Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চীনের উত্থানের সাথে কমছে পশ্চিমের আধিপত্য

একগুঁয়েমি যুক্তরাষ্ট্রের পতন ত্বরান্বিত করছে

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২৮ জুলাই, ২০২২, ১২:০৪ এএম

বৈশ্বিক আধিপত্য রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে রাশিয়া এবং চীন উভয়কেই মোকাবেলার পাশাপাশি একটি ক্রমবর্ধমান যুদ্ধ-ক্লান্ত ইউরোপ এবং পক্ষ নিতে অনিচ্ছুক একটি উন্নয়নশীল বিশ্বের মুখোমুখি। তবে, দেশটির অভ্যন্তরীণ সামাজিক ও রাজনৈতিক ফাটল এবং ভাঙা অবকাঠামো ক্রমবর্ধমান বহুমুখী বিশ্বের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

ইতোমধ্যে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে ইউরোপ যে ব্যাপক উদ্দীপনা নিয়ে মার্কিন নেতৃত্বে হম্বিতম্বি শুরু করেছিল, তা হ্রাস পেতে শুরু করেছে। অঞ্চলটিতে ভেঙেপড়া সরবরাহ ব্যবস্থার মধ্যে জ্বালানি এবং খাদ্যের ঘাটতি দেখা দিয়েছে এবং কয়েক দশকে দেখা যায়নি এমন মাত্রায় মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে। সামনের শীতে ইউরোপ গ্যাস ঘাটতিরও আশঙ্কা করছে। এরমধ্যে, রাশিয়াকে জব্দ করার উদ্দেশ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাম্প্রতিক সউদী আরব সফর অর্থবহ স্বস্তি নিয়ে আসেনি, কারণ বৃহত্তর আঞ্চলিক স্বার্থে ওপেক’র (অর্গানাইজেশন অফ পেট্রোলিয়াম এক্সপোর্টিং কান্ট্রিজ) স্থিতিশীল সরবরাহ নীতিগুলো অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। তারপরেও বৈশি^ক নেতৃত্ব ধরে রাখার জন্য রাশিয়া ও চীনকে মোকাবিলা করতে বদ্ধপরিকর যুক্তরাষ্ট্র।

মার্কিন প্রশাসন নিজের উদ্দশ্যকে ‘গণতন্ত্র ও স্বৈরাচার’র মধ্যে একটি বৈশ্বিক সংগ্রাম হিসেবে উপস্থান করে আসলেও ১০টি কারণে তার উদ্দেশ্যে অসফল হবে যুক্তরাষ্ট্র। প্রথমত, ইউরেশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে বেছে নিতে বাধ্য হতে চায় না। সর্বোপরি, বিশ্বজুড়ে ১শ’ ৩০টি দেশ চীনকে তাদের বৃহত্তম ব্যবসায়িক অংশীদার হিসাবে গণ্য করে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে রয়েছে মাত্র ৫৭টি দেশ।

দ্বিতীয়ত, ওসিইডি (অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) দেখেছে যে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্ব অর্থনীতির ৫৭ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করবে ওসিইডি’র বাইরের দেশগুলো। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে উন্নয়নশীল বিশ্বের বৃহত্তম ব্যবসায়ী, প্রস্তুতকারক এবং সংযোগকারী হিসাবে চীন এ পরিবর্তনের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে।

তৃতীয়, চীনের কথিত ‘ঋণ ফাঁদের কূটনীতি’ এবং পরিবেশগত, সামাজিক ও পরিচালনা ঘাটতি সত্ত্বেও ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড গ্রিন এনার্জি ফাইন্যান্স এবং ইনভেস্টমেন্ট’ ২০২০ সালের ৬.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ২০২১ সালে ৬.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে।

চতুর্থ, ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’র প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ‘গ্লোবাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টে’র জন্য জি৭ এর সর্বশেষ অংশীদারিত্ব খুবই কম। এটি পাঁচ বছরে সমস্ত জি৭ দেশগুলো থেকে ৬শ’ বিলিয়ন ডলারের বাজেট পেয়েছে। সেই তুলনায়, ২০২১ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে, মোট বেল্ট এবং রোড প্রকল্পগুলির বরাদ্দ প্রথমবারের মতো ৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে, যা বার্ষিক প্রায় ৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে যেয়ে ঠেকেছে।

পঞ্চম, চীন আঞ্চলিক ব্যাপক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের (আরসিইপি) অর্থনৈতিক কেন্দ্রে রয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী জিডিপির এক তৃতীয়াংশ এবং বিশ্বের জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশের প্রতিনিধিত্ব করে। আরসিইপি’র বিপরীতে ওয়াশিংটন একটি বৃহত্তর ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক (আইপিইএফ) গঠন করেছে, যা বাণিজ্য, ডিজিটাল সংযোগ, সরবরাহ ব্যবস্থার স্থিতিস্থাপকতার জন্য উচ্চতর মান এবং অবকাঠামোগত বিনিয়োগের উদ্দেশে আরসিইপি’র বেশিরভাগ মার্কিন-বন্ধুত্বপূর্ণ সদস্য দেশগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। তবুও, বাস্তব বাজারে বেশিরভাগ অংশীদার চীন থেকে বিচ্ছিন্ন হতে না চেয়েই যোগ দিয়েছে।

