শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
ইংরেজি ‘চধৎড়ফু’ (প্যারডি) শব্দের বাংলা অর্থ হলো ‘লালিকা’। কিন্তু এ শব্দটি একেবারেই অপ্রচলিত। প্যারডি বলতে সাধারণত কোনো জনপ্রিয় রচনার অনুকৃতি বোঝায়; আর এই রচনা হয় সাধারণত ব্যঙ্গাত্বক। আধুনিক বাংলাকাব্যে হাস্যরসাত্বক এই প্যারডির বহুল প্রচলন আছে। কবি ঈশ্বর গুপ্ত থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক কালের কবিদের কবিতারও প্যারডি হয়েছে। তবে রবীন্দ্র-নজরুল যুগে প্যারডি রচনা হয়েছে সবচেয়ে বেশি।
কাজী নজরুল ইসলামের বহু জনপ্রিয় কবিতা ও গানের প্যারডি রচিত হয়েছে। নজরুল নিজেও অনেক কবিতা ও গানের প্যারডি রচনা করেছেন। যেমন তিনি পদাবলীর কবি জ্ঞানদাসের ‘সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু অনলে পুড়িয়া গেল’-জনপ্রিয় এ কবিতাটির প্যারডি করেছেন এভাবে-
আমি তুরগ ভাবিয়া মোরগে চড়িনু
(সে) লইল মিয়ার ঘরে।
আমার কালিমা ছাড়ায়ে কলেমা পড়ায়ে
বুঝি মুসলিম করে।/এ ছাড়া তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘তোমারি গেহে পালিছ স্নেহে, তুমিই ধন্য ধন্য হে’ গানের ‘‘সুপার (জেলের) বন্দনা’’ শিরোনামে প্যারডি করেছেন-তোমারি জেলে পালিছ ঠেলে
ধন্য তুমি ধন্য হে।/আমার এ গান তোমারি ধ্যান
তুমিই ধন্য ধন্য হে।। নজরুলের প্যারডি রচনার মধ্যে অনাবিল হাস্যরস ছিল; তিনি কখনো ঈর্ষান্বিত হয়ে প্যারডি রচনা করেন নি। কিন্তু নজরুলের অনেক জনপ্রিয় কবিতা ও গানের যারা প্যারডি করেছেন তারমধ্যে অনেকেই ছিলেন নজরুলের আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত। তাদের এই ঈর্ষান্বিত মনোভাব ধরা পড়েছে প্যারডিগুলোর মধ্যে। যেমন কবির ‘‘বিদ্রোহী’’ কবিতা নিয়ে অনেক প্যারডি রচিত হয়েছে। এর মধ্যে সজনীকান্ত দাস রচিত প্যারডির মধ্যে এমন মনোভাব ধরা পড়েছে-
আমি ব্যাঙ/লম্বা আমার ঠ্যাং
ভৈরব রভসে বরষা আসিলে ডাকি যে গ্যাঙোর গ্যাং।
কবি গোলাম মোস্তফা ‘‘বিদ্রোহী’’ কবিতার জবাবে লিখেছিলেন ‘‘নিয়ন্ত্রিত কবিতাটি। তিনি অবশ্য এখানে কটাক্ষ না করে সংযত হবার উপদেশ দিয়েছেন-
ও গো বীর!/সংযত কর, সংহত কর ‘উন্নত তব শির।
বিদ্রোহী? শুনে হাসি পায়!/বাঁধন-কারার কাঁদন কাদিয়া বিদ্রোহী হতে সাধ যায়?/ সে কি সাজে রে পাগল সাজে তোর?/কাজী নজরুল ইসলাম লিখলেন ‘‘কাণ্ডারী হুশিয়ার”’ আর সজনীকান্ত দাস লিখলেন ‘‘ভাণ্ডারী হুশিয়ার’’। নজরুলের ‘‘কাণ্ডারী হুশিয়ার’’ কবিতাটি তৎকালীন সময়ে াত্যন্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। শুধু জনপ্রিয়তাই নয় সাধারণের মধ্যে বেশ আলোড়নও সৃষ্টি করেছিল। এর আবেদন এখনো শেষ হয় নি।
এ কবিতার দুটি পংক্তি-
দূর্গম গিরি, কান্তর মরু, দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীতে, যাত্রীরা হুশিয়ার!
