Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আগামী জাতীয় নির্বাচন কেমন হতে পারে?

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ১৮ এপ্রিল, ২০২২, ১২:০৩ এএম

আমাদের দেশে নির্বাচন প্রতি ৫ বছর অন্তর অন্তর হয় বটে, কিন্তু নির্বাচন বলতে যা বুঝায় সত্যিকার অর্থে তা হয় কি? নির্বাচনের অভিধানিক অর্থ হচ্ছে পছন্দ করা অর্থাৎ নিজ কাক্সিক্ষত প্রার্থীকে ভোট প্রদানের মাধ্যমে দেশপরিচালনার সুযোগ প্রদান করা। প্রার্থী ও ভোটারের মধ্যে একটি গভীর যোগসূত্র না থাকলে পছন্দের মাপকাঠি সৃষ্টি হতে পারে কীভাবে? সে যোগসূত্রের ধারাবাহিকতা কীভাবে রক্ষা হতে পারে? প্রবাদ রয়েছে যে, আমাদের দেশের রাজনীতি জোয়ারে ভাসে। জোয়ার যে দিকে যায় অর্থাৎ যে দল বা প্রার্থী শক্তি প্রদর্শন করতে পারে গণমানুষ সে দিকেই তাড়িত হয়। বাস্তবতা হলো এই যে, মেক্সিমাম ভোটার চিন্তা করে যাতে তার ভোটটা যেন নষ্ট বা ব্যর্থ না হয়। অন্যদিকে ভোটার তার নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখেই ভোট দানের সিদ্ধান্ত নেয়। সে কারণেই যার শক্তি বেশি তার দিকেই ভোটাররা বেশি মনোনিবেশ করে, ফলে পছন্দ বা ইচ্ছা যাই হোক না কেন, শক্তির কাছেই এদেশের ভোটারা মাথা নত করতে বেশি আগ্রহী। শক্তির উৎস্য কী সেটাই এখন পর্যালোচনার বিষয়। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে জনগণ ঐক্যবদ্ধ হতে পারলেই সেখানে শক্তি সৃষ্টি হয়। ফলে জনগণ যেমন যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবিতে ১৯৫২ সালে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, যেমনি হয়েছিল ১৯৭০-৭১ স্বাধিকার/স্বাধীনতার আন্দোলনে বা ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতার বিপ্লবে, আবার ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে। দেখা যায়, সকল দলের কর্মসূচিতেই জনসমাবেশের কমতি নাই। কথিত ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রে ধর্মভিত্তিক দলগুলিও অনেক বড় বড় জনসমাবেশ ঘটাতে পারে, কিন্তু ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না বা ঐক্যবদ্ধ করার কোনো উদ্যোগ এখনো পরিলক্ষিত হচ্ছে না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি জনজীবন অতিষ্ট করে ফেলেছে। মানুষ গোপনভাবে হলেও এ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও রাষ্ট্রীয় দুর্বৃত্তয়ানের উপর যারপরনাই নাখোশ। গত ২৮ মার্চ বামপন্থী ঐক্যজোট দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে হরতাল ডেকেছিল। পত্রিকার ভাষ্যমতে, হরতাল সফল না হলেও বামপন্থী দলগুলি মাঠে ছিল, ঝুঁকি নিয়ে মিছিল করেছে, পুলিশকে মোকাবেলা করেছে হরতাল সফল করার জন্য। কিন্তু হরতালের সফলতা বলতে যা বুঝায় সে ধরনের হরতাল পালিত হয় নাই। জনস্বার্থে আহুত হরতালে জনগণের স্বতস্ফূর্ত সাড়া পাওয়া যায় নাই। অন্যদিকে বৃহৎ বিরোধী দল বিএনপি হরতালে সমর্থন জানানোর ইচ্ছা প্রকাশ করলেও বামদল তা প্রত্যাখান করে। বিএনপি’র একটি ব্যাপক কর্মী বাহিনী আছে জেনেও বামদল কর্তৃক আহুত হরতালে বিএনপি’র সমর্থন গ্রহণ না করার পিছনে কী কারণ থাকতে পারে? হতে পারে তারা মনে করে যে, (১) বিএনপি’র সাথে বামদের আর্দশিক কোনো মিল নাই অথবা (২) বিএনপি’র সমর্থন নিলে হরতালের ক্রেডিট বিএনপি’র পক্ষে চলে যেতে পারে। ফলে দৃশত ভবিষ্যত ঐক্যের অর্থাৎ ২০২৩ সালে নির্বাচনে বাম-ডানদের ঐক্যের প্রাথমিক লক্ষণ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। অন্যদিকে ডানপন্থী দলের মধ্যে ধর্মভিত্তিক প্রতিটি দলই আলাদা আলাদা কর্মসূচি পালনসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আলাদা প্রার্থী দাঁড় করিয়ে জেনে শুনে সরকারি দলের প্রার্থীর জয় লাভের পথ সুগম করে দিচ্ছে। বিষয়টি পরিষ্কার যে, ডানদের মধ্যেও জাতীয় ঐক্যের উদ্যোগ এখনো পরিলক্ষিত হচ্ছে না। ২০১৮ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলের সাথে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন ঐক্যফন্টের ঐক্যের রিজাল্ট ছিল শূন্যোর কোঠায়। তখন যে প্রশ্ন উপস্থাপিত হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিছুদিন পূর্বে ভোট চাওয়ার প্রারম্ভে সেই একই প্রশ্ন উপস্থাপন করে বলেন যে, বিরোধী দল নির্বাচিত হলে কে হবে দেশের প্রধানমন্ত্রী? অন্যদিকে ড. কামাল হোসেনের দলও এখন বিভিন্ন উপদলে বিভিক্ত হয়ে নেতৃত্বের প্রশ্নে তিনিও শূন্যের কোঠায় চলে গেছেন। ফলে সার্বজনীন ঐক্যের প্রশ্নে বিরোধী দল কতটুকু হাঁটতে পারবে এটাই এখন পর্যালোচনার বিষয়।