ষষ্ঠ, যুক্তরাষ্ট্রের ডি১০ এর আহ্বান ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া এবং অস্ট্রেলিয়াকে উন্নত দেশগুলোর জি৭ জোটে যুক্ত করেছে। যদিও সবাই তাদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে রক্ষা করতে এবং প্রচার করতে চায়, তবে, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি এবং ইতালিসহ তাদের বেশিরভাগ দেশ চীন থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হতে বা এটিকে চিরশত্রু হিসাবে দেখতে চায় কিনা, তাতে সন্দেহ আছে।

সপ্তম, চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জগুলো পরিদর্শন করেছেন এবং সলোমন দ্বীপপুঞ্জের সাথে একটি নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষর করে একটি অভূতপূর্ব উদ্যোগ নিয়েছেন। এর জবাবে মার্কিন ভাইস-প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে ফিজিতে একটি প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ ফোরামে বক্তৃতা করার জন্য তাড়াহুড়ো করে পাঠানো হয়েছিল, যাতে তিনি জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন, অবৈধ মাছ ধরার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং মহাসাগরের বাস্তু সংরক্ষণের জন্য ১০ বছরে ৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের উন্নয়ন সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেন।
অষ্টম, একটি উদীয়মান চীন-বিরোধী মার্কিন জোটের প্রতিক্রিয়ায় চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং একটি ‘বৈশ্বিক নিরাপত্তা উদ্যোগ’ প্রবর্তন করেছিলেন, যা সমস্ত জাতির আঞ্চলিক অখণ্ডতা, অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা এবং প্রতিটি জাতির অধিকারের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। নিজস্ব সমাজ ব্যবস্থা এবং বিকাশের পথ বেছে নেওয়ার জন্য এটি বহু শতাব্দী ধরে পশ্চিমা আধিপত্যে অভ্যস্ত উন্নয়নশীল বিশ্বের কাছে অত্যন্ত মধুর।

নবম, চীন ও রাশিয়া উভয়ই সাম্প্রতিক ভার্চুয়াল সম্মেলনে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকা নিয়ে গঠিত ব্রিকস জোটের সম্প্রসারণের প্রস্তাব করেছে, যা ল্যাটিন আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং এশিয়ায় বিদ্যমান বাণিজ্য অংশীদারিত্বকে একত্র করে উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে ‘দক্ষিণ-দক্ষিণ’ সহযোগিতার প্রসার করা। সম্মেলনে সংযুক্ত আরব আমিরাত, সউদী আরব, মিসর, কাজাখস্তান, ইন্দোনেশিয়া, নাইজেরিয়া, সেনেগাল থাইল্যান্ড এবং আর্জেন্টিনার প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন।

অবশেষে, যুক্তরাষ্ট্রের জবরদস্তিমূলক ও বিভাজনমূলক কৌশল, ভণ্ডামি, নির্বিচারে ডলারের অস্ত্রায়ণ এবং দ্বিমুখী নীতির প্রবণতা বহু বিরক্তি ও ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন যে, ইউক্রেন যুদ্ধ দেখায় যে, চীনের উত্থানের সাথে সাথে পশ্চিমের আধিপত্য শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাকে সঠিক বলেই বলে মনে হচ্ছে। সূত্র : সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট।



 

Show all comments
  • হামজা ২৭ জুলাই, ২০২২, ২:৪৫ এএম says : 0
    সারা বিশ্ব এক সময় চীন ও রাশিয়া নেতৃত্ব দিবে।
    Total Reply(0) Reply
  • হামজা ২৭ জুলাই, ২০২২, ২:৪৬ এএম says : 0
    যুত্তরাষ্ট্রের একঘেয়েমীর কারণেই বিশ্ব থেকে তাদের পরিণতি হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • হামজা ২৭ জুলাই, ২০২২, ২:৪৭ এএম says : 0
    আমরা চাই বিশ্বে পরাশক্তি দেশগুলোর মাঝে সহাবস্থান থাকুক। যাতে বিশ্বে শান্তি থাকে।
    Total Reply(0) Reply
  • ইমরান ২৭ জুলাই, ২০২২, ২:৪৯ এএম says : 0
    যুক্তরাষ্ট্রের জবরদস্তিমূলক ও বিভাজনমূলক কৌশল, ভণ্ডামি, নির্বিচারে ডলারের অস্ত্রায়ণ এবং দ্বিমুখী নীতির প্রবণতা বহু বিরক্তি ও ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে বিশ্বে।
    Total Reply(0) Reply
  • ইমরান ২৭ জুলাই, ২০২২, ২:৫০ এএম says : 0
    ইউক্রেন যুদ্ধ দেখায় যে, চীনের উত্থানের সাথে সাথে পশ্চিমের আধিপত্য শেষ হয়ে যাচ্ছে। এতেই বুঝা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা কমে যাচ্ছে
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চীন


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