পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বজ্রপাত একটি পুরনো প্রাকৃতিক ঘটনা হলেও সাম্প্রতিক সময়ে এর প্রবণতা ও জানমালের ক্ষয়ক্ষতি বেড়ে গেছে। ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বজ্রপাতে ২০১১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সময়ে সারাদেশে মারা গেছেন ২ হাজার ৫৯০ জন। অবশ্য বেসরকারি পরিবেশবাদী সংগঠন ‘পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)’ এক জরিপে জানায়, ২০১১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত গত ১১ বছরে দেশে বজ্রপাতে ২ হাজার ৮০০ জনের প্রাণহানি হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই খোলা মাঠ বা হাওরে কৃষিকাজ করছিলেন। গতবছর বৃহত্তর সিলেটের চার জেলাসহ হাওর অধ্যুষিত দেশের সাত জেলায় বজ্রপাতে ৬৭ জনের প্রাণহানি হয়েছে বলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে। আবহাওয়া অধিদফতর বলছে, বছরে গড়ে দেড় শতাধিক মানুষ বজ্রপাতের কবলে প্রাণ হারাচ্ছে। বজ্রপাতে প্রাণহানি বাড়ায় ২০১৬ সালে সরকার এটিকে ‘জাতীয় দুর্যোগ’ ঘোষণা করে। এরপর বজ্রপাত ঠেকাতে নানা ধরণের পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও বলা হয়।
দুর্যোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত সময়কে আমাদের দেশে বজ্রপাতের মৌসুম হিসেবে ধরা হয়। একেকটা স্ট্রাইককে বলা হয় বজ্রপাত। পুরো ঘটনাকে বলা হয় বজ্রঝড়। বজ্রঝড় হলে একটার পর একটা ব্রজপাত হতেই থাকে। সাধারণত এটি ২৫ থেকে ৩০ মিনিটের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। গত বছর অক্টোবর মাসেও বজ্রপাতজনিত মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। বজ্রপাত আবহমানকাল ধরেই হচ্ছে, এখনও হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। এটা বন্ধ করার কোনো সুযোগ নেই। পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই আমাদের চেয়ে বেশি বজ্রপাত হয়। তবে সাম্প্রতিক বছরে বাংলাদেশ হয়ে ওঠেছে বিশ্বের অন্যতম বজ্রপাত হটস্পট। ফিনল্যান্ডের বজ্রপাত-বিষয়ক গবেষণা সংস্থা ‘ভাইসালা’র গবেষকরা বলছেন, বজ্রপাতের অন্যতম হটস্পট হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। বজ্রপাতে মানুষের প্রাণহানি ঠেকাতে দীর্ঘমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে প্রকল্প গ্রহণ করছে সরকার। কৃষি মন্ত্রণালয়ের ‘হাওরাঞ্চলে কৃষকদের জীবনের সুরক্ষায় বজ্রনিরোধক ব্যবস্থা স্থাপন’ শীর্ষক প্রস্তাবিত প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ২৩১ কোটি টাকা। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০০ কোটি টাকা। এটি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মাধ্যমে বাস্তবায়নের কথা রয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করার পরই এ নিয়ে কাজ করা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের কার্যপরিধিভুক্ত হয়েছে। এর বাইরে জনসচেতনতা তৈরির জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগ, গণপূর্ত বিভাগ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কাজ করছে। বজ্রপাতে নিহত ব্যক্তির পরিবার দরিদ্র ও অসচ্ছল হলে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে নিহতের পরিবারকে দাফন কাফন বাবদ নগদ বিশ হাজার টাকা আর্থিক সাহায্যো প্রদান করা হয়। ২০১৬ সালে বজ্রপাতে মৃত্যু ঠেকাতে ‘তালগাছ প্রকল্প’ গ্রহণ করা হয়। এরপর আবহাওয়া অধিদপ্তর বজ্রপাতের আগাম সংকেত দেবার জন্য ‘লাইটেনিং ডিটেকটিভ সেন্সর’ বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেকেলে পদ্ধতি হলেও বজ্রপাত নিরোধে তালগাছ অনেকটাই কার্যকর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তালগাছে কার্বনের স্তর বেশি থাকায় তা বজ্রপাত নিরোধে সহায়তা করে। কারণ তালগাছের বাকলে পুরু কার্বনের স্তর থাকে। তালগাছের উচ্চতা ও গঠনগত দিক থেকেও তালগাছ বজ্রপাত নিরোধে সহায়ক হতে পারে। তালগাছের পাশাপাশি নারকেল গাছ, সুপারি গাছ ও খেজুর গাছের মতো উচ্চতাসম্পন্ন গাছ লাগানো যেতে পারে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় বলছে, বর্তমানে টিআর আর কাবিখা প্রকল্পের আওতায় তালগাছ রোপণ অব্যাহত রাখা হচ্ছে। সারাদেশে রাস্তার ধারে ও জমির আইলে অন্তত ৫৫ লাখ তালগাছ লাগানোর পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানা যায়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পের মাধ্যমে বজ্রনিরোধক যন্ত্র স্থাপন এবং মোবাইল অ্যাপ, মোবাইল ভয়েস ও মোবাইল টেক্সট মেসেজের সাহায্যে বজ্রপাত আঘাত হানার আগে কৃষকসহ অন্যান্যদের সতর্ক করা হবে। এছাড়া জনসচেতনতা বৃদ্ধির বিষয়টিও রয়েছে প্রকল্পের মধ্যে। এদিকে ঠিক একই রকম একটি প্রকল্প নিচ্ছে কৃষি মন্ত্রণালয়। প্রতি বছর ধান কাটার মৌসুমে হাওরাঞ্চলে বজ্রপাতে বহু কৃষকের প্রাণহানি হয়। এ থেকে কৃষকসহ অন্যান্য মানুষকে রক্ষায় এ প্রকল্প কৃষি মন্ত্রণালয়ের। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এ প্রকল্পের আওতায় দেশের হাওরাঞ্চলসহ বজ্রপাতপ্রবণ ২৩ জেলায় ‘লাইটার অ্যারেস্টার’ সংবলিত বজ্রপাত-নিরোধক কংক্রিটের ছাউনি বা আশ্রয়কেন্দ্র (শেল্টার) নির্মাণ করা হবে। প্রাথমিকভাবে হাওর এলাকায় ১ কিলোমিটার পরপর ১ হাজার বজ্রপাত-নিরোধক কংক্রিটের ছাউনি নির্মাণ করা হবে। মেঘ ডাকার গুরুম গুরুম আওয়াজ পেলেই মাঠের কৃষকসহ মানুষজন এসব ছাউনিতে আশ্রয় নিতে পারবে। প্রতিটি ছাউনিতে ‘লাইটার অ্যারেস্টার’ বসানো হবে। আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম, অর্থাৎ বজ্রপাতের ৪০ মিনিট আগেই সংকেত দেবে সেই যন্ত্র। মোবাইলের মাধ্যমে এ সতর্কবার্তা মাঠের কৃষকসহ সবার কাছে পৌঁছে যাবে। প্রতিটি ছাউনির সম্ভাব্য নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা। এ ছাড়া এ প্রকল্পের আওতায় জনসচেতনতা বাড়ানো হবে বলেও জানান ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রের মতো কৃষকের জন্য বজ্রপাত আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর ডিজাইনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এক ডেসিমেল জায়গায় একটা পাকা ঘর থাকবে। প্রত্যেক ঘরে একটি করে লাইটনিং অ্যারেস্টার দেওয়া হবে, যাতে সতর্কবার্তা শোনার পর মানুষ সেই আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে পারে। এই আশ্রয়কেন্দ্রগুলো বহুমুখী হবে। কংক্রিটের আশ্রয়কেন্দ্রে লোকজন তাদের গবাদিপশুসহ নিরাপদে অবস্থান করতে পারবে। বজ্রপাত সংঘটনের পর তারা আবার কাজে ফিরে যেতে পারবে। মেহেরপুরের গাংনীতে এ ধরনের ছোট ছোট কয়েকটি ছাউনি করা হয়েছে। এটি হাওরে শুরু করার বিষয়টি খুব গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে। হাওরাঞ্চলে ব্যবহারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আর্থ নেটওয়ার্ক থেকে পাওয়া প্রস্তাবনা অনুযায়ী ‘আর্থ নেটওয়ার্কস লাইটিং অ্যান্ড সিভিয়ার ওয়েদার আর্লি ওয়ার্নিং সল্যুশন’ এর মাধ্যমে সেন্সরভিত্তিক স্বয়ংক্রিয় ‘ক্লাউড টু গ্রাউন্ড’ এবং ‘ক্লাউড টু ক্লাউড লাইট্নিং ডিটেকশন সিস্টেম’- যা মোবাইল অ্যাপ, মোবাইল ভয়েস ও মোবাইল টেক্সট মেসেজের সাহায্যে বজ্রপাত আঘাত হানার সর্বোচ্চ ৪৫ মিনিট আগে প্রকল্প এলাকার কৃষকদের সতর্ক করবে। একইসঙ্গে কৃষকসহ প্রকল্প এলাকার মানুষকে সচেতন করার কাজও করা হবে কৃষি মন্ত্রণালয়ের এ প্রকল্পের আওতায়।
বিল্ডিং কোড মানলে বজ্রপাতে ঝুঁকি অনেকাংশে কমে আসবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বিল্ডিং কোডে বলা আছে, একটা ঘর করতে গেলে তার ওপরে বজ্রপাত নিরোধক মানসম্মত দÐ দিতে হবে। অনেকে বলেন দÐ আছে। কিন্তু সেটা মানসম্মত হয় না। প্রতিটি ভবনে বজ্রপাত নিরোধক দÐ স্থাপন করা হচ্ছে কিনা, সেটা তদারকি করা গেলে বজ্রপাতের সংকট অর্ধেকের বেশি কেটে যাবে। বজ্রপাতে মৃত্যু বাড়ার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মোবাইল টাওয়ারের সংখ্যা এবং ফোনের ব্যবহার বৃদ্ধি, অতিরিক্ত জনঘনত্ব ও বজ্রপাত মৌসুমে মাঠে-ঘাটে এবং জলাশয়ে মানুষের কর্মক্ষেত্রে সম্পৃক্ততা বেশি হওয়ায় গত কয়েক বছর ধরে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণার পর সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের নজরদারি বেড়েছে। এতে উঠে আসছে মৃত্যুর প্রকৃত তথ্য। বজ্রপাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে অবকাঠামোগত প্রস্তুতির পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা বাড়ানোর প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠন ‘সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরাম (এসএসটিএএফ)’ এর সভাপতি ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, বজ্রপাতে মৃতদের বেশির ভাগই কৃষক। দেশের হাওর অঞ্চলগুলোতে বেশি বজ্রপাত হওয়ায় দ্রæত ঐসব অঞ্চলে আগাম বার্তা ও বজ্র-নিরোধক টাওয়ার নির্মাণ গুরুত্বপূর্ণ। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের আলাদা দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বজ্রপাতে বিপুল প্রাণহানি সহ ক্ষয়ক্ষতি কমবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এছাড়া বজ্রপাত সংক্রান্ত বিভিন্ন জনসচেতনতামূলক অনুষ্ঠান আমাদের গণমাধ্যম গুলোতে আরো বেশি বেশি প্রচার ও প্রকাশের ব্যবস্থা করতে হবে।
লেখক: স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, দৈনিক আমার বার্তা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।