Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আব্দুল গাফফার চৌধুরী

বহুরৈখিক প্রতিভা

রকি মাহমুদ | প্রকাশের সময় : ৩ জুন, ২০২২, ১২:০৫ এএম

ভাষার গান লিখে আব্দুল গাফফার চৌধুরী যে চেষ্টার বীজ বপন করেছিলেন তা স্বাধীন বাংলা বিনির্মাণে কার্যকরী ভূমিকা রাখে।

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সাংবাদিক, কবি,কলামিস্ট, গ্রন্থকার,অমর একুশে গানের রচয়িতা আব্দুল গাফফার চৌধুরী বরিশাল জেলার মেহেন্দি গঞ্জ উপজেলার পানি বেষ্টিত উলানিয়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন ১৯৩৪ সালের ১২ ডিসেম্বর। তাঁর বাবা হাজি ওয়াহিদ রেজা চৌধুরী, মা মোসম্মৎ জহুরা খাতুন। তিন ভাই পাঁচ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। বড় ভাই হোসেন রেজা চৌধুরী ও ছোট ভাই আলী রেজা চৌধুরী। বোনেরা হলেন- মানিক বিবি, লাইলী খাতুন,সালেহা খাতুন,ফজিলা বেগম ও মাসুমা বেগম। আবদুল গাফফার চৌধুরী উলানিয়া জুনিয়র মাদ্রাসায় ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। ইতোমধ্যে ১৯৪৬ সালে তাঁর পিতার মৃত্যু ঘটলে আর্থিক অনটন মাথায় নিয়ে তিনি বরিশাল শহরে আসমত আলী খান ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন। আবদুল গাফফার চৌধুরীর ১৯৫০ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। ১৯৫৩ সালে তিনি ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৮ সালে বিএ অনার্স পাস করেন। এবছরের ১৮ই ফেব্রুয়ারী তিনি সেলিমা আফরোজের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। তিনি পাঁচ সন্তানের জনক মেয়ে-বিনীতা চৌধুরীর (সাম্প্রতিক পরলোকগত), তনিমা চৌধুরী, ইন্দিরা চৌধুরী, চিন্ময় চৌধুরী এবং ছেলে-অনুপম আহমেদ রেজা চৌধুরী। ১৯৭৩ সালে আব্দুল গাফফার চৌধুরীর স্ত্রী মেরুদন্ড সংক্রমণের কারণে বিকলাঙ্গ হয়ে পড়লে তিনি স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য লন্ডন যান। শুরু হয় তাঁর প্রবাস জীবন। ২০১৩ সালে আব্দুল গাফফার চৌধুরীর স্ত্রী মারা যান। আবদুল গাফফার চৌধুরীর স্ত্রীকে মিরপুর বাংলাদেশ শহীদ বুদ্ধিজীবি কবর স্থানে সমাহিত করা হয়। আবদুল গাফফার চৌধুরীর অন্তিম ইচ্ছার প্রতি সম্মান জানাতে তাঁকেও তাঁর স্ত্রীর সমাধি পাশে সমাহিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
আব্দুল গাফফার চৌধুরী সাহিত্য চর্চার শুরুর দিকে লিখেছেন অসংখ্য কবিতা। লিখেছেন গল্প, উপন্যাসও। এই সব কৃর্তি ছাপিয়ে সবার আগে তাঁর যে সৃষ্টির কথা আমাদের মানসপটে উঁকি দেয়, তা তিনি রচনা করেছেন কলেজের গণ্ডি পেরুনোর আগেই, ১৯৫২ সালের রক্তঝরা একুশে ফেব্রুয়ারির নির্মম নিষ্ঠুরতার অভিঘাতে। ঢাকা কলেজের ছাত্র আবদুল গাফফার চৌধুরীর হাসপাতালে গিয়েছিলেন আহত সহযোদ্ধাদের দেখতে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আউটডোরে তিনি মাথার খুলি উড়ে যাওয়া একটি লাশ দেখতে পান,যেটি ছিলো ভাষা সৈনিক রফিকের লাশ। ঐ লাশটি দেখে তাঁর মনে হয় এ যেন তার নিজের ভাইয়ের রক্তমাখা লাশ। তখনি ভাষার গানের দুটি লাইন তাঁর মনে আসে। পরে কয়েকদিন ধরে লেখা ওই গানটি ভাষা আন্দোলনের প্রথম লিফলেটে একুশের গান শিরোনামে প্রকাশিত হয়। ১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে সংকলনে এটি প্রকাশিত হয়। কবিতাটিতে প্রথম সুরারোপ করেছিলেন আব্দুল লতিফ। পরে ১৯৫৪ সালে শহীদ আলতাফ মাহমুদ গানটিতে সুরারোপ করেন। তাঁর সুরারোপিত গানটি ব্যবহৃত হয় জহির রায়হানের জীবন থেকে নেয়া› চলচিত্রে এবং ১৯৫৪ সালের প্রভাত ফেরীতে প্রথম গাওয়া হয় শোক সংগীত হিসাবে। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত এই গান অপরিমেয় অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে নিরন্তর শিল্পিত পটভূমি তৈরীতে অবদান রেখেছে। শুধু বাংলাদেশে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাত ফেরীতে এই গান গাওয়া হয় তা কিন্তু নয়, এই গানটি হিন্দি, মালয়,ইংরেজি, ফরাসি, সুইডিশ, জাপানিজসহ মোট ১২ টি ভাষায় গাওয়া হয়। বিবিসি›র শ্রোতা জরিপে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ গানের তালিকায় এটি তৃতীয় স্থান লাভ করেছে(২০০৬)। কি এমন আছে এই গীতিকবিতায়? তুলে ধরা হলো গানটির প্রথম স্তবক সঙ্গে কবীর চৌধুরীকৃত ইংরেজি অনুবাদ-
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী
আমি কি ভুলিতে পারি
ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু-গড়া এ ফেব্রুয়ারী
আমি কি ভুলিতে পারি
আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো ফেব্রুয়ারী
আমি কি ভুলিতে পারি

