শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
প্রাচীনকাল থেকে বাংলা সাহিত্যে প্রেম এসেছে বিভিন্ন রংগে বিভিন্ন ঢংয়ে। প্রেম শব্দটির পাশাপাশি বিরহ এসেছে নিরবে নিভৃতে। প্রেম ও বিরহ, মিলন ও বিচ্ছেদ বাংলা সাহিত্যে নানা আঙ্গিকে বাঁক বদল ও প্রেম সংক্রান্ত বিবিধ চিন্তা আমাদের দৃষ্টিকে প্রসারিত করেছে।বাংলা সাহিত্যে প্রেম বিরহ নিয়ে আলোকপাত করার পূর্বে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সম্পর্কে সংক্ষেপে আমাদের কিছু জানা প্রয়োজন বলে মনে করি।
বাংলা সাহিত্যের যুগ বিভাগ: ড.মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, ৬৫০-১২০০ খৃষ্টাব্দ,এবং ড.সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে ৯৫০-১২০০ খৃষ্টাব্দ সময়কাল হলো প্রাচীনকাল। ১২০১-১৮০০ খৃষ্টাব্দ, মধ্যযুগ। (১২০১-১৩৫০ খৃষ্টাব্দ, অন্ধকারযুগ। ১৬৬০-১৮৬০ খৃষ্টাব্দ, যুগসন্ধিক্ষণ।)১২০১-১৫০০খৃষ্টাব্দ, প্রাকচৈতন্যযুগ। ১৫০১-১৭০০ খৃষ্টাব্দ, চৈতন্যযুগ। ১৭০১-১৮০০ খৃষ্টাব্দ, চৈতন্য পরবর্তী যুগ। ১৮০১-বর্তমান, আধুনিকযুগ। কিছু কিছু সমালোচক বলেন,আধুনিক যুগ শেষ হয়েছে।
ক.প্রাচীনযুগ হিসেবে বাংলা সাহিত্যের নিদর্শন চর্যাপদঃচর্যার বিষয় ধর্মকেন্দ্রিক ও তত্ত্ববহুল হলেও তার বাহ্যিক রূপটি লৌকিক ও সামাজিক জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এর ফলে চর্যাপদের সাহিত্যিক মূল্যটি অস্বীকার করা যায় না। চর্যার কোনো কোনো পদে তত্ত্ব তার কাব্যের রূপটিকে ছাপিয়ে গেছে।
এই চিত্রকল্পগুলিই চর্যার সাহিত্যমূল্য বহন করছে। গুণ্ডরীপাদের একটি পদ পার্থিব প্রেমের তীব্র আর্তিতে জীবন্ত: “যোইণি তঁই বিণু খনহিঁ ন জীবমি। / তো মুহ চুম্বী কমলরস পীবমি।” (পদ ৪, অর্থাৎ- যোগিনী, তোমাকে ছাড়া মুহুর্তকালও বাঁচব না। তোমার মুখ চুম্বন করে কমলরস অর্থাৎ পদ্মমধু পান করব।)
শবরপাদের একটি পদে দেখা যায় নরনারীর প্রেমের এক অপূর্ব চিত্রণ- উঁচা উঁচা পাবত তঁহি বসই সবরী বালী।
মোরঙ্গি পীচ্ছ পরহিণ সবরী গীবত গুঞ্জরী মালী।।
উমত সবরো পাগল শবরো মা কর গুলী গুহাডা তোহৌরি। ণিঅ ঘরনি ণামে সহজ সুন্দারী।।/ণাণা তরুবর মৌলিল রে গঅণত লাগেলি ডালী/একেলী সবরী এ বণ হিণ্ডই কর্ণ কুণ্ডলবজ্রধারী।।
(পদ ২৮, অর্থাৎ- উঁচু পর্বতে শবরী বালিকা বাস করে। তার মাথায় ময়ূরপুচ্ছ, গলায় গুঞ্জামালিকা। নানা তরু মুকুলিত হলো। তাদের শাখা-প্রশাখা আকাশে বিস্তৃত হলো। শবর-শবরীর প্রেমে পাগল হলো। কামনার রঙে তাদের হৃদয় রঙিন ও উদ্দাম। শয্যা পাতা হলো। শবর-শবরী প্রেমাবেশে রাত্রিযাপন করলো।)
খ. চর্যাপদে ধর্মীয় প্রয়োজনে যেমন উপকরণ হিসেবে প্রেম এসেছে, তেমনি মধ্যযুগেও স্রষ্টা ও সৃষ্টির প্রেম দেখাতে গিয়ে আভিধানিকভাবে মানব-মানবীর প্রেম উপস্থাপিত হয়েছে। তবে এসব কাব্যে প্রেমের উপস্থাপনে ভিন্নতা লক্ষণীয়। ‘লায়লী-মজনু’ গ্রন্থে আমির পুত্র কয়েস ও লায়লীর প্রেম মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয়। চূড়ান্ত বিরহই এ কাব্যটির পরম পরিণতি। এ প্রণয়োপাখ্যানে প্রেম এসেছে, এ প্রেম তীব্র কামনা ও বাসনার নয়, এ প্রেম দেহজনির্ভর নয়। ড. আহমদ শরীফের ভাষায় এ প্রেম ‘অশ্লীলতামুক্ত’ ও ‘সংযমী’। এ ক্ষেত্রে সুফি সাধকদের ভুমিকা অনস্বীকার্য। অন্যদিকে চন্ডীদাশের ‘শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন’ কাব্যে এ মন্তব্য বিপরীত দিক দিয়ে উপস্থিত হয়। ‘শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন’-এর রাধা ও কৃষ্ণ প্রেমের আদিরসে জারিত এবং কৃষ্ণের তীব্র কামনাকে পূর্ণতায় রূপ দিয়ে এটি সমানভাবে অশ্লীলও। দেহজ প্রেম এখানে আদি-অন্তে গুরুত্ব পেয়েছে।
বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ মূলত অনুবাদের কাল। বাংলা ভাষার শক্তিমান লেখকগণ এ সময় আরবী, ফার্সী, হিন্দি ভাষার জনপ্রিয় রচনাগুলো বাংলায় অনুবাদ শুরু করেন। এর মধ্য দিয়ে অবশ্য বিশ্ব সাহিত্যের সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের সমন্বয় শুরু হয়। মধ্যযুগে অনুবাদকৃত রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দৌলত উজির বাহরাম খাঁর ‘লায়লী-মজনু’ (মূল লেখক : ইরানী কবি জামি), শাহ মুহম্মদ সগীরের ‘ইউসুফ-জোলেখা’ (মূল : মহাকবি ফেরদৌসী), মহাকবি আলাওলের ‘পদ্মাবতী’ (মূল : মালিক মুহম্মদ জায়সীর ‘পদুমাবৎ’), দোনা গাজী, আলাওল, মালে মুহাম্মদের ‘সয়ফুলমুলুক-বদিউজ্জামান’ (আদি উৎস : আলিফ লায়লা), শিরি-ফরহাদ প্রমুখ। মধ্যযুগের লায়লী-মজনু, ইউসুফ-জোলেখা, পদ্মাবতী, সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল এই চারটি প্রণয়োপাখ্যানই খুব বেশি প্রভাবশালী ছিল। এ চাড়াও সুফি সাধকগণ নাগরি বর্ণে ছিলটি ভাষায় শতাধিক পুঁথি ও মরমি গীতিকবিতা রচনা করে গেছেন, কালের বিবর্তনে তা বেশির ভাগই হারিয়ে গেছে।গবেষক, মস্তফা সেলিমের প্রচেষ্টায় উৎস প্রকাশনের মাধ্যমে অদ্যাবধি এসব গ্রন্থগুলো বাংলায় লিপান্তর করে প্রকাশিত হচ্ছে যা বাংলা সাহিত্যে এক বিরাট সংযোজন।এর মধ্যে প্রেম বিরহের কাহিনি নিয়ে লেখা বইগুলো হচ্ছে-মুহাম্মদ জওয়াদের ‹বাহরাম জহুরা›(মুলঃফারসিগ্ধবাহার দানিশ),দীন ভবানন্দের মুজমা রাগ হরিবংশ,মুহাম্মদ খলিলের লেখা চন্দ্রমুখী›, হাজী ইয়াসিনের লেখা মায়ারশি দুছরা› উল্লেখযোগ্য।
মধ্যযুগের বিবিধ উপাখ্যানের প্রেম বিরহের স্বরূপ:শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন কাব্য,
[ভাব সম্মিলন] ২ চণ্ডীদাস/বহু দিন পরে বঁধুয়া এলে।
দেখা না হইত পরাণ গেলে।।/এতেক সহিল অবলা ব›লে।/ফাটিয়া যাইত পাষাণ হ›লে।।/দুখিনীর দিন দুখেতে গেল।/মথুরা নগরে ছিলে ত ভাল।।/এই সব দুখ কিছু না গণি।/তোমার কুশলে কুশল মানি।।/বাহরাম তহুরার প্রেম কাব্য থেকে কিছু উদ্বৃতি; প্রেম শুরু হয় একে অন্যের ভালো লাগা ভালোবাসা থেকে চুপিসারে,রটনায় ঘটে বিপত্তি, বাহরাম তহুরার প্রেমে এ রকম বিপত্তি আসে। উজির তনয়া পিতৃগৃহে অন্তরীণ।ঘরের বাইরে যাবার অনুমতি নেই। প্রিয়ার বিরহে রাজপুত্র বাহরামের আহাজারির অন্ত নেই।
কবির পঙক্তিতে--
হাএ হাএ নচিবে মর কি আছে।।/জহুরাএ পাগল করি গিআছে/কি তীর মারিল মুজে জহুরাএ।।/শেই শুকে পরানি মর জলি জাএ/হায়রে পরানের পিআ কে নিল।।/আমারে পাগল করি ছাড়িল/এই রুপে আহাজারি করিআ।/মুনাজাত করে হাত উঠাইআ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।