োজন করলো।প্রায় ৭০ জনের মতো অতিথি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আমন্ত্রিত অতিথিদের সামনে রবীন্দ্রনাথ তাঁর গীতাঞ্জলির কবিতাগুলো শুনালেন। সে বছরই লন্ডনে ইন্ডিয়া সোসাইটির উদ্যোগে ইংরেজি গীতাঞ্জলি ঝড়হম ঙভভবৎরহমং প্রকাশিত হলো। (পরবর্তীতে ম্যাকমিলান কোম্পানি এই গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণ একযোগে লন্ডন ও নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশ করে)। ডব্লিউ বি ইয়েটস তাতে এক দীর্ঘ ভুমিকা ও রোদেনস্টাইন অংকিত কবির একটি পেন্সিল স্কেচ সংযুক্ত করেন। বিলেতের কাগজে কাগজে গীতাঞ্জলির উচ্ছ্বসিত প্রসংশা ছড়িয়ে পড়ল।এজরা পাউন্ড লিখলেন, কবিতাগুলো কথিত আধুনিক ধারা থেকে সতন্ত্র, এখানে প্রকৃতি আছে তার নৈশব্দ নিয়ে এবং কবির ধর্মবোধ, যেমনটা ছিলো তান্ত্রিক।
মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্কটা অবিচ্ছেদ্য অংশ, নেমনটা বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্টে পাওয়া যায়। গীতাঞ্জলির কবিতার মধ্যে প্রাচ্যাত্যের মানুষ শান্তি, প্রেম, মৈত্রী আর ঈশ্বর ভাবনার এক নতুন সুর পেয়েছে ১৯১৩ সাল। সে বছরে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য ইংল্যান্ডের পক্ষ থেকে রয়েল সোসাইটি অফ দ্যা লিটারেচার অফ দ্যা ইউনাইটেড কিনডম ইংরেজ কবি ও ঔপন্যাসিক টমাস হার্ডি এঁর নামটি সুপারিশ করে, কিন্তু এই সিদ্ধান্তের সাথে একমত হতে পারেন নি- কবি,নাট্যকার, চিত্রশিল্পী টমাস স্টার্জ মুর। রয়েল সোসাইটির একজন সদস্য হিসেবে তিনি এককভাবে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য রবীন্দ্রনাথের নাম প্রস্তাব করেন। নোবেল কমিটির কাছে আরেকজন ব্যক্তির বক্তব্য বেশ গুরুত্ব পেয়েছিল তিনি সুইডিশ কবি ভারনার ডন হেইডেনস্টাম। তিনি বলেন গীতাঞ্জলির কবিতাগুলোর ভেতর দিয়ে আমাদের কালের শ্রেষ্ঠতম কবিদের একজনের সঙ্গে পরিচয় লাভ করা সম্ভব।কবিতাগুলো পাঠে মনে হয়,যেন নির্মল, স্বচ্ছ ঝরনাধারার জল পান করছি।কবির অনুভূতিতে যে তীব্র ঈশ্বরপ্রেম ও ধর্মানুভূতি পরিব্যাপ্ত এবং তাঁর রচনা রীতিতে যে মহৎ ও অকৃত্রিম উচ্চতা লক্ষণীয় তা গভীর ও দুর্লভ আধ্যাত্মিক সৌন্দর্যের একটি ধারণা তৈরি করে।
কোনো কবি সম্পর্কে যদি বলতে হয় যে, তিনি নোবেল পুরস্কারের যোগ্য, তাহলে সেই কবি হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।’
অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, ১৯১৩ খৃষ্টাব্দের ১৩ নভেম্বর।নোবেল কমিটি সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের নাম ঘোষণা করে।গোটা এশিয়া মহাদেশে এর আগে কেউ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান নি।নোবেল প্রদানপত্রে তাঁরা উল্লেখ করলেন-’ বিদ্যমান ব্যস্ততা ও অস্থির ছোটাছুটিতে দুর্বল হয়ে যাওয়া সংস্কৃতির বিপরীতে রবীন্দ্রনাথ একটি বিপুল ও শান্তিপূর্ণ সংস্কৃতিকে আমাদের সামনে উপস্থিত করেছেন।তাঁর কবিতায় তিনি ইউরোপীয়দের এই বলে আশ্বস্ত করতে চেয়েছেন যে,শান্তি অপেক্ষমান।’
রবীন্দ্রনাথ মানবতার কবি,প্রকৃতির কবি।পৃথিবীর রূপ- মাধুর্যকে তিনি আকণ্ঠ পান করেছেন।সীমার মাঝে অসীমকে খুঁজেছেন।তাঁর রচিত গীতাঞ্জলি (Song Offerings) বাঙালির শিল্প-সাহিত্যকে বিশ্ব-দরবারে এক অনন্য মর্যাদার আসনে উন্নীত করেছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।