শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
আমার কপাল পুড়ল গো, আমার কপাল পুড়ল!
খোদার দুনিয়াত এত দালান কোঠা থাকতে কি আমার ভাঙা ঘরটাই তাঁর চোখে পড়ল! বন্যার বান তুফানে এমন কইরা আমার ঘরখান ভাইঙা দিল! অহন ক্যামন কইর্যা আবার ঘর বানামু; ঠিকমতন খাইতেই পাই না!
দুখের দুনিয়ায় অভাগী মোমেনার কান্না শোনার কেউ নাই! যিঁনি সবই শোনেন ও দেখেন, তিঁনিই তো নির্বাক চোখ বন্ধ কইরা রাখেন!
মোমেনার যক্ষের ধন বাবর তো আর চুপ মেরে থাকতে পারে না; মাটিতে লুটিয়ে পড়া মায়ের পাশে এসে দাঁড়ায় বাবর, তুমি কাইন্দো না মা; এর চাইতেও বড় ঘর বাইন্ধা দ্যমু তোমারে! ঘর গেছে তাতে কী, জান তো যায় নাই; বানের স্রোতে জমির ধান গেছে, ঘর ভাইঙা দিছে তাতে কী অইছে, বাঁইচা থাকার মনের জোর তো আর ভাইঙা দিতে পারে নাই। মোমেনার কান্নার সুর আরো চাগিয়ে ওঠে, হায় খোদা! তুমি এইডা কী করলা! এমন কইরা আমার কপাল ভাইঙা দিলা! আমার লাইগা কী তোমার এইটুকুও দয়ামায়া নাই? বর্ষার শুরুতে আচমকা ঝড় ও প্রবল বানে লোকালয় লণ্ডভণ্ড! ঝড় ও বৃষ্টির বিরাম নেই, থেমে থেমে দম্কা হাওয়া; যেভাবে নদীর পানি বাড়ছে, না জানি বন্যায় সব তলিয়ে নিয়ে যায় কি-না কে জানে! মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত! একদিনেই পানি নদীর তীর ডিঙ্গিয়ে ফসলের ময়দান ডুবিয়ে দিয়েছে; জমির ধান কচিতেই নষ্ট! বাড়ি-ঘর ছেড়ে মানুষ ছুট লাগায় নিরাপদ আশ্রয়ে, শহরের দিকে!
বিলাসপুর, শ্রীপুর, বটতলীসহ আশপাশের গ্রামগুলোর বাড়ি-ঘর ভেঙে তছনছ; ঘরের চালের ওপর দিয়ে জলের দুরন্ত প্রবাহ; ভেঙেছে দুখি মানুষের কপাল। মানুষ আশ্রয় নিতে শুরু করেছে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা-মক্তবে! বেঁচে থাকার নিত্য যুদ্ধের পাশাপাশি মানুষ মেতে ওঠেছে প্রাণ বাঁচাবার লড়াইয়ে! পুত্রকে জড়িয়ে ধরে ককিয়ে ওঠে মোমেনা, বাজান রে! কত কষ্ট কইরা আমাগো খাওন-পড়নের বন্দোবস্ত করছ, অহন ঘর বানাবি ক্যামনে?
অহন কান্দার আর সময় নাই, আগে জান বাঁচাইতে হইব। যেইভাবে গাঙের পানি ফুইলা ওঠছে, রাইতের মধ্যে গেরামই ডুইবা যাইব।
বিস্ময় ও আতঙ্কের ছাপ মোমেনার চেহারায়, কস্ কী বাজান?
