Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামবিদ্বেষের কারণে বিপাকে ভারত

সরদার সিরাজ | প্রকাশের সময় : ১৬ জুন, ২০২২, ১২:০২ এএম

বিজেপির রাষ্ট্রীয় মুখপাত্র নুপুর শর্মা ও দিল্লির মিডিয়া ইন চার্জ নবীন কুমার জিন্দাল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, ইসলামের শেষ নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) এবং তার স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) সম্পর্কে কটূক্তি করায় বিশ্বের সব মুসলমান ও মুসলিম দেশ চরম ক্ষিপ্ত হয়েছে। ওআইসি বলেছে, বিজেপি ভারতে ইসলামের প্রতি তীব্র ঘৃণা ও অশ্রাব্য ভাষায় আক্রমণ ছড়িয়ে দেয়ার প্রেক্ষাপটে ক্ষমতায় এসেছে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে এসব অপকর্মের অনুশীলন করে যাচ্ছে। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, বিজেপি নেতাদের মন্তব্যের কারণেই ভারতে বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ভারত সরকার ব্যর্থ হয়েছে। জাতিসংঘ বলেছে, আমরা দৃঢ়ভাবে সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সহনশীলতাকে উৎসাহিত করি। বহু মুসলিম দেশ তাদের দেশস্থ ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে তলব করে তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। অনেক মুসলিম দেশ ভারতের পণ্য বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে। অনেক দেশে ভারতীয় পণ্য বর্জন করার দাবি উঠেছে। এসব সর্বাধিক হচ্ছে ভারতের বাণিজ্য ও রেমিট্যান্সের প্রাণকেন্দ্র মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোতে। ফলে ভারত চরম বিপাকে পড়েছে। এ দেশগুলো ভারতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে ৮৯ লক্ষ ভারতীয় প্রবাসী রয়েছে, যাদের প্রেরিত রেমিট্যান্সের পরিমাণ প্রায় ৮৫ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া, তেল-গ্যাসেরও জোগান বেশি আসে সেখান থেকে। অন্য পণ্যের আমদানি-রফতানির পরিমাণও ব্যাপক। ভারত বছরে প্রায় ১০০ কোটি ডলারের চলচ্চিত্র রফতানি করে, যার প্রধান বাজার মধ্যপ্রাচ্য। উপরন্তু কাতারে সফররত ভারতের উপরাষ্ট্রপতির পূর্বনির্ধারিত আনুষ্ঠানিক মধ্যাহ্নভোজ বাতিল করে কাতার সরকার। দেশটি জানিয়েছে, কাতারে বিশ্বকাপ ফুটবল দেখতে ইচ্ছুক ভারতীয়দের ভিসা বাতিল করা হচ্ছে। কোনও ভারতীয় দর্শককে কাতারে ঢুকতে দেয়া হবে না। মিসরের আল-আজহার আল-শরিফ এক বিবৃতিতে নবী (সা.)কে নিয়ে কটূক্তিকে ‘সন্ত্রাসী আচরণের’ সাথে তুলনা করে বলেছে, এমন আচরণ পুরো বিশ্বে ভয়াবহ সঙ্কট তৈরির উসকানি। ‘কিছু কট্টর লোকজনের ভোটের জন্য ইসলামের এমন অবমাননা উগ্রবাদের সমার্থক। এর ফলে বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণা ও অবিশ্বাস জন্ম নেবে’। গত ১২ জুন রাতে ভারতের বেশ কয়েকটি সরকারি ও বেসরকারি ওয়েবসাইট হ্যাক করা হয়। মালয়েশিয়ার ড্রাগন হ্যাকাররা এর দায় নিয়ে বলেছে, তোমাদের ধর্ম তোমাদের কাছে, আমাদের ধর্ম আমাদের কাছে। কোনো ধর্মের অবমাননা সহ্য করা হবে না। লন্ডনেও মুসলমানদের বিশাল প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে। তাতে নুপুর ও জিন্দালকে গ্রেপ্তার করে বিচার অন্যথায় ভারতের পণ্য বর্জনসহ বয়কটের আহবান জানানো হয়েছে। আরো অনেক অমুসলিম দেশেও মুসলমানরা নুপুর-জিন্দালের বিচারের দাবিতে সমাবেশ করছে।

