মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় দেউলিয়া হলো যুক্তরাষ্ট্রের ২য় বৃহত্তম ব্যাংক
চলতি সপ্তাহের বুধবারও আর দশটি সাধারণ ব্যাংকের মতো বাণিজ্যিক ও আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিপি), যা দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক ব্যাংক
তার বাবা ছিলেন এক নিষ্ঠুর স্বৈরশাসক। তার মা আন্তর্জাতিকভাবে কুখ্যাতি কুড়িয়েছিলেন তার জুতার বিশাল সংগ্রহের জন্য। তাহলে ৬৪ বছর বয়সী ফার্দিনান্দ মার্কোস জুনিয়র, যিনি তার বংবং নামেই বেশি পরিচিত, তিনি ফিলিপিনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ের পথে। আংশিক ও বেসরকারি ফলাফল বলছে, তিনি প্রায় ৫৬ শতাংশ ভোট পেয়ে জিতে গেছেন।
কীভাবে সেটা সম্ভব হল? এর উত্তর নিহিত আছে বংশানুক্রমিক রাজনীতির চক্রান্তের জাল, কয়েক প্রজন্ম ধরে চলতে থাকা আনুগত্য আর সোশ্যাল মিডিয়া দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চতুর কৌশলের মধ্যে। ফিলিপিনের ইলোকোস নর্তে অঞ্চলটি মার্কোস পরিবারের শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত। সেখানে স্প্যানিশ কায়দায় তৈরি এক রাজকীয় প্রাসাদ, যেটিকে বর্ণনা করা হয় উত্তরের মালাচিয়াং প্রাসাদ বলে।
মূল মালাচিয়াং প্রাসাদ আসলে হাজার মাইল দূরে রাজধানী ম্যানিলায়, এটি ফিলিপিনের প্রেসিডেন্টের সরকারি বাসভবন। তবে ফার্দিনান্দ মার্কোস যখন ফিলিপিন শাসন করছেন, তখন ১৯৬০ এর দশকে ইলোকোস নর্তের এই প্রাসাদটি তার পরিবারকে উপহার দেয় দেশটির পর্যটন কর্তৃপক্ষ। তবে মার্কোস পরিবারের তীর্থ বলে পরিচিত এই প্রাসাদোপম বাড়ি এখন জনগণের জন্য উন্মুক্ত। মার্কোসের সমর্থকরা এখানে এসে ফার্দিনান্দ এবং ইমেলদা মার্কোসের রাজকীয় ছবির সামনে সেলফি তোলে, তাদের থাকার ঘরগুলো ঘুরে ঘুরে দেখে।
বংবং শৈশবে যে ঘরটিতে থাকতেন, সেখানে একটি কারুকার্যখচিত খাটের বিপরীতে ঝোলানো তার একটি ছবি, ফিলিপিনের সম্ভাব্য ভাবী নেতার এক অসাধারণ প্রতিকৃতি। ছবিতে বংবং একটি স্বর্ণ-মুকুট পরে আছেন, তিনি একটি সাদা স্ট্যালিয়ন ঘোড়ায় চড়ে মেঘের রাজ্যে চলেছেন। তার এক হাতে ফিলিপিনের পতাকা, অন্য হাতে বাইবেল। এই পেইন্টিং এর কোণায় যে স্তোত্র লেখা, তা ছবিটির মর্মার্থ বুঝতে সাহায্য করবে: এপো ২১:১, এতে পবিত্র নগরী জেরুজালেমের ওপর দিয়ে এক স্বর্গ-দূতের উড়ে যাওয়ার বর্ণনা দেয়া আছে।
এক গণঅভ্যুত্থানের মুখে ১৯৮৬ সালে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন ফার্দিনান্দ মার্কোস। এ পরিবার বিশ্বজুড়ে কুখ্যাতি অর্জন করে তাদের দুর্নীতির জন্য। তার শাসনামলে ফিলিপিনে কী ব্যাপক দুর্নীতি আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছিল, আদালতের রেকর্ড আর সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে তার বিস্তারিত বিবরণ এবং প্রমাণ আছে। গণঅভ্যুত্থানের বিপ্লবী কর্মীরা যখন ম্যানিলায় প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে ঢুকে পড়েছিল, তখন সেখানে মার্কোস পরিবারের বহু চমৎকার তৈলচিত্র, সোনায় মোড়ানো জাকুজি, ১৫টি মিংক কোট, ৫০৮টি ডিজাইনার গাউন, এবং ফার্স্ট লেডি ইমেলদা মার্কোসের তিন হাজার জোড়া জুতার সংগ্রহ দেখতে পান।