“Can I forget the twenty-first February
incarnadined by the blood of my brother?
Twenty-first February, build by the tears/
of a hundred mothers robbed of Their sons,
Can I ever forget it?”

ভাষার গান লিখে আব্দুল গাফফার চৌধুরী যে চেষ্টার বীজ বপন করেছিলেন তা স্বাধীন বাংলা বিনির্মানে কার্যকরী ভূমিকা রাখে। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তাঁর একুশে বক্তৃতায়(১৯৮৫) বলেনগ্ধ বায়ান্ন সালের ভাষা-আন্দোলন কিন্তু আমাদের চেতনার অনেকগুলো দিক পরিপুষ্ট করেছিল। বিশে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাভাষার দাবি যাদেরকে তেমন করে স্পর্শ করতে সমর্থ হয় নি, সরকারের চণ্ডালনীতি তাদের অস্তিত্বের মূল ধরে টান দিয়েছিল। রূঢ় আঘাতের চরম বেদনার মধ্য দিয়ে আমরা নিজেদের বাঙালি সত্তা সম্পর্কে সজাগ হয়েছিল। পরে যতই সাংস্কৃতিক নিপিড়ন ঘঠেছে, আমাদের বাঙালিত্ব ততই প্রবল হয়েছে।
প্রাবন্ধিক কবীর চৌধুরী বলেন: পাকিস্তানি স্বৈরাচারী দুঃশাসনের আমলে বাংলা বর্ণমালা, বানান, ব্যাকরণ প্রভৃতির সংস্কার, বাংলাভাষা সরলীকরণ, রোমান হরফে বাংলা লেখা প্রবর্তন প্রভৃতি উদ্যোগের মধ্যদিয়ে বাংলাভাষাকে, এবং সেই সূত্রে বাংলা সাহিত্যকে, দুর্বল ও বিকৃত করে বাঙালি সংস্কৃতিকে পঙ্গু ও পন্ডিত করার অপপ্রয়াস চালানো হয়েছিল। কিন্তু ওইসব প্রয়াস সফল হয়নি। প্রতিক্রিয়াবিরোধী শক্তিসমূহ প্রথম থেকেই এসব উদ্যোগের তীব্র বিরোধীতা করেছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাভাষা আন্দোলনের কথা বিশেষভাবে স্মর্তব্য। আব্দুল গাফফার চৌধুরী ছিলেন এইসব মুভমেন্টের অগ্রগণ্য সৈনিক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সময়ে সাংবাদিকতার সমান্তরালে সাহিত্য সৃষ্টিতে সক্রিয় ছিলেন আব্দুল গাফফার চৌধুরী। তরুণ বয়সে বহু কবিতা লেখা আব্দুল গাফফার চৌধুরীর প্রথম বইটি ছিলো শিশুদের জন্য। ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত সে বইয়ের নাম ডানপিটে শওকত›। ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর বিখ্যাত গল্পের বই সম্রাটের ছবি›। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকেই তিনি লিখেছেন কৃষ্ণপক্ষ (১৯৫৯), চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান (১৯৬০), নাম না জানা ভোর (১৯৬২), নীল যমুনা (১৯৬৪), শেষ রজনীর চাঁদ›(১৯৬৭), সুন্দর হে সুন্দর›(১৯৬০), ইত্যাদি। সম্পাদনা করেছেন: বাংলাদেশ কথা কয় (১৯৭২), পলাশী থেকে ধানমন্ডি (২০০৭, বঙ্গবন্ধুর জীবন)।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আব্দুল গাফফার চৌধুরী
আরও পড়ুন