Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পরিকল্পনামতোই পূর্ব ইউক্রেন নিয়ন্ত্রণে নিচ্ছেন পুতিন

জেলেনস্কিকে প্রত্যাখ্যান দ. কোরিয়ার, মারিউপোলে শেষ প্রহর গুনছে ইউক্রেন রাশিয়ার প্রীতিতে কঠোর সমালোচনার মুখে জার্মানির পররাষ্ট্রনীতি ক্রামতোর্স্কে ইউক্রেনের হামলার তদন্ত শুরু করেছে

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১৩ এপ্রিল, ২০২২, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১২:০৮ এএম, ১৩ এপ্রিল, ২০২২

ইউক্রেন বলেছে যে, তারা ধারণা করছে রাশিয়া শিগগিরই দেশের পূর্বে একটি বিশাল নতুন আক্রমণ শুরু করবে। কারণ অস্ট্রিয়ার নেতা বলেন যে, তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের সাথে বৈঠকের পরে যুদ্ধের সমাপ্তি সম্পর্কে ‘আশাবাদী’ নন। পুতিন নিজেও বলেছেন, ইউক্রেন নয়, তার মূল লক্ষ্য ডোনবাস অঞ্চলকে মুক্ত করা। এদিকে, মারিউপোলে আর যুদ্ধ করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে সোমবার জানিয়েছে ইউক্রেনের সেনা। এ দিনই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সাহায্যের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে দ.কোরিয়া।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুতিন কখনোই পুরো ইউক্রেন দখল করতে চাননি। বর্তমান বিশ্বের প্রেক্ষাপটে তা সম্ভবও নয়। তবে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের হামলা ছিল তার পরিকল্পনার একটি অংশ। সেখানে তিনি রাশিয়ার আধুনিক প্রযুক্তির ও যুদ্ধবিমানগুলো ব্যবহার না করে অবরোধ দীর্ঘায়িত করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি ইউক্রেনের সেনাদেরকে দীর্ঘ দিন ব্যস্ত রেখেছিলেন এবং সে সুযোগে ডোনবাস এলাকায় রাশিয়াপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন। খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ ওই এলাকা ইউক্রেনের আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস। যা এখন রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে। এছাড়া প্রধান দুই নৌ-বন্দরও রাশিয়া অবরোধ করে রেখেছে। যার ফলে ইউক্রেনের বৈদেশিক বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ, সামরিক ও অর্থনৈতিক উভয়দিকে পরাস্ত হয়েছে ইউক্রেন।
উত্তর ইউক্রেন থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের পর, রাশিয়া বলেছে যে, তাদের মূল লক্ষ্য পূর্ব ইউক্রেন। তাদের দাবী, কিয়েভ সেখানে ডোনবাস অঞ্চল নামে পরিচিত এলাকার কিছু অংশের নিয়ন্ত্রণ রাশিয়াপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদী যোদ্ধাদের হাতে তুলে দেবে। ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওলেক্সান্ডার মতুজিয়ানিক বলেছেন, ‘আমরা পূর্বাভাস দিয়েছি যে এই অঞ্চলে সক্রিয় যুদ্ধ শুরু হবে নিকটতম সময়ে।’

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ওয়াশিংটন বিশ্বাস করে যে রাশিয়া ডনবাস অঞ্চলে তাদের সৈন্যকে শক্তিশালী ও পুনরায় সরবরাহ করার চেষ্টা করছে। ডোনবাসে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় পুরষ্কার হল মারিউপোল, প্রধান পূর্ব বন্দর শহর, যেখানে প্রায় সাত সপ্তাহের অবরোধে হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে বলে মনে করা হয়। রাশিয়া শেষ পর্যন্ত মারিউপোল দখল করলে, এটি পূর্ব থেকে অগ্রসর হওয়া সৈন্যদের সাথে সংযুক্ত ক্রিমিয়া উপদ্বীপের সেনাদের সাথে আরও ভালভাবে যুক্ত করতে পারে এবং তাদের ফোকাস পূর্বে প্রধান ইউক্রেনীয় বাহিনীকে ঘেরাও করার নতুন প্রচেষ্টায় স্থানান্তরিত করতে পারে।

