শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
বাংলা ছোটগল্পের ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথ প্রথম আধুনিক শিল্পী। দৃষ্টিকোণ, পরিচর্যা, ভাষারীতি এবং প্রকরণ-প্রকৌশলে রবীন্দ্রনাথের হাতেই ঘটে বাংলা গল্পের উজ্জ্বল উত্থান।
তার হাতেই বাংলা ছোটগল্পের সার্থক রূপটি পরিস্ফুট হয়ে ওঠে।
পুঁজিবাদী সভ্যতার সীমাবদ্ধতার চাপে, সময়ের আবর্তে মানুষ যতই যান্ত্রিক হয়েছে, ছোটগল্প-সাহিত্যের বিকাশ ততই হয়েছে ঋদ্ধ। পুঁজিবাদী সভ্যতার উত্থানের ফলে সম্পূর্ণ জীবন নয়, বরং জীবনের ছোট ছোট অংশই মানুষের কাছে প্রাধান্য পেল। এ অবস্থায় উপন্যাসের পরিবর্তে ছোটগল্প পেয়ে গেল জনপ্রিয়তার চুড়ান্ত শিখর।
১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে রবি ঠাকুর ‘সাধনা’ পত্রিকায় ছোটগল্প লিখতে শুরু করেন। তার আগেও অবশ্য তিনি গল্প লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথের প্রথম গল্প ‘ভিখারিনী’ প্রকাশিত হয় ১৮৭৭ সালে ভারতী পত্রিকায়।
তবে বাংলা ছোটগল্প যে পাশ্চাত্য গল্পের কাছে ঋণী। এমনকি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও এডগার অ্যালান পো-র দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন। উপন্যাসের মতো ছোটগল্পেরও আদি উৎসভূমি ইউরোপ। ইউরোপীয় সমাজে প্রবহমান রূপকথা, লোকগাথা বা রোম্যান্সকাহিনী; যা ছিল মূলত মানুষের মনোরঞ্জনের অন্যতম মাধ্যম। ইতালীয় রেনেসাঁসের পর রূপান্তরিত হয় নতুন চেতনায়, নব-প্রতিনব জিজ্ঞাসায়। বোক্কাচ্চিও, চসার যাঁবলে, সারভান্টেসের সামগ্রিক সাধনায় ধীরে ধীরে গড়ে উঠল ছোটগল্পের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, কাহিনী-চরিত্র-পট আর সবশেষ সাবলীল সংলাপরীতি। বস্তুত, তাঁরাই আধুনিক ছোটগল্পের প্রত্ন-উৎসের রচয়িতা। তাঁদের সৃষ্টি করা পথ ধরেই ঊনবিংশ শতাব্দীতে ক্রমে আবির্ভূত হয়েছেন বিশ্বসাহিত্যের প্রধান ছোটগাল্পিকরা। কিন্তু বাংলা ছোটগল্পের সেই প্রাথমিক যুগে বিদেশি সাহিত্যের সাহায্য গ্রহণ না করে উপায় ছিল না। কারণ বাংলা সাহিত্য তখন হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে বিকশিত হচ্ছে।
অখণ্ড গল্পগুচ্ছে যে ৯১টি ছোটগল্প রয়েছে, তার সবক’টি ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যের অনন্য সম্পদ। রবি ঠাকুরের ছোটগল্প পড়েননি, বাঙালি পাঠক সমাজে এমন মানুষের সংখ্যা অতি নগন্য। অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলা সাহিত্যের ছোটগল্প যে অধিকতর কাব্যধর্মী ও ব্যঞ্জনাপ্রধান, এর কারণ সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের বিশেষ কল্পনাদৃষ্টির প্রভাব।
‘সমাপ্তি’, ‘মধ্যবর্তিনী’, ‘দৃষ্টিদান’, প্রভৃতি গল্প যেন এক একটি গীতিকবিতার রেশে অনুরণিত, জীবনসত্যের এক একটি লীলা রহস্য। বাঙালি জীবনের ছোটখাট আশা-নৈরাশ্যের দ্বন্দ্ব কিংবা আনন্দ-বেদনার মৃদু স্বপ্ন-কল্পনা যেন এই গল্পগুলিতে কখনও কৌতুক স্নিগ্ধ, কখনও অশ্রু-করুণ পরিণতিতে পূর্ণতা লাভ করেছে।
এখানে সৌন্দর্যতন্ময়তার পরিবর্তে আছে আঘাত-তৎপরতা।
রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পগুলি দু’টি পর্বে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম পর্বের গল্পগুলিতে পদ্মাতীরবর্তী অর্থাৎ আমাদের উত্তরবঙ্গের গ্রামীণ মানুষের জীবনই প্রধানত প্রতিফলিত হয়েছে। সমকালীন জটিল নাগরিক জীবন থেকে এই পটভূমির পার্থক্য অত্যন্ত স্পষ্ট। এই গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যোগ দুই ধারায়। তিনি খুব কাছে থেকে মানুষের পরিচয় পেয়েছিলেন। ‘সোনার তরী’ কাব্যের সূচনায় তিনি বলেছেন, “মানুষের পরিচয় খুব কাছে এসে আমার মনকে জাগিয়ে রেখেছিল। তাদের জন্য চিন্তা করেছি, কাজ করেছি, কর্তব্যের নানা সংকল্প বেঁধে তুলেছি। সেই সংকল্পের সূত্র আজও বিচ্ছিন্ন হয়নি আমার চিন্তায়। সেই মানুষের সংস্পর্শেই সাহিত্যের পথ এবং কর্মের পথ পাশাপাশি প্রসারিত হতে আরম্ভ হল আমার জীবনে।”
কিন্তু এ কথা স্বীকার করতেই হয় গ্রামীণ জনজীবনের সঙ্গে ওতোপ্রোতো ভাবে সম্পৃক্ত হওয়া রবীন্দ্রনাথের পক্ষে সম্ভব ছিল না। চলমান বজরায় খোলা জানালা দিয়ে তিনি গ্রামীণ জীবনের টুকরো টুকরো ছবি দেখে গেছেন একের পর এক। তিনি নিজেই লিখেছেন, “এক সময়ে ঘুরে বেড়িয়েছি বাংলার নদীতে নদীতে, দেখেছি বাংলার পল্লীর বিচিত্র জীবনধারা। একটি মেয়ে নৌকা করে শ্বশুরবাড়ি চলে গেল। তার বন্ধুরা ঘাটে নাইতে নাইতে বলাবলি করতে লাগল আহা, যে পাগলাটে মেয়ে, শ্বশুরবাড়ি গিয়ে ওর কি জানি কি দশা হবে। কিংবা ধর, একটা খ্যাপাটে ছেলে সারা গ্রামে দুষ্টুমির চোটে মাতিয়ে বেড়ায়, তাকে হঠাৎ একদিন চলে যেতে হল তার মামার কাছে। এইটুকু দেখেছি, বাকিটা নিয়েছি কল্পনা করে।” (সাহিত্য, গান ও ছবি: প্রবাসী ১৩৪৮ সন) সম্ভবত এখানে তিনি ‘সমাপ্তি’ ও ‘ছুটি’ গল্পদুটির বস্তুগত পটভূমির প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। দূর থেকে দেখা মানবজীবনের রহস্যছবিকে মানস অনুভবের রশ্মিতে আলোকিত করে পূর্ণাঙ্গ রূপ ধরেছে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।