এর অনুকরণে সজনীকান্ত দাস প্যারডি লিখলেন-
চোর ও ছ্যাঁচোর ছিঁচকে সিঁদেলে দুনিয়া চমৎকার
তলপি-তলপা, তহবিল নিয়ে ভাণ্ডরী হুশিয়ার।
এ ছাড়া রজনীকান্ত নজরুলকে সরাসরি আক্রমন করেও ব্যঙ্গ কবিতা লিখেছেন; যাতে তার অশোভন মনোভাব প্রকাশ পেয়েছেÑ
গাজী আব্বাস বিটকেল?
কল্লি মহাখিটকেল!/লিখে ফেললি কাববি
তাও আবার ছাপবি?/ছাপলেও তা কাটবে-
কেউ কেউ তা চাটবে।...
কাজী নজরুল ইসলামের অনেক কবিতার প্যারডিতে এমন তীব্র আক্রমনাত্বক বাগভঙি লক্ষ্য করা যায়। এর মূল কারণ, নজরুল কবিতা লিখে অতি দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। তাঁর গানও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। তবে কবিতার চেয়ে গানে আক্রমনাত্বক মনোভাব কম। নজরুলের একটি জনপ্রিয় গানের কিয়দংশ-
কে বিদেশী বন উদাসী/বাঁশের বাঁশী বাজাও বনে।
সুর সোহাগে তন্দ্রা লাগে/কুসুমবাগের গুলবদনে।।
এ গানের একাধিক প্যারডি আছে। তার মধ্যে সজনীকান্ত লিখেছেন-
কে উদাসী বাঁশের বাঁশী বাজাও বনে
বাঁশী সোহাগে ভিরমি লাগে, বর ভুলে যায় বিয়ের কনে।/আর সতীশচন্দ্র ঘটক লিখলেন-
কে সুকেশী মঞ্জুদাসী ফাঁসের ফাঁসি লাগাও মনে
ঘুরবো তাগে শঙ্কা জাগে, কুসুম রাগে ছুপবদনে।
যে সব প্যারডিতে ব্যক্তিগত ঈর্ষা কিংবা আক্রমন নেই সেগুলোই নির্দোষ প্যারডি বলে বিবেচিত হতে পারে। প্যারডির মূল লক্ষ্য হওয়া উচিৎ নির্দোষ হাস্যরস বা অনাবিল আনন্দ। আবার হাসি ব্যঙ্গরসের বাইরেও প্যারডি হতে পারে। এর সুন্দর একটি দৃষ্টান্ত হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘‘১৪০০ সাল ’’ কবিতার জবাবে কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন ‘‘১৪০০ সাল’’ (একই শিরোনামে) কবিতাটি। দুটি কবিতার প্রথম স্তবক নিচে তুলে ধরছি-
রবীন্দ্রনাথের ‘‘১৪০০ সাল’’ -
আজি হতে শতবর্ষ পরে
কে তুমি পড়েছ বসি আমার কবিতাখানি
কৌতুহল ভরে/আজি হতে শতবর্ষ পরে।
নজরুলের ‘‘১৪০০ সাল’’ -
আজি হতে শতবর্ষ আগে/ কে কবি স্মারণ তুমি করেছিলে/আমাদেরে শত অনুরাগে
আজি হতে শতবর্ষ আগে।
প্যারডিতে ব্যক্তিগত আক্রমন ও ঈর্ষা থাকলেও তাতে মূল লেখকের লেখার কোনো অমর্যাদা বা জনপ্রিয়তা হারায় না। আধুনিক যুগের প্রারম্ভে ‘‘মেঘনাদবধ’’ কাব্য নিয়ে অনেক প্যারডি রচিত হয়েছে ‘‘কিন্তু মূল ‘মেঘনাদবধ’ আজও বাঙ্গালীর পাঠশালা হইতে শুরু করিয়া বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সর্বত্রই নিজগুণে সমাদৃত হইতেছে।’’ জনৈক সমালোচকের এই উক্তির বাস্তব প্রতিফলন আমরা কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ও গানে লক্ষ্য করি। তাঁর যে সব কবিতা ও গান নিয়ে প্যারডি রচিত হয়েছে সেগুলোর আবেদন আজও এতটুকু কমেনি এবং নজরুল ইসলামও হারিয়ে যাননি; হারিয়ে গেছেন প্যারডিকাররা। তবে তাদের সান্ত¦না এই যে, তারা বড় কবিদের কবিতার প্যারডি করার কারণেই আজ তাদের আমরা আলোচনায় আনছি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।