এদিকে, রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বলেছেন, তার দেশ নতুন কোনো আলোচনার জন্য লড়াই থামাবে না। ল্যাভরভ বলেন, ‘একটি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল যে পরবর্তী দফা আলোচনার সময়, (সামরিক পদক্ষেপে) কোন বিরতি দেওয়া হবে না যতক্ষণ না একটি চূড়ান্ত চুক্তিতে পৌঁছানো যায়।’ ব্রিটেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে যে, ডোনেটস্ক এবং লুহানস্ক অঞ্চলে রাশিয়ার গোলাবর্ষণ অব্যাহত রয়েছে, যা একসাথে ডোনবাস গঠন করে।
জেলেনস্কিকে প্রত্যাখ্যান দ.কোরিয়ার : ইউক্রেনের সেনারা জানিয়েছে, মারিউপোলে সম্ভবত আজই যুদ্ধের শেষ দিন। কারণ, যে পরিমাণ অস্ত্র মজুত, তা দিয়ে আর লড়াই করা সম্ভব নয়। ৩৬তম মেরিন ব্রিগেড বিবৃতিতে বলেছে, ‘৪৭ দিন ধরে বন্দর রক্ষায় সব রকম প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। এ বার আর পিছু হটা ছাড়া রাস্তা নেই।’ ইতোমধ্যেই মারিউপোল ঘিরে ফেলেছে রুশ সেনা। তারাও জানিয়েছে, মারিউপোলে এখন আজভস্টাল লৌহ ও ইস্পাত কেন্দ্র এবং বন্দর দখলের লড়াই চলছে। ইউক্রেনের বক্তব্য, শুধু অস্ত্র সঙ্কট নয়। প্রায় অর্ধেক সেনা আহত। এখনও অঙ্গহানি হয়নি যাদের, তারা এখনও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।

এক দিকে ইউক্রেনের মরণপণ লড়াই অন্য দিকে রাশিয়ার মানবতা লঙ্ঘনের বিষয়টি সোমবার তুলে ধরেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। তার দাবি, মারিউপোলে ১০ হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছে রাশিয়া। এত মানুষকে মারার পরেও আক্রমণ থামায়নি। হানায় বিপর্যস্ত তিনশোরও বেশি হাসপাতাল। এই পরিস্থিতিতে দক্ষিণ কোরিয়ার কাছেও অস্ত্র সাহায্য চেয়েছেন জেলেনস্কি। তবে তার সেই আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে সিউল।

কঠোর সমালোচনার মুখে জার্মানির পররাষ্ট্রনীতি : রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা শুরুর পর জার্মানির পররাষ্ট্রনীতি কঠোর সমালোচনার মুখে পড়েছে। সাবেক চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলসহ পুরো একটি প্রজন্মের রাজনীতিবিদরা সমালোচিত হচ্ছেন। ২০০৮ সালে ম্যার্কেল ও ফ্রান্সের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট নিকোলা সার্কোজি ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য করার প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন। এটাকে রাশিয়া উসকানি হিসেবে দেখতে পারে, বলে মনে করেছিলেন তারা। ম্যার্কেল ও সার্কোজির এই সিদ্ধান্তকে সম্প্রতি ‘ভুল হিসাব’ বলে আখ্যায়িত করেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। তিনি বলেন, ঐ সিদ্ধান্তের কারণে ইউক্রেন ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যুদ্ধে জীবন বাঁচাতে লড়ছে’।

২০১৪ সালে রাশিয়া ইউক্রেনের ক্রাইমিয়াদখলের পর ম্যার্কেলের সরকার ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠায়নি। অথচ একই সময়ে ইউক্রেনকে পাশ কাটিয়ে রাশিয়া থেকে গ্যাস আনতে বাল্টিক সাগরের নীচ দিয়ে পাইপলাইন বসানোর প্রকল্প অনুমোদন করেছিল জার্মানি, যেটা ‘নর্ড স্ট্রিম ২’ নামে পরিচিত। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বর্তমানে রাশিয়া থেকে ইউরোপে গ্যাস রপ্তানি করতে ইউক্রেনের ভূখণ্ড ব্যবহার হওয়ায় ইউক্রেন যে টাকা পেত, সেটা ভবিষ্যতে পেতো না।

নর্ড স্ট্রিম ২ প্রকল্পের কাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। তবে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর জার্মানি সেটা চালুর অনুমোদন স্থগিত রেখেছে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর সাবেক চ্যান্সেলর ম্যার্কেলের নীরবতার সমালোচনা করেছিলেন পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মাটেউশ মোরাভিয়েৎস্কি। তিনি বলেন, ‘মিসেস ম্যার্কেল, যুদ্ধ শুরুর পর আপনি কিছু বলেননি।’ গত ১০, ১৫ বছরে জার্মানির নীতি বর্তমানের রাশিয়াকে শক্তি জুগিয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। ম্যার্কেলের পর চ্যান্সেলর হওয়া ওলাফ শলৎসও রাশিয়ার বিরুদ্ধে দিতে যাওয়া ইইউর কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপে বাধা দিয়েছেন বলে জানান পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী। জার্মানির বর্তমান প্রেসিডেন্ট ফ্রাংক ভাল্টার স্টাইনমায়ারও সমলোচনার হাত থেকে রেহাই পাননি। ২০০৫ থেকে ২০০৯ এবং ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এই সময় তিনি রাশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন বলে অভিযোগ করেছেন বার্লিনে ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূত আন্দ্রি মেলনিক। তাই যুদ্ধ শুরুর পর স্টাইনমায়ারের উদ্যোগে আয়োজিত পিস কনসার্ট বর্জন করেছিলেন মেলনিক।
এছাড়া জার্মানির দৈনিক টাগেসস্পিগেলে তিনি লিখেছেন, ‘সম্পর্কটা (রাশিয়ার সঙ্গে স্টাইনমায়ারের) অপরিহার্য ছিল, এমনকি পবিত্র, যা কিছুই ঘটুক না কেন।’ ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূত আরও লিখেছিলেন, ‘এমনকি উসকানি ছাড়া য্দ্ধু শুরু করলেও এতে কোনো পার্থক্য হয়নি।’

জার্মানির কোনো নেতা সম্পর্কে একজন রাষ্ট্রদূতের করা এটিই সবচেয়ে কঠোর সমালোচনা। জার্মানির রেগেন্সবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্টেফান বিয়ারলিং ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘পুতিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর জার্মানির প্রতিটি সরকার এই সংকেত দিয়েছে যে ইউক্রেনের ভাগ্যের চেয়ে রাশিয়ার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এটা ক্রেমলিনকে উৎসাহ জুগিয়েছে।’ এদিকে, ম্যার্কেল এক বিবৃতিতে ২০০৮ সালে ইউক্রেনের ন্যাটোর সদস্য হওয়ার পথ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল বলে জানান।

ক্রামতোর্স্কে ইউক্রেনের হামলার তদন্ত শুরু : রাশিয়ার তদন্ত কমিটি ইউক্রেনীয় সশস্ত্র বাহিনী দ্বারা ছোঁড়া একটি তোচকা-ইউ ক্ষেপণাস্ত্র দ্বারা ক্রামতোর্স্কে হামলার ফলে ব্যাপক বেসামরিক হতাহতের ঘটনায় একটি ফৌজদারি মামলা শুরু করেছে, যে ঘটনায় কমপক্ষে ৩০ জন নিহত হয়েছে। ‘রাশিয়ান তদন্ত কমিটির প্রধান তদন্ত বিভাগ ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর একজন ব্রিগেড কমান্ডার এবং অন্যান্য অজ্ঞাত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে একটি ফৌজদারি মামলা শুরু করেছে,’ সংস্থাটি এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘তদন্ত প্রতিষ্ঠিত করেছে যে, তাদের কর্মগুলো ফৌজদারি কোডের ৩৫৬ ধারার অংশ ১-এ প্রদত্ত অপরাধের লক্ষণ দেখায়।’ এই ধারাটি বেসামরিক নাগরিকদের সাথে নিষ্ঠুর আচরণ এবং অস্ত্রের সশস্ত্র সংঘর্ষে ব্যবহার সম্পর্কে যা রাশিয়া দ্বারা স্বাক্ষরিত একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি দ্বারা নিষিদ্ধ। সূত্র : তাস, আল-জাজিরা, ওয়াশিংটন পোস্ট, ডয়চে ভেলে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইউক্রেন-রাশিয়া


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