জনগণের ঐক্যবদ্ধতা যেমন সরকার হটানোর জন্য অন্যতম প্রধান শক্তি হতে পারে, তেমনি উপমহাদেশের রাজনীতিতে একমাত্র ভারত ছাড়া অন্যান্য রাষ্ট্রে সরকার পরিবর্তনে সেনাবাহিনী অনেক ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। পাকিস্তান ও বার্মা কোনো সময়ই সেনাপ্রভাব মুক্ত হতে পারে নাই। বাংলাদেশে বিগত ৫০ বছরে তিনবার সরকার পরিবর্তনে সামরিক হস্তক্ষেপ কার্যকর হয়েছে (খন্দকার মোশতাক, জেনারেল এরশাদ, জেনারেল মঈন ইউ আহাম্মদ)। জেনারেল এরশাদ সামরিক আইন জারির পর রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নিলে বিভিন্ন দলের নেতারা একযোগে তার দলে যোগদান করে, রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার স্থান করে নেয়। এরশাদের যখন পতন আসে গণবিদ্রোহের কারণে তখন আটরশির পীর সাহেবসহ অনেকেই তাকে ছেড়ে চলে যান এবং সুযোগমত বিভিন্ন দলে যোগদান করেন। কথিত আছে যে, তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল নুর উদ্দিন যদি প্রেসিডেন্ট এরশাদকে সাপোর্ট করতে সম্মত হতেন তবে এরশাদের পতন হতো না। যাহোক পুরুস্কার স্বরূপ জেনারেল নুর উদ্দিন আওয়ামী লীগের টিকেটে এম.পি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ফলে প্রতীয়মান হয় যে, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে সেনাবাহিনী অন্যতম শক্তি। জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার সুযোগ করতে না পারায় রণে ভঙ্গ দিয়ে আওয়ামী লীগের সাথে সমঝোতা করে শেষ রক্ষা লাভ করেন। তবে ড. ইউনুস বা ফেরদৌস আহমেদ কোরেশীর মাধ্যমে কিংস পার্টি গঠন করার চেষ্টা করলেও পরবর্তীতে পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় সরকার সমর্থিত রাজনৈতিক দল গঠন করা যায় নাই।

বাংলাদেশের ইলেকশন কারসাজিতে আমলা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষ করে পুলিশ বাহিনী অনৈতিকভাবে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। নির্বাচনে তাদের ব্যাপক ভূমিকা থাকে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে আমলাদের কারসাজিতেই বিরোধী দল মাঠে নামতে পারে নাই। দিনের ভোটে রাত্রে হওয়ার অভিযোগ ছাড়াও গায়েবি মামলা, মামলায় অভিযুক্তদের রিমান্ড এবং জজ কোর্ট পর্যন্ত জামিন পেতে বাধাগ্রস্ত হওয়ায় সরকার সহজেই বৈতরণী পার হতে পারে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে যদি আমলা, পুলিশ ও নিম্ন আদালত সরকারের প্রতি গোপন সমর্থনে অনুরূপ ভূমিকা রাখে তবে শক্তি প্রর্দশনে বাকী দলগুলির ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নাই, যার পূর্বাভাস এখনো দেখা যাচ্ছে না।

অনেকের ধারণা, পৃথিবীর বৃহৎশক্তি বা জাতিসংঘ বাংলাদেশে আগামীতে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে কোনো ভূমিকা রাখতে পারে। তবে স্মরণ রাখা দরকার, পৃথিবীতে সংগঠিত কোনো অমানবিক গণহত্যার বিষয়ে জাতিসংঘ বা বৈদেশিক শক্তি কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখে নাই। বার্মার সামরিকজান্তা রোহিঙ্গা গণহত্যা বা তাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করার অমানবিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ বা বড় বড় রাষ্ট্রগুলি ত্রাণ প্রদান করলেও বার্মার বিরুদ্ধে কার্যকর ভূমিকা রাখে নাই। পৃথিবীতে কোনো রাষ্ট্রই কোনো রাষ্ট্রের বন্ধু নয়। এক রাষ্ট্র অপর রাষ্ট্রের সাথে স্বার্থ ছাড়া সম্পর্ক রাখে না। ফলে কোনো রাষ্ট্রে নির্বাচন সুষ্ঠু হলো কি হলো না মর্মে কোনো রাষ্ট্রের মাথা ব্যাথা নাই। বর্তমান আন্তর্জাতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিয়মান যে, বিশ্ব এখন অর্থনৈতিক যুদ্ধে লিপ্ত। ফলে অর্থনৈতিক স্বার্থে ব্যাঘাত না ঘটলে কোনো রাষ্ট্র কারো বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ভূমিকা নেয় না। ফলে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন কতটুকু নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হবে, তা এখনো নিশ্চিত নয়।

লেখক: রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জাতীয় নির্বাচন


আরও
আরও পড়ুন