মানুষ ব্যাকুল-মনে ছুটে চলছে শহরের দিকে! প্রাণ বাঁচাবার উর্ধ্বশ্বাসে। সাময়িক আশ্রয়ের অন্বেষণে ছুটেচলা মানুষের মধ্যে তুমুল লড়াইÑ কে, কার আগে আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে জায়গা দখল করবে! পানি, আর অতিরিক্ত বৃষ্টির ফলে নদীতে পানির মহা-উন্মাদনা! দুকূল উপচিয়ে পানি তীরবেগে ছুটছে লোকালয়ের দিকে। ঢেউয়ের তর্জন-গর্জনে মমতাময়ী সুরমা যেন রূপ নিয়েছে হিংস্র দানবে! বাবর, অহনো বাড়িতে বইসা রইছো বেটা? জলদি ঘর ছাড়ো, গফুরের নৌকা ছাইড়া দিতাছে, জলদি না ওঠতে পারলে, বন্যার পানিতে ডইবা মরবা; গহরপুরের লোকজন গেরাম ছাইড়া শহরে চইলা যাইতাছে; মুনছরের হাঁকে চমক ভাঙে মোমেনার, বাজানরে, তর মুনছর চাচায় কয় কী?
হ্, চাচায় ঠিকই কইতাছে মা; জলদি চলো, আগে জান বাঁচাই!
বস্তা মাথায় দু’কাধে দুই সন্তান বসিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে শহরের দিকে ছুট লাগিয়েছে কাঠমিস্ত্রি মুনছর। শঙ্কিত চোখের কোণে টলমল করছে অভাগী মোমেনার অশ্রু, এহন কই যাবি বাজান?
তুমি জলদি দুলালরে লইয়া ঘাটে আসো, আমি নৌকার পানি সেঁইচা মাঁচা বিছাইতাছি! মোমেনার ছয় বছরের ছেলে দুলাল। মুখে বাপ ডাক উচ্চারিত হওয়ার আগেই হতভাগা ইব্রাহিম সুরমার পানিতে ডুবে মারা যায়, গভীর রাতে; মাছ ধরতে গিয়েছিল, আর ঘরে ফিরেনি; লোকে কয়Ñ প্রেতাত্মারা চুবাইয়া মারছে ইব্রাহিমরে। বাপের পৈতৃক পেশা জেলেগিরির ওপর ভর করে আছে মা ও একমাত্র ভাই দুলালের অন্ন বস্ত্র ও বাসস্থান।
শহরে এসে লোকমুখে জানা গেলÑ সরকারি স্কুল ছাড়া আর কোথাও জায়গা খালি নেই। বাবর তড়িঘড়ি করে স্কুলের মাঠে এসে দাঁড়ায়, আশাহত চোখে তাকিয়ে থাকে আশ্রয়হীন মানুষের দিকে! এখানেও আর লোক জায়গা দেবার মতো স্থান নেই। অনেকেই নিরুপায় হয়ে বারান্দায়, এখানে-সেখানে যত্রতত্র আশ্রয় নিয়েছে।
গাছতলায় গিয়ে বোঝাটি নামিয়ে, মাকে দাঁড় করিয়ে আশ্রয়ের সন্ধানে সামনে এগোয় বাবর। ঘুরে ঘুরে স্কুল ভবনের পাশে গিয়ে শোনতে পায়, ছাদে কিছু লোকের জায়গা এখনো খালি আছে। ত্বরিত মা ও দুলালকে নিয়ে ছাদের ওপরে ওঠে বাবর। ছাদের শেষপ্রান্তে একটু জায়গা খালি পেয়ে, বোঝাটি মাথা থেকে নামিয়ে কোনোমতে সামান্য জায়গা দখল করে বসে।
শহরের স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার আঙিনায় দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের হা-হাকার! কে শোনবে কার অসহায় আর্তি! আশ্রয়ের জায়গা নাই কোথাও। জীর্ণ ভবনের ছাদে গিয়ে সামান্য জায়গা দখল করে বসে সোলেমান।
মানুষের হইচই আর অপরিচ্ছন্ন দুর্গন্ধ বিগড়ে ওঠে মোমেনা, বাজানরে, আমাগোরে কই লইয়া আইলি? এইখানে ক্যামনে থাকমু?
