Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্মীয় ও সংস্কৃতিতে নামের প্রভাব

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান | প্রকাশের সময় : ২১ জানুয়ারি, ২০২২, ১২:০৪ এএম

তবে অধিকাংশ মুহাদ্দিস ও ফকীহগণের মতে, রাসূল স. এর এ নিষেধাজ্ঞা তার জীবদ্দশায় প্রযোজ্য ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর কুনিয়্যাত (আবুল কাসিম) দ্বারা নামকরণ বৈধ। কেননা আলী রা. এর পৌত্র মুহাম্মাদ ইবনুল হানাফিয়্যা রহ.-এর কুনিয়্যাহ ছিল আবুল কাসিম। এভাবে নবী, রাসূল, ওলী, বুযুর্গ ব্যক্তির নামানুনারে নামকরণ উত্তম। এছাড়া আরবী ভাষায় ভাল অর্থবোধক শব্দে নাম রাখা বৈধ। তবে তা রাসূল স. কর্তৃক নিষিদ্ধি বা অপছন্দনীয় নামসমূহের অন্তর্ভুক্ত হবে না।
মুসলিমের নামকরণ সাধারণভাবে আরবীতেই চলে আসছে সাহাবীদের যামানা থেকে। তবে কিছু সংখ্যক শব্দ, যা অন্যভাষার হলেও এগুলো দীর্ঘদিন আরবীতে ব্যবহৃত হওয়ায় আরবী রূপ লাভ করেছে (মর্আরাব) ‘‘যে বিদেশী শব্দকে হুবহু রূপে অথবা আরবী শব্ধ গঠন কাঠামোতে পরিবর্তন করে আরবী ভাষায় রূপান্তর করা হয়েছে। এরূপ শব্দকে ম‘র্আরাব বলে।
এ ব্যাপারে আরবী ব্যতীত অন্য যে কোন ভাষায় নামকরণের ব্যাপারে রাসূল স. থেকে সরাসরি কোন অনুমোদন বা নিষেধাজ্ঞা আমার জানা নেই। তবে উমর রা. তাঁর রাষ্ট্রীয় যে ফরমান বিজিত অমুসলিমদের উদ্দেধ্যে প্রেরণ করেন তাতে মুসলিমদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ নাম অমুসলিমদের অনুসরণের নিষেধাজ্ঞা বুঝায়। তার ফরমানে তিনি এ বলে অমুসলিমদের থেকে অঙ্গীকার আদায় করেন যে, ‘আমরা মুসলিমদের সম্মান করব...। আমরা তাদের নাম ও উপাধির মত উপাধি ব্যবহার করব না।
এ থেকে মুসলিম অমুসলিম নামকরণের পার্থক্য থাকার আবশ্যকীয়তা বুঝা যায়। ইমাম ইব্নে তাইমিয়্যাহ রহ. কেবল অমুসলিমদের নাম নয়; বরং জাতীয়তা বোধক নামকেও মাকরূহ বলেছেন। তিনি দলীল হিসাবে রাসূল স. এর দু‘টি হাদীস উল্লেখ করেছেন। যে ব্যক্তি জাতীয়তার দিকে ডাকে সে আমার দলভুক্ত নয়। এ হাদীসে পারস্পরিক যে ডাকার কথা বলা হয়েছে তা জাতীয়তাবোধক নামের ক্ষেত্রে। কেননা এরূপ জাতীয়তাবোধক সম্মন্ধবাচক শব্দ দ্বারা ব্যক্তির পরিচয় দেয়া হয় আর জাতীয়তাবোধক এরূপ সম্বন্ধবাচব শব্দ আল্লাহ্র রাসূল স. অপছন্দ করেছেন। যেমন রাসূল স.-এর এক সাহাবী কর্তৃক আমি ফরাসী যুবক বলার প্রতি উত্তরে তিনি বলেন, তুমি কেন বললে না আমি আনসারী যুবক। এর দ্বারা রাসূল স. শারয়ী সম্বন্ধবাচক শব্দকে গ্রহণ করা পছন্দ করেছেন।
এছাড়া রাসূল স. এর হাদীস “যে ব্যক্তি অন্য কোন জাতির নাথে সাদৃশ্য স্থাপন করে সে তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়”। এ হাদীস দ্বারাও বুঝা যায়, অমুসলিমদের অনুশীলনকৃত নিজস্ব ভাষায় তাদের নামকরণের ধারায় মুসলিমদের জন্য অনুসরণ করা উচিত নয়। তাই নামকরণ আরবী ভাষাতেই হওয়া উচিত।
অধিকাংশ আলিম ফিরিশতাদের নামে নামকরণ জায়িয বলেছেন। তবে ইমাম মালিক রহ. বিষয়টি মাকরূহ বলেছেন। আবার হারিস বিন মিসকীন রহ. এরূপ নামকরণকে উত্তম বলে মত প্রকাশ করেছেন। তবে এক্ষেত্রে জমহুরের বক্তব্যই অগ্রগণ্য।