কিন্তু সেই পরিবারেরই সন্তান বংবং এরই মধ্যে ফিলিপিনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বেসরকারি ফলাফলে ভূমিধস জয় পেয়েছেন। তার নির্বাচনী প্রচারণা যখন চলছিল বিপুল উদ্যমে, তখন সমর্থকরা অতীতের এসব ঘটনা এবং তথ্য সম্পর্কে তাদের সংশয় প্রকাশ করছিলেন। বংবং এর বিরোধী শিবিরের লোকজন এজন্য দায়ী করছেন সোশ্যাল মিডিয়াকে। তাদের মতে সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে মিথ্যে তথ্য ছড়িয়ে ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে, মার্কোস পরিবারের কলঙ্কময় অতীত মুছে ফেলা হয়েছে। তবে মার্কোস পরিবার এই অভিযোগ অস্বীকার করেন।
বহু বছর ধরেই ফেসবুকে ভুয়া একাউন্ট আর নানা রকমের প্রোপাগান্ডা পোস্ট দিয়ে চালানো হচ্ছে মার্কোস পরিবারের গুণকীর্তন। এসব পোস্টে অতীত ইতিহাসকে এতটাই ব্যাপকভাবে বিকৃত করা হয়েছে যে, লোকে এসব ভুল তথ্য দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, তোতাপাখির মতো সেগুলোকেই সত্য বলে পুনরাবৃত্তি করে। এসব পোস্টে সাধারণভাবে একটা কথাই বেশি করে বলা হয়: মার্কোসের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনামলটাই ছিল আসলে ফিলিপিনের 'স্বর্ণযুগ'- যদিও আসলে তখন ফিলিপিনের অর্থনীতি ধসে পড়ার উপক্রম হয়েছিল, এবং দেশটি ছিল বিদেশি ব্যাংকগুলোর কাছে বিপুলভাবে ঋণগ্রস্ত।
আনুগত্য এবং উত্তরাধিকার: রাজধানী ম্যানিলার ৭১ বছর বয়সী জেসাস বাতিস্তা একজন কট্টর বংবং সমর্থক। মিস্টার বাতিস্তা একসময় ম্যানিলার আবর্জনার স্তূপে জিনিস কুড়াতেন। সেখানে আবর্জনার যে পাহাড় জমতো, তাতে অনেক সময় আগুন ধরে যেত, তাই এটিকে ধোঁয়ার পাহাড়ও বলতো অনেকে। ১৯৮৩ সালে তাকে ম্যানিলার ট্রাফিক আইন কার্যকর দফতরে অবসর ভাতার সুবিধাসহ একটি পূর্ণকালীন চাকুরি দেয়া হয়। মিসেস মার্কোসকে তখন মেট্রো ম্যানিলার গভর্নর করা হয়েছিল অগণতান্ত্রিক-ভাবে।
নিজের ভাঙা বেতের চেয়ারে হেলান দিয়ে মিস্টার বাতিস্তা বলেন, এরকম একটা সরকারি চাকুরি যে পেয়েছিলেন, সেজন্যে ইমেলদার কাছে তার অনেক ঋণ, তিনি তার কাছে কৃতজ্ঞ। প্রায় দশ বিলিয়ন বা এক হাজার কোটি ডলারের সম্পদ লুটপাটের এক দুর্নীতির কারণে পরবর্তীকালে ইমেলদা মার্কোসের সাজা হলেও, জেসাস বাতিস্তা এবারের নির্বাচনে তার ছেলেকেই ভোট দেবেন বলে জানান। "আমি তো কখনো কোন দুর্নীতি দেখিনি", বললেন মিস্টার বাতিস্তা। "এগুলো সব শোনা কথা। শত্রুরা তাদের নামকে কালিমালিপ্ত করতে চেয়েছে", বলছেন তিনি।
নেতা হওয়ার জন্যই জন্ম: বংবং এর জন্মই যেন হয়েছে নেতা হওয়ার জন্য, সেভাবেই ছোটবেলা থেকে তাকে বড় করা হয়। গণবিক্ষোভের মুখে ১৯৮৬ সালে যেদিন মার্কোস পরিবারকে প্রাসাদ ছাড়তে হয়, সেদিনের কিছু ফুটেজে দেখা যায়, ২৮ বছর বয়সী বংবং সামরিক পোশাকে তার বাবার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন।
তবে ১৯৭২ সালে ফার্দিনান্দ মার্কোসের এক ডায়েরিতে দেখা যায়, তিনি ছেলের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বেশ উৎকণ্ঠার ভুগতেন। এতে তিনি লিখেছেন, "বংবংকে নিয়েই আমাদের বেশি চিন্তা। ও খুব বেশি বেপরোয়া আর অলস।" বংবং ১৯৭৫ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন ফিলজফি, পলিটিক্স এন্ড ইকোনোমিক্স (পিপিই) পড়ার জন্য, যেটিকে রাজনীতিতে কেরিয়ার গড়ার জন্য আদর্শ একটি কোর্স বলে গণ্য করা হয়। কিন্তু তিনি গ্রাজুয়েশন শেষ করতে পারেন নি- যদিও বংবং তা অস্বীকার করেন।