কোনোমতে জীবন বাঁচাও মা! সবার যেই গতি, আমাগোও তাই অইব।
মাথার ওপর একটি পলিথিনের ছাউনি দিয়ে, ফ্লোরে পুরনো কাঁথার বিছানা বিছিয়ে মাকে বসিয়ে সোলেমান বলে, আমি এখন যাই মা। কই যাবি তুই? খাওনের বন্দোবস্ত করতে হইব! দেহি গাঙে গিয়া মছ ধরন যায় কিনা? না রে বাজান, এমন বান-তুফানে তুই মাছধরা যাওনের কোনো দরকার নাই; দুই এক দিন না খাইয়া থাকলে কেউ মরে না। আকাশে মেঘের ঘনঘটা! দক্ষিণ প্রান্ত থেকে মেঘরাশি উন্মত্ত বেগে ছুটে চলছে উত্তর প্রান্তে! আকাশে, ডাঙ্গায় সবর্ত্রই জলের দুরন্ত দাপট! জীবকূল সেই দাপটের ব্যূহ ভাঙার সাধ্য কই! জলের অপর নাম যে কেবল জীবন তা-ই নয়, মরণও! বন্যার জলের অতলে অসহায় লোকালয়। গৃহহারা মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে মানবেতর জীবন যাপন করছে! খাদ্য, পানি, চিকিৎসার সঙ্কটে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে নানাবিধ রোগে।
যারা আশ্রয়কেন্দ্রে জায়গা পায়নি, ওরা বাঁচার তাগিদে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে ব্রীজ কিংবা উঁচু রাস্তুার পাশে! অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অনেকেই ডায়েরিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। পানিতে ভেসে বেড়ানো ময়লা ও বর্জ্য পদার্থ পঁেচ রোগ বিস্তার করছে! আর নিত্য মানুষের বর্জ্য ও মলমূত্র তো আছেই! দুদিন আশ্রয়কেন্দ্রে মানবেতর জীবন যাপনের পর থেকে মোমেনা অসুস্থ হয়ে পড়ে, শর্দিকাশিতে; শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। কথা বলতে কষ্ট হয়ে পড়ে মোমেনার। দিশেহারা হয়ে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় ওকে।
বয়সের সাথে সাথে মোমেনার শ্বাসকষ্টও শেকড় গেড়ে বসেছে; বহু চিকিৎসার পরও সেরে ওঠেনি। হাসপাতালগুলোতেও অসহায় পরিবেশ। কোনো শয্যা খালি তো নেই-ই বরং ফ্লোরে, বারান্দায় মানুষ পড়ে আছে অবহেলিত জীবের মতো; মৃত্যুর অপেক্ষায় স্বজনদের আহাজারি।
দুদিন ফ্লোরে চিকিৎসার মধ্যদিয়ে মোমেনার শ্বাসকষ্টের অবনতি ঘটতে থাকে; বাকরুদ্ধ হয়ে কেবল অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকে বাবরের দিকে। চারদিকে মৃত্যুর মিছিল; একদিকে শবের বিদায়, অন্যদিকে নতুন রোগি হাসপাতালের আঙিনায় মৃত্যুর অপেক্ষায়। যমদূতও যেন ক্লান্ত হয়ে পড়ছে।
তখনো ভোরের আলো ফুটে ওঠেনি! প্রাণহীন মায়ের বুক জড়িয়ে চিৎকার করে ওঠে দুলাল, মা, মা গো..
মোমেনা দুনিয়া ছেড়ে মুক্তি পেয়েছে; কিন্তু ওর শবকে মুক্তি দেয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে বাবর। কোথায় তাকে সমাহিত করবে? এলাকার সব শশ্মান, গোরস্থান বন্যার পানির নিচে।
কত মানুষের শব ভেসে বেড়াচ্ছে জলের ওপর দিয়ে, ঢেউয়ের তালে বিদায়ের কীর্তন গেয়ে। হাসপাতালের গেটে মৃত মায়ের শব নিয়ে দাঁড়িয়ে দিশেহারা হয়ে অসহায় চাহনিতে তাকিয়ে কাঁদতে থাকে বাবর, কোথায় নিয়ে সমাহিত করবে মৃত মাকে, নাকি জলের স্রোতে ভাসিয়ে দিবে..?
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।