Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্মীয় ও সংস্কৃতিতে নামের প্রভাব

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান | প্রকাশের সময় : ১৫ জানুয়ারি, ২০২২, ১২:০৩ এএম

প্রত্যেক কাজ আল্লাহ্র নামে শুরু করা মুসলিম জীবনাচরণের অন্যতম অনুষঙ্গ। এমনকি আল্লাহর নামে শুরু না করা কাজ হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী বরকত-শূন্য বিবেচিত হবে। আল্লাহ্র নাম উচ্চারণ ব্যতীত জবাইকৃত পশু মুসলিমের জন্য খাওয়া হালাল নয়। আল্লাহ বলেন, যার উপর (জবাইয়ের সময়) আল্লাহর নাম উচ্চারিত হয়নি তা তোমরা খাবে না। তাই ইসলামে নামের গুরুত্ব অপরিসীম।
ইসলামে সন্তানে নামকরণ পিতামাতার আবশ্যকীয় কর্তব্য হিসাবে গণ্য। সকল মাযহাবে এটিকে পিতামাতার উপর সন্তানের অধিকার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ইমাম ইবনু ‘আরাফা আল-মালিকী [৭১৬-৮০৩ হি.] রহ. উল্লেখ করেছেন, মূলনীতির দাবি হচ্ছে নামকরণ করা ওয়াজিব। এক্ষেত্রে মাতার তুলনায় পিতা অগ্রগণ্য। নামকরণে পিতা-মাতার মধ্যে মতভেদ দেখা দিলে পিতা অগ্রাধিকার পাবেন। আল্লাহ তাআ‘লা বলেন, তোমরা তাদেরকে তাদের পিতৃপরিচয়ে ডাক। এটাই আল্লাহর কাছে ন্যায়সঙ্গত। এছাড়া সুন্দর নামে ব্যক্তিকে ডাকা ইসলামে মুস্তাহাব। যে নাম ব্যক্তির পছন্দ এবং প্রিয় সে নামেই ডাকা উচিত। খারাপ বা নিকৃষ্ট নামে কাউকে নামাঙ্কিত করা বা কাউকে ডাকা ইসলামে নিষিদ্ধ। এটাকে ইসলামে কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে । আল্লাহ্ বলেন, তোমার একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না, কেউ ঈমান আনলে তাদের মন্দ নামে ডাকা গুনাহ, যারা এরূপ কাজ থেকে তাওবা করে না তারা জালিম।
রাসূল সা. জন্মগ্রহণ করার সপ্তম দিনে নামকরণ করার কথা বলেছেন। তিনি বলেন, প্রত্যেক সন্তানই তার আকীকার সাথে দায়বদ্ধ থাকে, তার পক্ষ থেকে জন্মের সপ্তম দিনে (পশু) জবেহ করা হবে, তার নামকরণ করা হবে এবং তার মাথা মুন্ডন করা হবে। তবে রাসূল সা. নিজে তাঁর সন্তানের জন্মের দিনই তার পিতা ইবরাহীমের নামানুসানে নামকরণ করেছেন। তাছাড়া সাহাবীদের মধ্যে আবু মূসা আল- আশাআ’রী রা. তাঁর সন্তান জন্মগ্রহণের দিনই তার নাম রাখেন ইবরাহীম এবং রাসূল সা. এর নিকট নিয়ে আসেন। তিনি তার জন্য দু‘আ করেন।
এ সকল হাদীসের আলোকে সকল মাযহাবেই জন্মের পরপরই নাম রাখাকে বৈধ গণ্য করা হয়েছে। তবে ঈমাম শাফিয়ী ও ঈমাম মালিক রহ. জন্মের ৭ম দিনে নামকরণকে মুস্তাহাব গণ্য করেছেন। ইমাম ইবনুল কায়্যিম রহ. এর মতে, জন্মগ্রহণের পর ৩ দিন বা ৭ দিন পর্যন্ত নামকরণ বিলম্বিত করা এর আগে পরে করা বৈধ। তাঁর মতে, বিষয়টি প্রশস্ত। তবে ইমাম বুখারী রহ. এক্ষেত্রে সূক্ষè পার্থক্য করেছেন। তাঁর মতে, যে সন্তানের আকীকা দেয়া হবে তার নাম রাখা হবে জন্মের দিন। আল্লামা আহমদ আলী সাহারানপুরী র. বলেন, এরূপ সূক্ষè পার্থক্য ইমাম বুখারী রহ. ব্যতীত আর কেউ করেছেন বলে আমার জানা নেই।