ফিলিপিনের একটি নিউজ ওয়েবসাইট ভেরাফাইলসের এক রিপোর্ট অনুসারে, বংবং যখন দুবার পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন, তখন নাকি ফিলিপিনের তৎকালীন কূটনীতিকরা লবিং করেছিলেন যেন তাকে অন্তত সোশ্যাল সায়েন্সে একটা স্পেশাল ডিপ্লোমা ডিগ্রি দেয়া হয়। এই বিতর্ক সত্ত্বেও পিতার শাসনামলে রাজনীতিতে এক জাঁকালো কেরিয়ার গড়তে বংবং এর কোন অসুবিধা হয়নি। তবে গণঅভ্যুত্থানে মার্কোস পরিবার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এতে ছেদ পড়েছিল। তবে দেশে ফিরে আসার পর ফিলিপিনের রাজনীতিতে দিনে দিনে বংবং এর অবস্থান আরও শক্তিশালী হয়েছে।
বংবংএর রানিং মেট দুতার্তের মেয়ে: নির্বাচনে বংবং এর রানিং মেট হিসেবে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৪৩ বছর বয়সী সারা দুতার্তে, যিনি ফিলিপিনের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট রড্রিগো দুতার্তের মেয়ে। দুতার্তে খুবই বিতর্কিত, কিন্তু জনপ্রিয় এক প্রেসিডেন্ট। কিন্তু ফিলিপিনের সংবিধান অনুযায়ী, একজন প্রেসিডেন্ট ছয় বছরের মেয়াদ শেষ করার পর আর দ্বিতীয় মেয়াদে প্রার্থী হতে পারেন না। প্রেসিডেন্ট দুতার্তে ২০১৬ সালে 'মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' ঘোষণা করেছিলেন। তখন হাজার হাজার মাদক ব্যবসায়ী এবং মাদক ব্যবহারকারীকে বিচার-বহির্ভূতভাবে বিশেষ অভিযান চালিয়ে হত্যা করা হয়েছিল।
তার মেয়ে বংবং এর সঙ্গে একযোগে কাজ করে দেশকে 'ঐক্যবদ্ধ' করার অঙ্গীকার করেছেন, যাতে ফিলিপিন আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে'। তিনি ফিলিপিনে ১৮ বছর বয়সীদের জন্য সামরিক বাহিনীতে যোগ দেয়া বাধ্যতামূলক করতে চান। আর বংবং অঙ্গীকার করছেন, যেসব অপরাধীকে সমাজে পুনর্বাসন করা যাবে না, তিনি তাদের জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান চালু করতে চান। ম্যানিলায় মার্কিন দূতাবাস থেকে পাঠানো ২০০৯ সালের এক কূটনৈতিক বার্তা উইকিলিকস ফাঁস করেছিল। এতে দুতার্তের মেয়েকে বর্ণনা করা হয়েছে "তার বাবার মতোই একজন কঠোর ধরণের মানুষ, যার সঙ্গে কথাবার্তা চালানো কঠিন।"
দুই হাজার এগার সালে তিনি এমন এক ঘটনা ঘটিয়েছিলেন, যেটি তার পরবর্তী জীবনের ওপর গুরুত্বপূর্ণ ছাপ ফেলেছে। তখন মেয়র হিসেবে তিনি এক শেরিফের মুখে উপর্যুপরি ঘুষি মেরেছিলেন, কারণ ঐ শেরিফ একটি বস্তি ভেঙ্গে দেয়ার জন্য তার নির্দেশ অমান্য করেছিল।
মার্কোস পরিবারের সমালোচকরা বলছেন, বংবং যেভাবে তার নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছেন, তাতেই তার অসততার পরিচয় মেলে। তিনি সমালোচনার মুখোমুখি হতে চান না, তিনি সারাক্ষণ তার বশংবদ লোকজন, যারা সারাক্ষণ তার কথা হ্যাঁ বলবে, তাদের দিয়ে নিজেকে ঘিরে রাখেন। তারা আশংকা করছেন, বংবং মার্কোস ফিলিপিনকে সেখানেই নিয়ে যাবেন, ১৯৮৬ সালে তার বাবা দেশটিকে যেখানে রেখে গিয়েছিলেন। সূত্র: বিবিসি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।