Inqilab Logo

রোববার ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ১৮ কার্তিক ১৪৩১, ৩০ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভোজ্যতেলের আমদানি নির্ভরতা কমাতে হবে

ড. মোহা. হাছানাত আলী | প্রকাশের সময় : ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১২:০৮ এএম

আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি ও মহামারী করোনার কারণে গত দুই বছরে দেশে অন্তত ৮ দফায় ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। মূল্যবৃদ্ধির ফলে ক্রয় ক্ষমতা হারাচ্ছে নিম্নআয়ের মানুষ। নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সকল দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি চরমে উঠেছে। এতে করে টিসিবির ট্রাকের পেছনে ভোক্তাদের লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। অনেকেই বলছেন যে, একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী লোকসানের সম্ভাবনার কথা বলে কিছুটা কম ভোজ্যতেল আমদানি করছেন। ফলে চাহিদার তুলনায় আমদানি কম হওয়ায় ভোজ্যতেলের দাম বহুলাংশে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সর্বশেষ ২০২১ সালের ১৯ অক্টোবর সরকার নির্ধারিত মূল্য অনুয়ায়ী প্রতিলিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৬০ টাকা এবং খোলা সয়াবিনের দাম ১৩৬ টাকা নির্ধারিত ছিলো। তখন পাম তেলের দাম ছিলো লিটার প্রতি ১১৮ টাকা। এদিকে নতুন দাম অনুযায়ী এখন থেকে ভোক্তাকে বোতলজাত সয়াবিন তেলের ক্ষেত্রে লিটার প্রতি অতিরিক্ত ৮ টাকা গুনতে হবে। আর খোলা সয়াবিন তেলের ক্ষেত্রে লিটার প্রতি অতিরিক্ত ৭ টাকা ব্যয় করতে হবে। পাম তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে লিটার প্রতি ১৫ টাকা। ফলে ভোক্তা পর্যায়ে পাম তেলের জন্য পূর্বের ১১৮ টাকার স্থলে ১৩৩ টাকা খরচ করতে হবে। ভোজ্য তেলের লাফিয়ে লাফিয়ে দামবৃদ্ধির ফলে চরম বিপাকে পড়েছে নিম্নআয়ের খেটে খাওয়া মানুষ। কিছু দিন আগেই জ্বালানি তেলের দাম একলাফে লিটার প্রতি ১৫ টাকা বৃদ্ধি করা হয়েছে। এতে করে জনজীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে। পণ্য পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলে বাজারে নিত্যপণ্যের দাম অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষিজ পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির ফলে বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। প্রতিটি দ্রব্যের মূল্য আকাশচুম্বী। মানুষের ব্যয় বেড়েছে, কিন্তু সে তুলনায় আয় বাড়েনি। তাই নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ আয়ের সাথে ব্যয়ের হিসেব মিলাতে হিমশিম খাচ্ছে। গত দু›বছরে বহুমানুষ কর্ম হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছে। অনেকেই ব্যবসার পুঁজি হারিয়ে পেশা বদল করতে বাধ্য হয়েছে। বহু মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছে। চাপ পড়েছে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবন মানের ওপর।

দেশের ইতিহাসে ভোজ্যতেলের দাম এখন সর্বোচ্চ। অন্যতম পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে প্রতিমণ সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ৫ হাজার ৮০০ টাকায়। ২০১৯ সালে যা ছিল প্রায় ৩ হাজার ৫০০ টাকা। তিন বছরে দাম বৃদ্ধি পেয়েছে মণ প্রতি প্রায় ২ হাজার টাকা। অন্যদিকে গত তিন বছরে পাম তেলের দাম মণ প্রতি ৩০০০ হাজার টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। পাম তেলের বর্তমান বাজারমূল্য ৫৪০০ টাকা, যা ২০১৯ সালে ছিল ২ হাজার ৮০০ টাকা। মূলত আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে গত দুই বছরে ভোজ্যতেলের বাজার মোটেই স্থিতিশীল ছিল না। এছাড়া মহামারী করোনার কারণে উৎপাদন হ্রাসের পাশাপাশি ডলারের দাম বেড়ে গেছে। এমনতর অস্থিরতার কারণে দফায় দফায় ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বাজারের তথ্য মতে, গত বছরের জুন মাসে পাইকারি বাজারে মণপ্রতি সয়াবিনের দাম ছিল ৪ হাজার ৩০০ থেকে ৪ হাজার ৪০০ টাকা। সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫০০০ টাকায়। নভেম্বরে পৌঁছায় ৫ হাজার ৫০০ টাকায়। অথচ, ২০১৯ সালে এ দাম ছিলো মণপ্রতি ৩ হাজার ৮০০ টাকা। তিন বছরে দাম বেড়েছে শতাংশের হিসেবে প্রায় ৬৬.৬৬ শতাংশ। মূলত ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সয়াবিন তেল আমদানি করা হয়ে থাকে। তুলনামূলক কম দামের কারণে দেশে সোয়াবিন তেলের বিকল্প হিসেবে পাম অয়েল ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ভোজ্যতেল ছাড়াও খাদ্য উৎপাদনের কাঁচামাল হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার হয়ে আসছে পাম অয়েল। এর মূল উৎপাদক দেশ হলো ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া। সেখান থেকেই এই তেল আমদানি করা হয়। দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা বছরে প্রায় ২০ লাখ মেট্রিক টন, যার ৯০ শতাংশই আমদানি করতে হয়। ফলে প্রতি বছর আমাদের ভোজ্যতেল আমদানি বাবদ কয়েক হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রায় ব্যয় করতে হয়। অথচ, সরিষার তেল হতে পারতো অন্যতম বিকল্প ভোজ্যতেলের উৎস। দেশে সরিষার চাষাবাদ জনপ্রিয় করার জন্য কৃষক পর্যায়ে স্বল্প সুদে ঋণ বিতরণ করা গেলে কৃষকরা একদিকে যেমন লাভবান হতো অন্যদিকে সরিষা চাষে কৃষকেরা উৎসাহিত বোধ করতো। পাশাপাশি ভোজ্যতেলের আমদানি নির্ভরশীলতা কমানো যেত। এছাড়া আমাদের দেশে বহু অটো রাইস মিল রয়েছে। অটো রাইস বার্ন ব্যবহার করেও এক ধরনের স্বাস্থ্যসম্মত ভোজ্যতেল (রাইস বার্ন অয়েল) উৎপাদন করা যায়। আমরা আমদানি তেলের বিকল্প হিসেবে এ ধরনের তেল উৎপাদনের দিকে মনোনিবেশ করতে পারি। বিষয়টি সরকারসহ সংশ্লিষ্টরা ভেবে দেখতে পারে। এছাড়া আমরা দেশে প্রচুর পরিমাণে সূর্যমুখী চাষাবাদ করে তা থেকেও তেল উৎপাদন করতে পারি। যেভাবেই হোক আমাদের ভোজ্যতেলের ওপর থেকে আমদানি নির্ভরশীলতা কমাতে হবে।

লেখক: প্রফেসর, আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন