Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্মীয় ও সংস্কৃতিতে নামের প্রভাব

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান | প্রকাশের সময় : ২২ জানুয়ারি, ২০২২, ১২:০৩ এএম

নাম পরিবর্তন করা সাধারণত জায়িয। তবে খারাপ নাম পরিবর্তন করে ভাল নাম রাখা, নাম সুন্দর করা সুন্নাহ। রাসূলুল্লাহ স. বলেন, কিয়ামতের দিন তোমাদেরকে তোমাদের নাম ও পিতার নামানুসারে ডাকা হবে। তাই তোমাদের নামসমূহ সুন্দর করো। রাসুলুল্লাহ স. এরূপ অনেক সাহাবীর মন্দ নাম পরিবর্তন করে ভাল নাম রেখেছেন। যেমন রাসূলুল্লাহ স.উমর রা. এর এক কন্যার নাম ‘আসিয়া (অবাধ্যা নারী) পরিবর্তন করে জামীলা (সুন্দরী) রেখেছেন। এছাড়া নবী সা. আল-আস, আযীয, ‘আতালা, শয়তান, আল-হাকাম, গুরাব, হুবাব নাম পরিবর্তন করেছেন এবং শিহাব নাম পরিবর্তন করে হিশাম রেখেছেন। তিনি হারব (যুদ্ধ) এর পরিবর্তে সিল্ম (শান্তি), মুুদতাজি (অস্থির) এর পরিবর্তে মুনবাইছ (সক্রিয়), আফরা (মরুভুমি) নামক ভূমিকে খাদিরাহ (সবুজ), শিয়াবুদ দালালাহ (ভ্রষ্ট জনপদ) কে শিয়াবুল হুদা (হিদায়েতের জনপদ), জারজ ও কুলভ্রষ্ট সন্তানকে কুলপুত্র ও সুপুত্র নামে নামকরণ করেছেন।

এক নাম পরিবর্তন করে অন্য নাম রাখা জায়িয হওয়ার ব্যাপারে ফকীহগণ একমত। বরং খারাপ নাম পরিবর্তন করে শরীয়ত সম্মত নাম রাখাই বাঞ্ছনীয়।
ইসলামে একাধিক নামকরণ বৈধ। যেমন-আমাদের নবী সা. এর নাম পবিত্র কুরআনেই মুহাম্মাদ ও আহমাদ দু’ভাবে এসেছে। তবে অবশ্যই সবগুলো নামই ইসলামী শরী’আহ্ অনুমোদিত ও অর্থবোধক হওয়া উচিত।
তবে একাধিক নামের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় নামটি কুনিয়্যাত বা উপনাম হিসেবে গ্রহণ করা ইসলামী শরী’আহ্ সম্মত। যেমন, রাসূলল্লাহ স.-এর উপনাম আবুল কাসিম। এটি আমাদের পূর্ববর্তী সাহাবী, তাবিয়ীদের অনুশীলিত ধারা। কখনো তাঁরা নিজের নাম, কখনো তার সন্তান, পিতা বা তার সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সাথে সম্মন্ধিত করে এটি ব্যবহার করতেন। যেমন নবী সা. আয়িশা রা. কে তাঁর বোনের ছেলের নামের সাথে সম্মন্ধিত করে উম্মু আবদিল্লাহ উপনাম দিয়েছে। আবু হুরায়রা রা. কে তাঁর সাথে সংশ্লিষ্ট বিড়ালের সাথে সম্মন্ধিত করে আবু হুরায়রা উপনাম দিয়েছেন। সাহাবীগণ আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. কে তাঁর পিতার সাথে সম্মন্ধিত করে ইবনু আব্বাস উপনামে ডাকতেন। কিন্তু অনারবগণ, বিশেষ করে উমাইয়া খিলাফতের সময়ে এ ধারাকে বিলুপ্ত করেছে। তারা তখন দীন, মিল্লাত, হক ইত্যাদির সাথে সম্পৃক্ত করে অহংকারবশত তাদের উপনাম গ্রহণ শুরু করে। যেমন- ইয্যুদ্দিন (দীনের সম্মান), ইযযুল মিল্লাত (জাতির মর্যাদা) ইত্যাদি। অথচ সংশ্লিষ্ট নামের অর্থের বিপরীত নামই তার কর্মের আলোকে তার জন্য যথার্থ। আর অহংকার ব্যতীত ব্যক্তির কর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ অথবা ব্যক্তির পরিচিতির জন্য উপাধি গ্রহণও ইসলামে বৈধ। সাহাবি তাবিয়ী ও পূর্ববর্তী মুহাদ্দিস, ফকীহ্গণেরমধ্যে এ ধারা চালু ছিল।
সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে ইসলামে নাম সংক্ষিপ্তকরণ বৈধ। কোন সম্বোধিত ব্যক্তির নামের শেষাংশ থেকে দু-একটি অক্ষর বিলুপ্ত করে এ সংক্ষিপ্তকরণ করতে হয়। আরবী ব্যাকরেণর ভাষায় এটিকে তারখীম বলে। এ পদ্ধতিতে রাসূল সা. তাঁর স্ত্রী আয়িশা রা. কে স¤োধন করার সময় স্নেহ করে (হে ‘আয়িশু) বলেছেন।
আবু হুরায়রা রা. কে (হে আবু র্হি) বলেছেন। অবশ্য আল্লামা ইবনে বাত্তাল রহ. রাসূল স. এর এ ব্যবহারকে তারখীম বলতে অস্বীকার করেছেন। তাঁর মতে, এক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ স.আয়িশা ও হুরায়রা আরবী স্ত্রীবাচক শব্দদ্বয়ের পুংলিঙ্গ রূপ ‘আয়িশু ও র্হি ব্যবহার করেছেন। তবে তারখীম হোক অথবা স্ত্রীবাচক শব্দের পরিবর্তে পুংলিঙ্গ বাচক শব্দ ব্যবহার হোক উল্লেখিত দু’টি পদ্ধতি ব্যতীত নাম সংক্ষিপ্তকরণে আর কোন পদ্ধতি রাসূল স. ও সাহাবীদের থেকে পাওয়া যায় না। অতএব, এ পদ্ধতিদ্বয়ের বাইরে নাম সংক্ষিপ্তকরণে আর কোন পদ্ধতি ইসলামে বৈধ নয়।
ব্যক্তির নামের অর্থ ব্যক্তির জীবনাচরণে প্রভাব বিস্তার করে থাকে যা হাদীস দ্বারা স্বীকৃত। ৬ষ্ঠ হিজরীতে হুদায়বিয়ার সন্ধির প্রাক্কালে রাসূলুল্লাহ স. ও কাফিরদের মধ্য প্রচন্ড উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশে দু’পক্ষের মধ্যে দূত আগমন-প্রস্থান চলছিল। এ ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ কাফিরদের পক্ষ থেকে সুহাইল (অতি সহজ) বিন আমর আগমন করলে তার সাথে সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়। তার আগমন প্রত্যক্ষ করে রাসূল সা. বলেন, তোমাদের কাজ সহজ হয়ে গেল। এখানে সুহাইলের নামের অর্থের প্রতি রাসূল সা. ইশারা করেন।
এছাড়া সাঈদ ইবনুল মুসাইয়িব রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, তার দাদা হায্ ন রাসূলুল্লাহ স.-এর নিকট আগমন করলে তিনি তার নাম জিজ্ঞাসা করেন। তার নাম হায্ন (দুঃশ্চিন্তা) শুনে রাসূল সা. তার নাম পরিবর্তন করে বললেন, তোমার নাম সাহল (সহজম স্বাভাবিক)। তিনি তার পিতার দেয়া নাম পরিবর্তন করতে চাইলেন না। ফলে হার নাম হায্ নই থেকে গেল। সাঈদ ইবনুল মুসাইয়িব রহ. বলেন, আসাতের পরিবারে এখন পর্যন্ত দুঃশ্চিন্তা, বিষণ্নতা লেগেই আছে। তাই ব্যক্তির নাম রাখার সময় ভাল অর্থবোধক নাম রাখা উচিত।
সাধারণভাবে ব্যক্তিকে তার নাম ধরে ডাকা বৈধ। তবে ব্যক্তির মর্যাদা হানি হয় এমনভাবে ডাকা বৈধ নয় হানাফি মাযহাব মতে, কোন ব্যক্তি তার পিতাকে বা স্ত্রী তার স্বামীকে সরাসরি নাম ধরে ডাকা মাকরূহ। বরং এমন শব্দে ডাকা উচিত, যাতে সন্তান ও স্ত্রীর উপর তাদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়। শাফিয়ী মাযহাব অনুযায়ী কোন ব্যক্তির সন্তান, ছাত্র ও সেবকের জন্য সুন্নাত হলো তাকে নাম ধরে না ডাকা। আবার গর্ব-অহংকার প্রকাশ পায় এরূপভাবে আমার দাস, আমার মুনিব বলা হাম্বলী মাযহাব অনুযায়ী নিষিদ্ধ।
সরকারি বা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে নাম নিবন্ধন ইসলাসে বৈধ। ইসলামে ইবাদত ও মুআ’মালাত দু’ভাবে শরয়ী বিধান প্রণয়ন করা হয়েছে। পারস্পরিক লেনদেন, পার্থিব কার্যক্রম সাধারণত মুআ’মালাতের অন্তর্ভুক্ত। আর এক্ষেত্রে শরয়ী‘ নিষিদ্ধতা ব্যতিরেকে সকল কার্যক্রমই বৈধ। নাম নিবন্ধন যেহেতু এরূপ কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত তাই এটি জায়েয।
ইসলাম নির্দেশিত বিধানের আলোকে বর্তমানে বাংলাদেশের অধিকাংশ মুসলিমের মধ্যে নামকরণের এ প্রক্রিয়া পূর্ণরূপে অনুশীলিত হচ্ছে না। কেউ পূর্ণরূপে, কেউ আংশিক, কেউ বা বিকৃতভাবে তা অনুশীলন করছে। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোকপাত করা হল।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ধর্মীয় ও সংস্কৃতিতে নামের প্রভাব
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