বাংলাদেশেও উক্ত ঘৃণ্য ঘটনার ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। বিএনপি এর তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। এছাড়া দলটির এমপি হারুনুর রশীদ জাতীয় সংসদে ঢাকাস্থ ভারতের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানানোর এবং এ ঘটনায় জাতীয় সংসদে নিন্দা প্রস্তাব আনার দাবি জানিয়েছেন। ইসলামপন্থীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক বিক্ষোভ সমাবেশ করে তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছে। অনেকেই ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছে। শিক্ষার্থীরাও এ ঘটনার তীব্র নিন্দা করে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিবাদ এবং সংসদে নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণের দাবি জানাচ্ছে। সিলেটের পরিবহন শ্রমিকরাও নগরীতে শতাধিক গাড়ি নিয়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে। সিলেটে গত ১৪ জুনে স্মরণকালের বৃহত্তম সমাবেশে বক্তারা বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইহ-পরকালীন শান্তির অগ্রদূত। কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ তার বিরুদ্ধে কটূক্তি করতে পারে না। নবীজি (সা.) এর অবমাননা কোনো সভ্য মানুষ মেনে নিতে পারে না। তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘রাসুল হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর অবমাননা যেখানেই হোক, আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই। প্রতিবেশী দেশে যারা এ ধরনের বক্তব্য দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ভারত সরকার আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছে, এ জন্য ভারত সরকারকে ধন্যবাদ।’


ভারতেও মুসলিমরা চরম ক্ষিপ্ত হয়েছে নবী করিম (সা.)কে কটূক্তি করায়। তারা সমগ্র দেশে ব্যাপক বিক্ষোভ সমাবেশ করছে। কোথাও কোথাও সহিংসতা সৃষ্টি হওয়ায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। তাতে এ পর্যন্ত ২ জন নিহিত ও ১০ জন আহত হয়েছে। ওদিকে কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেসসহ অনেক দল নুপুর-জিন্দালের ঘৃণ্য অপরাধের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি নুপুর ও জিন্দালকে গ্রেফতারের দাবি জানিয়ে বলেছেন, বিজেপি দেশকে ভাগ করার চক্রান্ত করছে, দেশে সা¤প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ানোর চেষ্টা করছে। এর ফলে গোটা বিশ্বে ভারতের ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ হচ্ছে। কিন্তু বিজেপির পাপের কষ্ট জনগণ ভোগ করবে কেন? পক্ষান্তরে ইউপির মুখ্যমন্ত্রীর মিডিয়া উপদেষ্টা মৃত্যুঞ্জয় কুমার ও হরিয়ানা বিজেপির আইটি সেলের প্রধান অরুণ যাদব মুসলিম বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘পাথর ছোঁড়ার পাল্টা হতে পারে বুল ডোজার। ইতোমধ্যেই কানপুরের বিক্ষোভের মূল নেতার বাড়ি বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেয়া হয়েছে। পরের দিনও দুই মুসলমানের বাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে বুলডোজার দিয়ে। উপরন্তু কয়েকশ’ মুসলিমকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ প্রশাসনকে যে কোনও ধরনের অবৈধ বিক্ষোভের চেষ্টা গুঁড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আর উপমুখ্যমন্ত্রী ব্রজেশ পাঠক বলেছেন, সমস্যা সৃষ্টিকারী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বুলডোজারের ব্যবহার অব্যাহত থাকবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক বিবৃতিতে বলেছে, বিক্ষোভ দমনে ভারত সরকার যেন অবিলম্বে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ থেকে বিরত হয়। এছাড়া, মিম প্রধান আসাদুদ্দিন ওয়াইসি বলেন, আদিত্যনাথ এখন এলাহাবাদ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির মতো আচরণ করছেন। আর পন্ডিতদের অভিমত হচ্ছে: অমিত শাহকে টপকিয়ে মোদীর স্থলাভিষিক্ত হওয়ার লক্ষ্যেই যোগী আদিত্যনাথ উগ্রতা বাড়িয়েই চলেছেন। কারণ, কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের মধ্যে যে যত বেশি ইসলাম ও মুসলিম বিরোধী, সে তত বড় পদ পায় বিজেপি ও তার ঘারানার দলগুলোতে! যা’হোক, বুলডোজার দিয়ে মুসলিমদের বাড়ি-ঘর ভেঙ্গে দেওয়ার পরও নবী করিম (সা.)কে কটূক্তি করার প্রতিবাদ-বিক্ষোভ সমাবেশ বন্ধ হচ্ছে না। গত ১৩ জুনও দেশটির বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে। এসব খবর প্রতিদিনই বিশ্ব মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচারিত হচ্ছে। উল্লেখ্য যে, ভারতে মোট জনসংখ্যার ১৫% মুসলিম, যাদের মোট সংখ্যা ২০ কোটির অধিক, যা বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বাধিক।

পরিস্থিতির ভয়াবহতা অনুভব করে বিজেপি সংশ্লিষ্ট দুই নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে। তাদের বিরুদ্ধে এফআইআর করেছে পুলিশ। দলটির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ বলেছেন, ইসলামের মহানবীকে অবমাননা করা দলের মূল নীতি নয়। কিন্তু তাই বলে বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের মধ্যে যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে, তা নিভে যাবে না। কারণ, প্রতিটি মুসলমান আল্লাহ এবং তার পিয়ারে দোস্ত নবী করিম (সা.)কে জীবনের চেয়ে অধিক শ্রদ্ধা করে ও ভালবাসে। তাই বিশ্বের সমগ্র মুসলমান নবী করিম (সা.)কে কটূক্তির বিরুদ্ধে ব্যাপক সোচ্চার হয়েছে।

তবুও ভারতের কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের ইসলাম ও মুসলিমবিদ্বেষী মনোভাবের পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না। কারণ, ইসলাম ও মুসলিমবিদ্বেষই তাদের উত্থানের মূল ভিত্তি! স্মরণীয় যে, বাবরী মসজিদ ভেঙ্গে ফেলার মধ্য দিয়ে বিজেপি ও তার ঘরানাদের উত্থান শুরু হয়েছে। এর আগে তাদের জাতীয় পার্লামেন্টে আসন ছিল মাত্র দু’টি। আর বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার পর থেকে তারা ক্ষমতায় এসেছে। মাঝখানে কয়েক বছর ক্ষমতায় না এলেও প্রধান বিরোধী দল থেকেছে। আর এখন ২০১৪ সাল থেকে একনাগাড়ে কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় রয়েছে। অধিকাংশ রাজ্যেও তারা ক্ষমতাসীন রয়েছে। এতে দেশটির মুসলিমদের জানমাল চরম হুমকির মুখে পড়েছে। বিভিন্ন রাজ্যে গরু জবাই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাতে গোমাংস রফতানিতে প্রথম থেকে দ্বিতীয় স্থানে নেমে এসেছে। উপরন্তু লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়েছে কসাইখানা বন্ধ হওয়ায়। তবুও গোমাংস রাখার অভিযোগে অনেক মুসলিমকে হত্যা করেছে গোরক্ষকরা। মুসলিম নারীদের বোরকা ও হিজাব পরা নিষিদ্ধ করেছে অনেক স্থানে। উপরন্তু অনেককে জোর করে ধর্মান্তরিত করেছে ঘর ওয়াপস কর্মসূচির মাধ্যমে। এছাড়া, মসজিদে মসজিদে ‘শিবলিঙ্গ’ খুঁজে উপাসনালয়ের চরিত্র বদলের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কতিপয় রাজ্যে মাদ্রাসা শিক্ষা বন্ধ করা হয়েছে। গত বছরের শেষের দিকে হরিদ্বারে