আল্লাহ তা‘আলার সাথে খাস নামসমূহ দ্বারা অন্য কারো নামকরণ করা হারাম। যেমন- খালিক, কুদ্দুস, রাহমান, অথবা এমন কো উপাধি যা আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো জন্য প্রযোজ্য নয়, তাও হারাম। যেমন- রাজাধিরাজ। রাসূলুল্লাহ স. বলেন, কিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট নামসমূহের মধ্যে সবচেয়ে ক্রোধ উদ্রেককারী ও বিরক্তিকর হবে সেই ব্যক্তির নাম, যার নাম রাখা হয়েছে মালিকুল আমলাক অর্থাৎ রাজাধিরাজ। তবে যে সকল নাম বহু অর্থবোধক আল্লাহ্ তা‘আলা ও অন্যান্যদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায় তা দ্বারা নামকরণ জায়িয। যেমন আলী, রাশীদ ও বাদী‘ ইত্যাদি। আল-হাস্ কাফী বলেন- আমাদের ক্ষেত্রে তা এক অর্থে ব্যবহৃত হবে এবং আল্লাহর ক্ষেত্রে অন্য অর্থে ব্যবহৃত হবে। যেমন আল্লাহ নিজেই রাহীম শব্দ দ্বারা রাসূল স. কে গুণান্বিত করেছেন।
আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো সাথে সম্বন্ধবাচক দাসসূচক নামকরণ হারাম। এ ব্যাপারে সকল ফকীহ একমত পোষণ করেছেন। যেমন আবদুল উয্যা, আবদু আমর, আবদুল কা‘বা আবদুদ্দার, আবদু ফুলান (অমুকের দাস) ইত্যাদি। হাম্বলী মাযহাব মতে নবী সা. এর সাথে নির্দিষ্ট এরূপ নাম রাখাও হারাম। যেমন-আদম সন্তানের নেতা, মানবজাতির নেতা, সকলের নেতা, মানবজাতির শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি ইত্যাদি
ইসলামী শরী‘আতে এমন সব শব্দ দ্বারা নামকরণ অপছন্দ করা হয়েছে যার (নামের অর্থ) অবিদ্যমানতাকে অপছন্দ করা হয়। যেমন-রাবাহ (লাভ), আফলাহ (সফল), নাফি (উপকারি), ইয়াসার (স্বচ্ছলতা) ইত্যাদি। রাসুলল্লাহ স. বলেন, তোমার সন্তানের নাম ইয়াসার, রাবাহ, নাজীহ বা আফলাহ রাখবে না। কারণ তুমি অবশ্যই বলবে অমুক কি আছে ? উত্তরে সে না থাকায় (উত্তর দাতা) বলবে, নেই।
অবশ্য এরূপ নিষিদ্ধতা মাকরূহ তানযিহী ধরণের। কেননা ওমর রা. এর পরবর্তী বংশধর বিখ্যাত মুহাদ্দিস ছিলেন “রাবাহ”। যার নিকট থেকে ইমাম বুখারী রহ. ও হাদীস বর্ণনা করেছেন।
ইবনে উমর রা. এ আযাদকৃত একজন বিখ্যাত মুুহাদ্দিস দাস ছিল যার নাম ছিল নাফি’। এছাড়া আরো কয়েকজন সাহাবী ও বিখ্যাত মুহাদ্দিস তাবিয়ীও এ নামে ছিলেন বলে ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেছেন। আর সেসব নামও অপছন্দনীয়, যা থেকে বিরক্তির উদ্রেক হয়। যেমন হারব (যুদ্ধ), র্মুবা (তিক্ত), কাল্ব (কুকুর), হায়্যাতুন (সাপ) ইত্যাদি। মালিতী মাযহাব মতে, মন্দ সকল নাম রাখা নিষিদ্ধ। যেমন হারব (যুদ্ধ), হুযন (দুঃশ্চিন্তা), যিরার (ক্ষতি) ইত্যাদি। শাফিয়ী মাযহাব মতে, মন্দ নাম রাখা মাকরূহ।
যেমন-শয়তান, জালিম (অত্যাচারী), শিহাব (অগ্নিশিখা), হিমার (গাধা) ইত্যাদি। হাম্বলী মাযহাব মতে, অহংকারীদের নামানুসারে নামকরণ মাকরূহ। যেমন-ফেরাউন ও শয়তানের নামসমূহ।
এছাড়া রাসূলুল্লাহ স. যে নাম দ্বারা স্বীয় পবিত্রতা, শ্রেষ্ঠত্ব বা প্রশংসা বুঝায় এরূপ নাম অপছন্দ করেছেন। যেমন- বাররাহ নেককার)। আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম রহ. উল্লেখ করেছেন যে, এভাবে তাক্বী, মুত্তাক্বী, মুখলিস, আবরার ইত্যাদি যে সকল শব্দ দ্বারা ব্যক্তির পরিশুদ্ধতা ও প্রশংসা বুঝায় এরূপ শব্দ দ্বারাও নামকরণ মাকরূহ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ধর্মীয় ও সংস্কৃতিতে নামের প্রভাব
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