ইসলামে সন্তান জন্মগ্রহণের ৭ম দিনে আক্বীক্বার মাধ্যমে সন্তানের নামকরণের কথা বলা হয়েছে। তবে ওযরের কারণে সন্তান জন্মগ্রহণের ১৪তম দিন, ২১তম দিন বা অন্য সময়ে করলে আদায় হয়ে যাবে বলে কোন কোন ফকীহ মতপ্রকাশ করেছেন। এক্ষেত্রে আকীকা ব্যতীত সন্তানের নামকরণে ইসলাম সম্মত আর কোন অনুষ্ঠানের সম্মতি নাই। এ অনুষ্ঠান করতে পুত্র সন্তানের জন্য দু’টি এবং কণ্যা সন্তানের জন্য ১টি ছাগল জাতীয় পশু জবাই করার জন্য রাসূল সা. বলেছেন। এমনকি প্রত্যেক সন্তান এরূপ আকীকার প্রতি দায়বদ্ধ। মুহাদ্দিসগণ এ দায়বদ্ধতার ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে, যদি পিতা সন্তানের আকীকা না করেন তাহলে এ সন্তান আখিরাতে পিতার জন্য সুপারিশ করবে না।
হানাফী মাযহাবে ইমাম আবু হানীফা রহ. এর মতে, মৃত অবস্থায় জন্মগ্রহণকারী সন্তানের নামকরণ করা হবে না। তবে এক্ষেত্রে ইমাম মুহাম্মাদ রহ. ভিন্ন মত পোষণ করেছেন। মালিকী মাযহাবেও এ মতই বর্ণিত হয়েছে। তবে ইমাম শাফিয়ী রহ. এর মতে, এরূপ সন্তানের নামকরণ মুস্তাহাব বলে উল্লেখ করেছেন। এক্ষেত্রে সন্তান ছেলে না মেয়ে বুঝা না গেলে উভয়ের জন্য প্রযোজ্য এরূপ কোন রাখা যেতে পারে।
ফকীহগণের মতে, জন্মের পর মৃত্যুবরণকারী সন্তানের নামকরণ করা হবে। হানাফী মাযহাব মতে, জন্মের পর নবজাতক চিৎকার করলে বড়দের মত তার সকল অধিকার সাব্যস্ত হয়ে যাবে। মালিকী ও শাফিয়ী মাযহাব মতে, এরূপ সন্তানের নামকরণ করা মুস্তাহাব।
সাধারণত যে সকল নামের ব্যাপারে ইসলামে নিষিদ্ধতা নেই, সে সকল নাম রাখা বৈধ বলে গণ্য হবে। তবে জমহুর আলিমগণের মতানুসারে আল্লাহ্ বা তাঁর বিশেষ গুণসমূহের সাথে সম্পর্কিত দাসত্বজ্ঞাপক নাম রাখা মুস্তাহাব। রাসূল সা. বলেন, তোমাদের নামসমূহের মধ্যে আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় নাম আব্দুল্লাহ, আব্দুর রহমান। ইমাম কুরতুবী র. এর মতে, এ উত্তমতা এ দু’টি নামের মত আল্লাহর অন্যান্য গুণবাচক নামের সাথে সম্বন্ধযুক্ত যেমন- আবদুল মালিক, আবদুর রহীম ইত্যাদির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ইবনে আবিদীনের মতে- সাধারণভাবে ‘আব্দুল্লাহ’ নাম সব নাম থেকে, এমন কি আবদুর রহমান থেকেও উত্তম। আব্দুল্লাহ ও আব্দুর রহমান এ দু’টির পর সর্বোত্তম নাম মুহাম্মাদ, তারপর আহ্মাদ, তারপর ইবরাহীম। তিনি আরো বলেন, আব্দুল্লাহ, আব্দুর রহমান নামকরণ তাদের জন্য উত্তম, যারা দাসত্বসূচক নামকরণে আগ্রহী। সাধারণভাবে উত্তম নয় এবং এ উত্তমতা আল্লাহর নিকট মুহাম্মদ ও আহমাদ নাম সবচেয়ে প্রিয় হওয়ার পরিপন্থিও নয়। কেননা তিনি তাঁর নবীর জন্য হার নিকট সবচেয়ে প্রিয় নামই পছন্দ করেছেন। এটিই সঠিক।
নবীদের নামে নামকরণ নিয়ে কেউ কেউ মতভেদ করলেও জমহুর আলিমদের মতে নবীদের নামে নামকরণ বৈধ। কেননা রাসূল স. বলেন, তোমরা নবীদের নামে নামকরণ কর। তবে মুহম্মাদ ও আহ্মাদ নামে নামকরণের ফযীলতের বিবরণ সম্বলিত যে সকল হাদীস বর্ণিত হয়েছে তার সবই খুবই দুর্বল বা জাল। মুহাম্মাদ স.-এর নামে নাম রাখার ব্যাপারেও হাদীসে এসেছে- “আমার নামে (মুহাম্মদ) নামকরণ কর, তবে আমার কুনিয়্যাহ বা উপনাম (আবুল কাসিম) দ্বারা উপনাম রেখো না।”



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ধর্মীয় ও সংস্কৃতিতে নামের প্রভাব
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