হিন্দু সাধুসন্তদের একটি ধর্মীয় সমাবেশ থেকে প্রকাশ্যে মুসলিম নিধন ও গণহত্যার ডাক দেওয়া হয়েছে। এমনকি মুসলমানদের নাগরিকত্ব বিরোধী আইনও করা হয়েছে, যার লক্ষ্য মুসলমানদের অনুপ্রবেশকারী বলে চিহ্নিত করে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া। এ নিয়ে বিভিন্ন রাজ্যে ব্যাপক সহিংসতাও হয়েছে। বিজেপির লক্ষ্য, ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করা। আরআরএস প্রধান মোহন ভাগবত গত এপ্রিলে হুঙ্কার দিয়ে বলেছেন, আর মাত্র ১৫ বছর। তার পরই তৈরি হবে অখÐ ভারত। আর যারা এর মাঝে আসবে তারা ধ্বংস হয়ে যাবে। এভাবে তাদের কর্মকাÐে দেশটির সাধারণ হিন্দুরা প্রভাবিত হচ্ছে। ফলে কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের উত্থান ঘটছে। পিউ রিসার্চ সেন্টারের জরিপ প্রতিবেদন-২০২১ মতে, হিন্দু ধর্মাবলম্বী ভারতীয় নাগরিকদের দুই-তৃতীয়াংশই মনে করে, সত্যিকার ভারতীয় হতে হলে হিন্দু ধর্মের অনুসরণ করা জরুরি। ভারতের লোকদের এরূপ মানসিকতার কারণে বিশ্বের মধ্যে সর্বাধিক সা¤প্রদায়িক সহিংসতা ঘটছে দেশটিতে। তাতে ব্যাপক জানমালের ক্ষতি হচ্ছে। যার কিছু প্রভাব পড়ছে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতেও। তবুও হিন্দু মৌলবাদীদের ধর্মান্ধতা বন্ধ হচ্ছে না। স¤প্রতি ইউপির খরগুপুর জেলার একটি গ্রামের তিন মুসলমানকে কান ধরে উঠ-বস করানোর পর জয় শ্রীরাম বলতে বাধ্য করা হয়। যার ভিডিও ভাইরাল হয়েছে নেট দুনিয়ায়। এভাবে মুসলমানদের ধরে শ্রীরাম বলতে বাধ্য করার ঘটনা প্রায়ই ঘটছে দেশটির বিভিন্ন স্থানে! সর্বোপরি জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ স্বায়ত্তশাসন বাতিল করে চরম দমন পীড়ন চালানো হয়েছে। এখন সেখানে চলছে হিন্দু পÐিতদের পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া। উপরন্তু সমগ্র দেশের বহু স্থানে মুসলিম শাসনামলের বিভিন্ন স্থান ও স্থাপনার নাম পরিবর্তন করে হিন্দুয়ানী নামকরণ করা হচ্ছে। দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ স¤প্রতি বলেছেন, মোগল সাম্রাজ্যকে অহেতুক প্রাধান্য দিতে গিয়ে হিন্দু সাম্রাজ্যগুলো সম্পর্কে উদাসীন থেকেছেন ইতিহাসবিদরা। তার এই অসত্য বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে বিভিন্ন দল ও ইতিহাসবিদরা।

মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই মুসলিম নির্যাতন বাড়ছে ভারতে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ছড়ানো হচ্ছে ইসলামবিদ্বেষ। যার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে বহু মুসলিম দেশ, ওআইসি, ‘ফ্রিডম হাউস’, ‘ভি ডেম ইন্সটিটিউট’, ‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’, জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ভারত প্রতিটি ক্ষেত্রেই ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’, ‘অসত্য’, ‘অজ্ঞ’, ‘সত্যের অপলাপ’ বলে অভিহিত করেছে। তাই এ ক্ষেত্রে ভারতের বিশিষ্ট লেখক ও মেইলি গেজেট পত্রিকার প্রধান সম্পাদক জফরুল ইসলাম খানের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য, যা গত ৬ জুন আল জাজিরায় প্রকাশিত হয়েছে। তাতে তিনি বলেন, বিজেপির ভিত্তিগুলোর একটি ইসলামবিদ্বেষ। ইসলাম ও মুসলিমদের প্রতি দলটির রয়েছে চরম বিদ্বেষ। বিজেপি বিশ্বাস করে, মুসলিমরা যখন হিন্দুস্তান শাসন করত, তখন তারা হিন্দু নারীদের ধর্ষণ ও মন্দির ভেঙ্গে মসজিদ নির্মাণ করেছিল। একটি তালিকা আছে, যাতে অন্তত তিন হাজার মসজিদ হিন্দুদের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। হিন্দুরা মনে করে, ঐ মসজিদগুলো নির্মাণ করা হয়েছে মন্দির ভেঙ্গে। স¤প্রতি দলটির এক প্রভাবশালী নেতা দাবি করেছেন, হিন্দুস্তানে মুসলিমদের শাসন ছিল ইহুদিদের ওপর নাৎসিবাদ জার্মানির হলোকস্টের মতো। শাসক দলের এরকম আচরণ প্রকাশে ভারতীয় মুসলিমরা ইতোমধ্যেই বুঝতে শুরু করেছে যে, তারা দেশটিতে অপরিচিতের মতো হয়ে যাচ্ছে। যখনই মুসলিমরা কোনো বিক্ষোভে অংশ নিচ্ছে, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় তাদের ঘরবাড়ি গুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। অপরদিকে, ভারতের ১০৮ জন অবসরপ্রাপ্ত আইএএস, আইএফএস ও আইআরএস কর্মকর্তা গত ২৬ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীকে এক খোলা চিঠিতে দিল্লি, আসাম, গুজরাত, হরিয়ানা, কর্ণাটক, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ ও উত্তরাখÐে সা¤প্রতিক সহিংসতার প্রসঙ্গ তুলে বলেন, ‘যা ঘটছে তা ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক নীতি এবং আইনের শাসনের পরিপন্থী। এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্যবাদ ক্রমশ প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। এছাড়া, গত ২৫ এপ্রিল প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম বিষয়ক কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোদি সরকারের আমলে ভারতের ধর্মীয় স্বাধীনতা উল্লেখযোগ্য হারে খর্ব হয়েছে। এর আগে গত ৬ এপ্রিল ভারতে চলমান মুসলিমবিদ্বেষের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইডেনের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন মার্কিন কংগ্রেসের সদস্য ইলহান ওমর। যুক্তরাজ্যের এসিএন ১৯৬টি রাষ্ট্রের ওপর ধর্মীয় স্বাধীনতা কিংবা ধর্মীয় কারণে নিপীড়ন-নির্যাতনের ওপর ২০২১ সালের প্রতিবেদনে ভারতকে রেড তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।

অথচ, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম, শিল্প, সাহিত্য, উন্নতি তথা প্রতিটি ক্ষেত্রেই মুসলমানদের ব্যাপক অবদান রয়েছে। দেশটির বর্তমানের বিশাল চলচ্চিত্র শিল্পে বিশেষ অবদান আছে ‘খানদের’। পরমাণু বোমার জনকদের মধ্যে অন্যতম এপিজে আবদুল কালাম। এসব অসংখ্য নজির রয়েছে মুসলমানদের, যারা ভারতের উন্নতি ও মর্যাদা বৃদ্ধিতে বিশেষ অবদান রেখেছে। তাই কেউ ইচ্ছা করলেই ভারতের ইতিহাস থেকে মুসলমানদের অবদান মুছে ফেলতে পারবে না। কিংবা ২০ কোটির অধিক মুসলমানকে জোর করে দেশ থেকে বের করে দেওয়াও সম্ভব নয়।মাঝখানে দেশটির ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হচ্ছে। উপরন্তু উন্নতিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অনেক। যেমন: বিজেপি শাসনামলে দেশটির সামগ্রিক উন্নতি হয়নি, বরং অবনতি হয়েছে অনেক। ‘ওয়ার্ল্ড ইনইক্যুয়ালিটি ল্যাব’-এর রিপোর্ট মতে, ‘দরিদ্র’ তো বটেই। ভারত এখন এক ‘চরম অসাম্যের দেশ’ও। ভারতের নিচের সারির অর্ধেক মানুষের হাতে দেশের সম্পদের প্রায় কিছুই নেই। অথচ, ধনীরা অত্যন্ত ধনী। ২০২১ সালে ভারতের মোট আয়ের ২০% গেছে দেশের ওপরের সারির ১% মানুষের হাতে। অথচ, নিচু তলার ৫০% মানুষের হাতে রয়েছে দেশের মোট আয়ের মাত্র ১৩%। বেকারত্বও চরম আকার ধারণ করেছে। দূষণও বিশ্বের সর্বাধিক। রুপির মান সর্বনি¤œ পর্যায়ে এসেছে। উপরন্তু দেশটির গণতন্ত্রের ক্ষেত্রেও অধোগতি হয়েছে। ২০২১ সালে প্রকাশিত ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ডেমোক্রেসি ইনডেক্স মতে, গত ছয় বছরে ভারত ২৬ ধাপ নেমে ৫৩তম হয়েছে। এই অবস্থায় ইসলাম বিদ্বেষের কারণে মুসলিম দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে দেশটির মহা বিপর্যয় সৃষ্টি হতে পারে। তাই ভারতের ঐতিহ্য ও ভাবমর্যাদা উজ্জ্বল রাখা এবং দারিদ্র্য মুক্ত করে সার্বিক উন্নতির লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা অটুট এবং সামাজিক ও ব্যক্তি পর্যায়ে ‘ধর্ম যার যার শ্রদ্ধা সবার’ নীতি কার্যকর করতে হবে দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের। এ ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা দরকার। এমনিতেই দাদাগিরির কারণে পার্শ্ববর্তী প্রায় সব দেশের সাথে সম্পর্ক শীতল হয়েছে দেশটির। সার্কও অচল হয়ে রয়েছে ভারতের কারণে। উপরন্তু কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের সাথে এবং লাদাখ নিয়ে চীনের সাথে কয়েকবার যুদ্ধ হয়েছে এবং সব সময় যুদ্ধাভাব বিরাজ করছে। ফলে সব দেশকেই পাল্লা দিয়ে সামরিক শক্তি বাড়াতে হচ্ছে। এতে উন্নতি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই দাদাগিরি ও জাতিগত হিংসা-বিদ্বেষ ত্যাগ করে পারস্পরিক শান্তিপূর্ণ, সহাবস্থান ও মর্যাদার সাথে থাকা ভারতের জন্য জন্য অধিক কল্যাণকর।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
[email protected]



 

Show all comments
  • হামজা ১৬ জুন, ২০২২, ১:৫৮ এএম says : 0
    বিজেপির রাষ্ট্রীয় মুখপাত্র নুপুর শর্মা ও দিল্লির মিডিয়া ইন চার্জ নবীন কুমার জিন্দাল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, ইসলামের শেষ নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) এবং তার স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) সম্পর্কে কটূক্তি করায় বিশ্বের সব মুসলমান ও মুসলিম দেশ চরম ক্ষিপ্ত হয়েছে।
    Total Reply(0) Reply
  • হামজা ১৬ জুন, ২০২২, ১:৫৯ এএম says : 0
    ভারতের বিরুদ্ধে আরো শক্ত অবস্থান নেওয়া দরকার। তারা কোনো সময় অন্য ধর্মের ভালো চায় না।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইসলাম

৩ মার্চ, ২০২৩
২ মার্চ, ২০২৩
১ মার্চ, ২০২৩
২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন